স্বাগতম

কফি মগটা সামনের টেবিলে রেখে শৈবালের পাশে বসল রিনি, “এতও ভেবো না, ঠিক একটা না একটা কিছু ব্যবস্থা হবে ।”, বলেই শৈবালের হাতটা শক্ত করে ধরল ।

বিদেশ বিভুঁই-এ দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরা ছাড়া তো কোন উপায় নেই । পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেইও, নিজেদের ভাড়া নেওয়া ছোট্ট ফ্ল্যাটটার ব্যালকনিতে বসে এই কথাগুলোই ঘোরাফেরা করছিল শৈবালের মাথায় ।

*************

শৈবাল আর রিনি ভালবেসে একে অপরের হাত ধরেছিল বছর পাঁচেক আগে, দুই বাড়ি থেকেই ওদের ভালবাসা নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল, বিশেষত শৈবালের বাড়ি থেকে, তার উপর শৈবালের দশটা পাঁচটা কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকুরী নেই যখন – তখন তো অশান্তি হতেই হতো ।

শৈবালের বাড়ি আহিরীটোলা, রিনি শ্যামবাজার । ইউনিভার্সিটি এক হওয়ার সুবাদে পরিচয়, বন্ধুত্ব, প্রেম । শৈবাল বাকী আর পাঁচটা ছেলের থেকে অন্যরকম এটাই মনে হতো রিনির, কাছে আসার পর বুঝেছিল ভুল করেনি । ওর মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে একটা শিল্পীসত্ত্বা, কিন্তু, দুঃখের বিষয়, কেউই তার কদর করেনি, ভালভাবে তাকিয়েও দেখেনি এই গুণীর কাজগুলোকে । রিনি সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নেয়নি, বরাবর সোজাসাপ্টা, দৃঢ়, সপ্রতিভ, বুদ্ধিমতী মেয়ে রিনি । আর শৈবাল থাকে নিজের খেয়ালে, নিজের জগতে, নিজের সৃষ্টিতেই মত্ত ।

সৃষ্টিশীলতাকে ‘পাগলের পাগলামো’ আখ্যা দিতে বেশী সময় নেয়নি শৈবালের উকিল বাবা । ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে শেফ হওয়া থুড়ি রান্নাবান্না করাটাকে পেশা করতে চাইলে কোন বাবারই বা মাথার ঠিক থাকে? সুতরাং, মানেননি । তারপর রিনি মেয়েটি ছেলেকে সঠিক পথে আনার বদলে তাকে আরও প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে রিনিও চক্ষুশূল, তাই শৈবাল আর রিনির দুজনের দুজনকে ছাড়া আর কেউ…।

***************

দুজনেই দেশ ছেড়ে চলে এসেছিল বিদেশে, শৈবালের নিজের স্বপ্নের জগতের জমি শক্ত করার জন্য এই সুযোগটা খুব ভাল সময়ে পেয়েছিল ও, আর তাইই এই দেশে আসা । কিন্তু, দিন গুজরান? তাই নিউ ইয়র্কে একটা চাকরি জোটাতেই হয়েছিল । শুধু স্বপ্নকে ছুঁতে গিয়ে তো পেট চলবে না, তাই নিজের বেকারী শপ, নিজের চাকরী, লোন নিয়ে কেনা নিজের রেস্টুরেন্টের জমি, ভাড়ার এপার্টমেন্ট এইসব সামলে বেশ চলছিল দুজনের । কিন্তু রিসেশনের সময় হঠাৎ চাকরী চলে যাওয়াটা সবটা ওলট পালট করে দিল ।

।।২।।

-“একটা বেকারী শপ দিয়ে কীভাবে এত কিছু টানবো বলতো? আর এখন এই অবস্থায় কোথায় তোমার একটু যত্ন আত্তির প্রয়োজন, তা তো পারছিই না,…. এর মধ্যেই রেস্টুরেন্টের জন্য এত টাকা লোন নিয়ে জায়গাটা কিনে ফেললাম, বেকারী শপটা তো সাংঘাতিকও কিছু লাভ দেয় না, এত কিছু টানব কি করে…”

“তুমি প্লিজ এতটা ভেঙে পড়ো না, এতদিন যখন চলেছে, এখনও ঠিকই ব্যবস্থা হবে, আমাদের ঠান্ডা মাথায় কিছু একটা উপায় বার করতে হবে, তোমার আর একটা চাকরী না পাওয়া অবধি এত টেনশন করে কোন লাভ নেই”, বলে রিনি শৈবালের হাতে হাত রাখল । রিনির দৃষ্টি বুঝিয়ে দিল ‘পাশে আছি’ । একটু যেন শান্ত হলো, আশ্বস্ত হলো মানুষটা ।

***************

ক্রিসমাসের সময় নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট-এর বারান্দাটা লাল নীল চুনির নরম আলোয় বড় যত্নে সাজিয়েছিল দুটিতে । সেই ব্যালকনিতে চুপচাপ বসে আছে এখন শৈবাল । রিনির শরীরটা ভাল নেই, ডাক্তার মে’তে ডেট দিয়েছে, এখন কোথায় ওকে যত্নে, টেনশন ফ্রি রাখবে, তা না, ধ্যুর । কতক্ষন এভাবে বসেছিল খেয়াল নেই, রাতের এই ব্যস্ত শহরটাকে দেখে নিজের কলকাতার কথা বড্ড মনে পড়ছিল আজ, রিনির খুশির খবরটা বাড়িতে কাউকে জানাতে পারেনি । আগে মা ফোন করত, বাবা একদিন জানতে পারার পর তুমুল অশান্তির পর শৈবাল মানা করেছে, ও না হয় কল করে নেবে । তারপর থেকে হয়তো ১৫ দিনে একদিন মা কে কল করে, মা যদি সুখবরটা জানতে পারে, মা কিছুতেই ওদেরকে একলা ছেড়ে থাকবে না, আবার হয়তো একটা অশান্তি হবে…. এখনো তাই মা জানে না কিছু ।

ছোট থেকেই ওর প্যাশন, ওর ভালবাসাকে দু’জন মানুষ সাপোর্ট করত, এক, ওর মা, দুই, ওর আদরের ঠাম্মি । স্কুল থেকেই ওর মধ্যে দুটো শখ প্রবল, সবাই যখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই বলে রচনা লিখত, ও লিখেছিল লেখক বা শেফ হতে চাই । কারন নিজের ক্রিয়েটিভিটি টাকে এই দুটো জায়গায় আমি তুলে ধরতে পারব নিখুঁত ভাবে । সোজা সাপ্টা রচনাটায় ২০ তে ১৮ পেলেও বাবা, জ্যেঠুরা ভাল ভাবে মেনে নেয়নি এটা । ছোট ছেলের পাগলামো ভেবে উড়িয়েছিল, ওর প্যাশনটা যে তখন থেকেই এভাবে উঁকি দিচ্ছিল মা ছাড়া ঘুনাক্ষরেও কেউ টের পায়নি ।

****************

ওর তখন ক্লাস এইট, রাঙা পিসিরা নবদ্বীপ থেকে আসছে হঠাৎ খবর দিল । মেয়ে জামাই বহুদিন পর বাড়িতে আসছে । যত্ন আত্তির ত্রুটি রাখা যায় না, কিন্তু ঐ প্রচন্ড গরমে মার হাঁসফাঁস অবস্থা, জ্যেঠি গেছে তখন বাপের বাড়ি । তখন ঐটুকু ছেলে পিসিরা আসতেই যেটা ওদের সামনে ধরেছিল, কার প্রাণটা ঐ গরমে জুড়োয়নি? পরে পিসি যখন শুনেছিল দুধ-কুলফিটা ছোট্ট শিবুর বানানো, বিশ্বাস করতে সময় লেগেছিল ওদের ।

ঐ গরমে সামান্য লেবু গোল মরিচ দিয়ে তাক লাগানো মাংস আর তুলতুলে পরোটাটা তো ও একাই করেছিল । সেদিন ছায়াদেবী মানে শিবুর মা-ও বুঝেছিলেন, এ ছেলের এলেম আছে, এ অনেক দূর যাবে । আর পাঁচটা মানুষ যখন গরমে রান্নাঘরে ঢুকতে চাইত না, তখন ঐটুকু ছেলেটা ঘর্মাক্ত অবস্থায় হাসিমুখে একটার পর একটা এক্সপেরিমেন্ট করত | মানুষের রিফ্রেশমেন্ট-এর অনেক রকম শখ থাকে, কলেজ থেকে ফিরে শিবু রিফ্রেশড হতো রান্নাঘরে ঢুকে কিছু বানিয়ে ।

মা ঠাকুমার আদরে আর বাবার চোখের আড়ালে এভাবেই কবে যেন ওর হাতের জাদু হাতযশে পরিণত হয়েছিল, ও নিজেই বোঝেনি । কিন্তু ছেলেকে যে ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে, তাই বাবা দায়িত্ব নিয়ে ‘রাঁধুনি’ ছেলে আর তার বৌকে… যাক গে ।

।।৩।।

রিনির নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়েছিল শৈবাল । আজ খুব মাকে মিস করছে ও, খুব ইচ্ছে করছে মা-র সাথে একটি বার কথা বলতে । মা ঠিক আছে তো? একবার ফোন করবে? এখন এভাবে ফোন করাটা কি…. ।

হায় ভাগ্য ! নিজের মাকে ফোন করতে গেলেও এখন কতবার ভাবতে হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা ও । ফোনে নাম্বারটা ডায়াল করেই ফেলল ।

-“হ্যাঁ বাবু বল, কতদিন পর ফোন করলি, মাকে কী একটুও মনে পড়ে না, হ্যাঁ?”

কিছু বলতে পারছিল না শৈবাল । গলার কষ্টটা দলা পাকিয়ে আটকে ছিল । উগরোতেও পারছিল না, গিলতেও পারছিল না, কথা বললেই মা বুঝে যাবে মা-এর বাবুর কিছু একটা হয়েছে, তাই চুপ করে রইল শিবু ।

-“কীরে, বাবু, কী হয়েছে? বল আমায়, কী হয়েছে তোর?”

কিছুতেই মা-এর সামনে নাটক করতে পারে না শিবু, সেই ছোটবেলা থেকেই, কোনদিন না, “মা, তুমি কেমন আছো?”, এটুকুই বলতে পারল শুধু । ছেলের গলার চাপা যন্ত্রনাটা বুঝতে ছায়াদেবীর কয়েক সেকেন্ডও লাগেনি ।

-“কি হয়েছে বল?”

-“মা, আমার চাকরিটা চলে গেছে ।”

কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছায়াদেবী আবার বললেন,”এত ভাবিস না, চাকরি গেছে আবার পাবি, আমি কি কিছু পাঠাব?”

-“না মা, তোমায় বলেছিলাম না, আমার রেস্টুরেন্টটার জন্য জায়গা কিনেছি, লোন নিয়েছি, সেটা, আর এখন রিনিও প্রেগন্যান্ট, তোমায় বলাও হয়নি, শুধু একটা বেকারী দিয়ে কীভাবে এত কিছু, তারপর সংসারটা টানব বুঝতে পারছি না ।”

-“তুই এত বড় একটা খুশির খবর আমায় এতদিন জানাসনি…”

মা ছেলেটা মান অভিমান, আনন্দ দুঃখের গল্পের পালা চললো কিছুক্ষণ, ঘড়ির কাঁটা কখন দৌড়েছে, কারোরই খেয়াল নেই ।

-“আচ্ছা বাবু, তোর বেকারী শপটা তো বলেছিলি ভালোই চলে ।”

-“ভাল চলে, কিন্তু এতও ভাল নয় যে তা দিয়ে এত কিছু সামলানো সম্ভব ।”

-“দ্যাখ, ঐটা ছাড়া এখন আর কোন রাস্তাও খোলা নেই, তাই এখন ওটাকেই ভাল ভাবে চালানোর চেষ্টা কর, ওটাতেই কনসেনট্রেট কর ।”

-“কিন্তু এত রাতারাতি কীভাবে?”

-“দ্যাখ, তুই বলেছিলি তোরা যেখানে থাকিস, সেখানে একটা বড় বাঙালী কলোনি আছে । তো তুই নতুন কিছু না করলে লোকে বেশী বেশী করে তোর দোকানে আসবে কেন? তুই যেগুলো ভাল পারিস, বেকারির পাশাপাশি স্ন্যাক্স হিসাবে বাঙালি মেনুও রাখ, বাঙালীরাও আসবে । লুচিই রাখ না, দ্যাখ পিলপিল করে লোক আসবে বিদেশ বিভুঁই-এ লুচির স্বাদ পেতে । এখন শীতের মরসুম, বাঙালী মিষ্টি রাখ পাতের শেষে, পিঠে পুলি পায়েসের স্বাদ কে চাইবে না বলতো এই বিদেশে বসে পেতে? পাটিসাপ্টা, দুধপুলি, গোকুল পিঠে, দুধ কমলা, সরু চাকলি, কড়াইশুটির কচুরি এইগুলো তো তুই দারুন বানাতিস, এগুলোই রাখ না ।”

চোখটা চিকচিক করে উঠল শৈবালের । সত্যিই তো, এভাবে তো কখনো ভেবেই দেখেনি, সবসময় কেক, পেস্ট্রি, চকো-ডোনাট বানাতে হবে, তারই কী মানে?

।।৪।।

(কিছুদিন পর)

“এক্সকিউজ মি, এক প্লেট কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুরদম আর এক প্লেট পাটিসাপ্টা ।”

এই নিয়ে আজও ৪৬ নম্বর অর্ডার এলো বাঙালী মেনু থেকে,”আর বোধ হয় এত টেনশন করতে হবে না ।”

হাসিমুখে “ওকে, প্লিজ হ্যাভ এ সিট” বলে নিজের কাজে হাত লাগল শৈবাল ।

***************

(কয়েক বছর পর )

আজ “স্বাগতম বেকারী”-এর আউটলেট বিশ্বের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে, বাঙালী স্ন্যাক্স আর পিঠে পুলি যার অন্যতম ইউএসপি ।

“স্কাইলাইট ইন্টারন্যাশনাল” হোটেলটাও উন্নতির শিখরে তরতর করে উঠছে । বিশ্বের অন্যতম সফল শেফ-এর শিরোপাও আজ সেদিনকার শিবুর পকেটে ।

ম্যাগাজিন-এর কভার পেজে শৈবালের ছবিটা দেখে ছানিপড়া চোখে চশমাটা একটু ঠিক করে নিলেন সমরবাবু, শৈবালের বাবা । থমকে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ, উনি আজ নিজে ভুল প্রমাণিত হয়েও বড় খুশি, অজান্তেই চোখটা ছলছল করছিল, কখন পিছনে ছায়াদেবী এসে দাঁড়িয়েছেন, বুঝতেই পারেননি, স্ত্রীর হাতটা যখন কাঁধে অনুভব করলেন, চোখের জল আর সামলাতে পারলেন না, নিতান্ত শিশুর মতোই নট মস্তকে ভেঙে পড়লেন কান্নায় ।

“শিবুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, একটু ফোন করো, আসতে বলো ।”

শান্তির নিশ্বাস নিলেন আজ বহু বছর পর ছায়াদেবী ।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

হারিয়ে যাওয়া ‘আমি’

।।১।। “এই বেলটা বাজছে, একবার দেখ না, তরকারিটা নামাচ্ছি তো, দেখ রে,আরে এই টুসি, কোন সাড়াশব্দ নেই।” “আরে আমি রেডি হচ্ছি মা, তুমি দেখো।” “উফফ,

Read More »

লজ্জা

লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে চুপচাপ সবার নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে এল রিনি। কিছু আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাদটা ভিজে এখনও, মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ

Read More »

আজ বাঁচুন

আবাসনেরর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই চিৎকার কানে এলো… সিকিউরিটি কে ছুটে যেতে দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ওরা |কিন্তু তারপরই আবাসনের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল যেন চারপাশটা…

Read More »

রদ্যি খবর

“তোকে কতবার আর বলব পুপু, আজ অন্তত দস্যিপনাটা একটু কমা। দেখছিস তো বাড়িতে লোকজন আসবে আজ।” মেয়ে পুপুকে আবার একবার খানিক ধমকে দিলো রাধিকা, বিক্রমপুরের

Read More »

এই বেশ ভালো আছি

।।১।। ট্রাঙ্ক থেকে ন্যাপথালিন দেওয়া গুটি কয়েক তোলা শাড়ি থেকে একটা শাড়ি বের করছিল মায়া । ছোট্ট দু’কামরার ঘরে এককোণে খাট, ছোট্ট আলনা, ট্রাঙ্ক, কুঁজো,

Read More »

Share with