প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো রিয়াকে দেখতে বলে ফোনে কথা বলতে বলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ও।
এই দিনটা সবসময়ই বড় ব্যস্ততায় কাটে অমিতের, সেই কোন বয়স থেকে ,আজ ও তার কোনো অন্যথা হয়নি। পুজো সন্ধ্যার মধ্যে শেষ হলেই সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে , সামনের গ্রামে পৌঁছাতে মিনিট কুড়ি মতো সময় লাগে গাড়িতে। বাচ্ছাগুলো মহানন্দে অপেক্ষা করে বসে থাকে, ও পৌঁছালেই ওদের মুখে সে যে কি হাসি , এক অপরিসীম আনন্দ যা বলে বোঝানো সম্ভব নয় , শুধু উপলব্ধিই করা সম্ভব।
এখন তো রান্নার ঠাকুরই সব করেন , আগে উনি বেঁচে থাকতে উনিই ভোগের সমস্ত রান্নাটা করতেন। এখন আর অত সম্ভব হয় না , আর রান্নার ঠাকুর যথেষ্ট ভালোই কাজ করছেন , হয়ে গেলো প্রায় ৫-৬ বছর অন্তত।
ওর বাড়িতেও নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা কম নয়, তাদের ও দেখা শোনা করবার একটা ব্যাপার আছে , রিয়ার পক্ষে একা সম্ভব হয় না অত। তালের বড়া ও নিজেই করে , জোগাড় সন্ধ্যাদি মালতিদি মিলে করছে , নয়তো এত লোকের জন্য একা হাতে এত তালের বড়া করা সত্যি মুশ্কিল, রিয়া তো আর এসব কাজে পটু নয়।
উনি বেঁচে থাকতে এটা রিয়াকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন বেশ ভালো ভাবেই, একটা তাল, ২ – ৩ টি কাঁঠালি কলা, আধ মালা নারকেল , ২৫০ গ্রাম আটা, ২৫০ গ্রাম চিনি মোটামুটি এই হলো মাপ, তা দিয়ে এমন সুন্দর বড়া সে যেন অমৃত, রিয়াও এখন বেশ ভালোই বানায়। মালতিদিরা নারকেল কুড়তে ব্যস্ত সব রান্নাঘরে, একবার উঁকি দিয়ে দেখে ঘরে এলো অমিত। পুজো না হওয়া অব্দি এখন উপোস, ও শরবতটা খায়, আরেক গ্লাস শরবত বলে আলমারিটা পরিষ্কার করতে বসলো ও।
ও ঠিক করেছে পরের বার শুধু গ্রাম এ খাওয়ানোর জন্য নয়, একেবারে বাড়িতে প্যান্ডেল খাটিয়ে সারা গ্রামকে নেমন্তন্ন করবে এই বাড়িতেই, তাহলে তাদের পুজো দেখাটাও হবে, আনন্দটাই আসল।
অমিত নিজের ব্যবসার কাজে খুব একটা নিজের গ্রামের বাড়িতে আসার সময় পায় না, আর এখন কেউ নেই ও যার কাছে ও আসবে , বছর পাঁচেক আগে উনিও… তাই ও আর ওর স্ত্রী রিয়ার এই ব্রজরাজপুরে আসা খুব একটা হয় না, অনুষ্ঠান ছাড়া। এখন পার্মানেন্ট ঠিকানা কলকাতার গল্ফগ্রিনের সুবিশাল সাজানো ওই ফ্ল্যাটটিই। এই যেমন আবার দুর্গাপুজোর সময় আসবে , কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো অব্দি থাকবে, পুজো, অনুষ্ঠান ভোগের আয়োজন লোকজন খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরে যাবে আবার, আর রোজকার খাওয়ানোর ভার এখন সুজয়দা ভালোই সামলাচ্ছে। সুজয়দা এই গ্রামেরই, রোজ অন্তত ৫০ বাচ্চাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে ওরা , অমিত খরচ পাঠিয়ে দেয়, হিসেব নিকেশ দেখে নেয়, কিন্তু আসল ঝক্কি পোহায় সুজয়দাই। ও শুধু এই পুজোর সময়গুলোয় থাকে। পুজোর সময় নিজের গ্রাম, সামনের গ্রাম মিলিয়ে বহু লোকের সমাগম হয় তাই সুজয়দার পক্ষে একা সামলানো অসম্ভব , আর ওদের আসতে ভালোও লাগে।
*****
আলমারিটা খুলে সবার প্রথম নিজের পুরোনো স্কুলের হাবিজাবি জিনিসে ঠাসা স্টিলের বক্সটার দিকেই নজর গেল ওর, যতবারই এই বাক্সটা খোলে কিছু না কিছু নতুন অনুভব করে ও। প্রতিবার অন্য রকম কিছু , এবার নতুন কি পাবে কে জানে। বাক্সটা খুলে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো ও, একটা পুরোনো মন কেমন করা গন্ধের সাথে ধুপ ধুনো চন্দনের গন্ধ এসে লাগলো নাকে। ওর বন্ধুদের দেওয়া গ্রিটিংস কার্ড গুলো আজ ও সযত্নে রাখা, ওর নিজের হাতে বানানো স্ল্যাম বুক, সেটায় ওর বন্ধুদের কিছু লেখা আর সই, পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া কিছু ফোটোগ্রাফস, ওর লালরঙের পেন্সিল বক্সটা, জ্যামিতি বাক্স আরো কত কি। শেষবার এই বাক্সটা কবে খুলেছিলো মনেও নেই আর ওর, এখন আলমারি খালি করতে হবে মেরামতির জন্য তাই খোলা হলো। একবার খুলে বসে পড়লে অতীতে ছুটে চলা নিজের মনকে বাগে আনা খুব মুশকিল, কোথা দিয়ে সময় গড়িয়ে যাবে বোঝাই যাবে না, তাড়াতড়ি বাক্সটা বন্ধ করতে গেল জিনিসগুলো ঢুকিয়ে , কিছুতেই আটকাচ্ছে না বাক্সটা , কিসে আটকাচ্ছে রে বাবা আবার!
জিনিস গুলো এদিক ওদিক করতে গিয়েই হাতে লাগলো স্টিলের দোতলা তুবড়ে যাওয়া টিফিন কৌটোটা, মুচড়ে উঠলো ওর বুকের ভিতরটা। এই বাক্সটা শুধু একটা বাক্স নয়, এর সাথে যে ওর কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে টা ব্যক্ত করা এত সহজ নয়। সযত্নে বাক্সটার হাতে নিয়ে নিজের চোখটা মুছল অমিত।
এই সেই লাঞ্চ বাক্স, রোজ সাতসকালে উঠে যেটায় করে ওর পছন্দের খাবার করে সযত্নে ওর স্কুলব্যাগে ভরে দিতো মানুষটা, আর রাগে অন্ধ অমিত প্রতিদিন সেটা ডাস্টবিনে ফেলত। খুলেও দেখতো না, যদি দেখতো তাহলে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে ওর এতটা দেরি হতো না। যতক্ষণে বুঝলো ততক্ষণে মানুষটার ক্যান্সার থার্ড স্টেজ।
ওর বেশ মনে আছে, ওর ক্লাসে একটা ছেলে ছিল, সহপাঠী, ওর বন্ধু নয়, নাম হাবিব, গরিব ঘরের ছেলে, ওর মা ছিল না। সে একদিন যখন ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিল নিতান্ত সরলমনে, যে ও রোজ এত খাবার কেন না খেয়ে নষ্ট করে, ফেলে দেয়, তখন সত্যিই ওর কাছে কোনো উত্তর ছিল না। সত্যিই তো, কি জন্য? যে ওর জন্য খাবারটা রান্না করে দেয় সে তো ওর মাই, কিন্তু তাকে তো চিরকাল ও সৎমায়ের চোখেই দেখে এসেছে , সে ওকে সৎছেলের চোখে না দেখলেও!
কিসের রাগ? ওর মায়ের মৃত্যুর পর ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে একজনকে ওর সামনে এনে দাঁড় করিয়ে মা বলে দিলেই কি সে মা হয়ে যায়? তা সে যত চেষ্টাই করুক না কেন , রান্নায় একেবারেই পটু ছিলেন না উনি , কিন্তু অমিতের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতেন, রান্নার ডাইরিতে সেইসব লেখা ওনার মৃত্যুর পর অমিত দেখেছে, আর তখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
কিভাবে অমিতের জন্য এই টিফিনকৌটো নিয়ে ওর পিছনে দৌড়াতে গিয়েই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিলেন, কিংবা ওর পছন্দের কচুবাটা করতে গিয়ে এলার্জিতে সারা হাত ভরিয়েছিলেন , সেসব না হয় অব্যক্তই থাকল। হাবিব বলে ছেলেটা যখন ওকে বলেছিলো ওর টিফিন না ফেলে ওকে দিয়ে দিতে, সেদিন অমিত বুঝেছিল, না অন্ন সবার ঘরে ভরপুর, না মায়ের ভালোবাসা! সেইদিন সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি ও, বার বার একটাই দৃশ্য চোখে ভাসছিল, হাবিব যখন হাসিমুখে তৃপ্তিভরে মুখে রুটি আলুরদম পুরছিল , ও ওর পাশটিতে বসে মন ভরে দেখেছিলো শুধু। তারপর থেকে হাবিবকেই নিজের টিফিনটা মনের আনন্দে দিয়ে দিতো অমিত, আর ও বসতো পাশটিতে। হাবিব যখন ওর মুখেও খাবার তুলে ধরলো একদিন , আর না করতে পারেনি ও। কি স্বাদ , কি গন্ধ , মায়ের হাতের তৈরী বলেই হয়তো এত সুস্বাদু! সেই হাবিব এখন ওর সবথেকে ভালো বন্ধু , বছরে দুবছরে বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে একবার আধবার দেখা হলেও বন্ধুত্ব আজ ও অটুট।
*****
কিন্তু শেষ অব্দি যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার দরকার ছিল, তার কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়া আর হয়ে ওঠেনি অমিতের , আর যখন ক্ষমা চাইতে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন সেই মানুষটা সমস্ত বোধশক্তির গন্ডির বাইরে।
উনি বুঝতে পারতেন অমিত রোজ ওনার হাতের রান্না না খেয়ে ফেলে দিতো, তা ওনার মৃত্যুর পর ওনার ডাইরিতেই অমিত দেখেছিল, নানা অছিলায় ওনার হাতের রান্না না খেয়ে সন্ধ্যাদি মালতীদির হাতের রান্নাতেই পেট ভরাত। বুঝতে পারতেন, তাও কোনোদিন ওর কাছে কিছু জানতে চাইতেন না, উল্টে রোজ একইভাবে যত্ন নিয়ে ওর জন্য টিফিনবাক্স গুছিয়ে যেতেন। কোনো অভিযোগ কোনো এক্সপেকটেশন ছাড়াই। একেই হয়তো মা বলে।
উনি বেঁচে থাকতে খুব একটা মা বলে ডাকতে পারেনি অমিত , বলা ভালো ডাকেনি, কিন্তু আজ…
বাক্সটা বন্ধ করে নিজের সুটকেসের কাছে রাখলো অমিত, এবার কলকাতা নিয়ে চলে যাবে এগুলো।
ওর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে হবে ও জানে না, কিন্তু আজকের এই দিনে যদি মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দিলে কিছুটা পাপ খণ্ডন হয়… আজকের দিনেই শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর কোলে জন্ম নিলেও বড় হয়েছিলেন তো মা যশোদার কোলেই, এটা আগে কেন বুঝল না অমিত? যে মানুষটা ওর জন্য আর নিজের সন্তান অব্দি চাননি, ওকে ভালো ভাবে বড় করে তোলার জন্য, তাকে মা বলে মানতে এত কুন্ঠা কেন ছিল অমিতের মনে?
আজকের দিনের সমস্ত রান্না সব ওই মানুষটার পছন্দের, বেঁচে থাকতে যার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে মাথা ঘামায়নি, সে চলে যেতে তাকে চেনার জানার একমাত্র পথ ছিল তার রান্নার ডাইরিটা। ডাইরিটা অনেক আগেই ও কলকাতা নিয়ে চলে গেছে , এবার এগুলোও সঙ্গে নিয়ে যাবে ও।
“বাসন্তী পোলাওটা কিন্তু বেশি করে বানাবে, ওটা যেন কোনোভাবেই কম না পড়ে , প্রতিটি মানুষ যেন পেট ভরে খেতে পায়।” ফোন এ কথা কটা বলে ফোনটা রেখে ছবিটার সামনে ওঠে দাঁড়াল ও।
ছবির উজ্জ্বল হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, “সরি, … মা।”