ভাগ্যিস

vagyis galpo muktodhara

“টিফিন টা পুরো খাওয়া হয়নি কেন?”স্কুল ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স টা বার করে মেয়ের দিকে রাগতস্বরে চেয়েছিল বৃষ্টি। বৃষ্টি আর বৃষ্টির 10 বছরের ছোট্ট মেয়ে চিনি, এই নিয়ে ই বৃষ্টি-র সংসার।

বিগত কয়েক বছর ধরেই ওরা বাগুইহাটি তে ভাড়া থাকে। বৃষ্টি সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা, সিঙ্গেল মাদার, সুতরাং সন্তান ও সংসার এর সাথে কর্ম জগত ,পুরোটাই একা হাতে সামলাতে হয় তাকে। নিজের জন্য দিনের শেষে যখন একটু সময় পায় তখন ছোট্ট চিনি ঘুমে অচেতন । ওর মাথার কাছে বসে বৃষ্টির মনে তখন একটাই চিন্তা আসে ‘তুই-ই আমার একমাত্র অবলম্বন ,তোর জন্যই এত কিছু, তুই ভাল থাক। অনেক বড় হ’।এভাবেই মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কখন ঘুমে ঢলে পড়ে বৃষ্টি নিজেও জানে না । আবার পরের দিন আরেকটা যুদ্ধের সূচনা ,অস্তিত্বের লড়াই , এভাবে ই ছোট্ট সংসার টা সামলে নিয়ে চলেছে বৃষ্টি।

***************

চিনি তার নিজের বাবাকে চোখে দেখেনি। ওর জন্মের আগেই ওর মা আইনের কাদা মাখতে বাধ্য হয়েছিল ।বেরিয়ে এসেছিল ঐ দত্ত বাড়ি থেকে, এক কাপড়ে ।তারপর অজস্র আইনী জটিলতা আর অনেকটা লড়াইয়ের পর অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে বৃষ্টি।অবশ্য চিনি এসবের কিছুই জানে না। চিনি এর কাছে বৃষ্টি ই ওর বাবা ,বৃষ্টি ই ওর মা।

কোনো রূপকথার গল্প বৃষ্টির জন্য লেখা হয়নি সেটা ও সেদিনই বুঝে গেছিল যেদিন নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলপূর্বক আলোক মানে ওর স্বামীর সাথে মিলিত হতে বাধ্য হয়েছিল আর পরের দিন সকালে গায়ে কাটা দাগ আর কালশিটে গুলো লুকোতে বেশ কটা মিথ্যে আর মেকাপের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তারপর তো সেটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল, তাও সংসারটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি তা নয়।কিন্তু একতরফা চেষ্টা কতদিন ই বা…

“ওমা তাড়াতাড়ি করো না, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো” চিনি-র কথায় টনক নড়লো বৃষ্টির। বৃষ্টি চিনি এর টিফিন তৈরি করছে তো করছে ই, আসলে হুট করে আজকের ডেটটা চোখে পড়তেই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল একটু , অনেক টুকরো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। 28 শে নভেম্বর, এইদিন ই প্রথম বৃষ্টি অনুভব করেছিল চিনির অস্তিত্বের কথা, এক বছরের মাথায়। কিন্তু, তারপর পর ই…

**************

ছোট থেকেই চিনির গলায় যেন সাক্ষাৎ মা সরস্বতী।বৃষ্টি নিজেও জানেনা এমন ভগবান দত্ত গানের গলা চিনির কিভাবে ।ওর বা আলোক এর বংশে সেভাবে গান বাজনার সাথে জড়িত ছিল না কেউ,তাও এত সুন্দর সুরশৈলী যে বৃষ্টি ই মাঝে মাঝে অবাক হয়।ছোট থেকেই চিনি যে কোন সময় যা কিছু বাজিয়ে গান গাইত ওই কচি গলাতে ই, অপরূপ ভাস্কর্য সেই সুরের,বৃষ্টি ই তারপর ওকে গানের স্কুলে ভর্তি করে। আজ সেই গানের স্কুলের দিদি ই বৃষ্টি কে ডেকে পাঠিয়েছে ,চিনির ব্যাপারে কথা বলার জন্য, দেখা যাক।

****************

-“এটা কি বলছেন? আমার একার পক্ষে…”

muktodhara vagyis galpo dwitiyo chobi

-”আপনি একা কেন ?আমরা সবাই আছি। কিন্তু চিনি যে রকম ট্যালেন্টেড ওর এখন থেকেই শুরুটা হওয়া দরকার, অনেক দূর যাবে।”

চিনি বছর বছর গানের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে, সবসময়ই হয়। কিন্তু বছর বছর ওর গান আগের বারের রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে , নিজের গানকে নিজেই ছাপিয়ে যাচ্ছে ও, বছরের পর বছর। এবারও টিচারদের মনে হয়েছে সর্বভারতীয় মঞ্চে গানের প্রতিযোগিতায় এবার ওর নামা উচিত । যে বিখ্যাত শো টার কথা হচ্ছে সেখানে ছোটদেরও প্রবেশাধিকার।সুতরাং এবার চিনি এর জন্য নিজেকে প্রমাণ করার , আরো আরো উপরে ওঠার একটা সুবর্ণ সুযোগ।

আজ অনেক রাত অব্দি জেগে বৃষ্টি, ঘুম আসছে না আজ। আবার একটা খুশির খবর, 28 নভেম্বরেই , কিন্তু এই খুশির খবরই তো বারবার ওর জীবনে একটা প্রলয় নিয়ে এসেছে, ঝড় তুলেছে ওর জীবনে, এবার ও যদি সে রকম হয়?

না, না, ওর চিনি কে কোন কিছুর মূল্যেই হারাতে পারবে না ।ওকে কেন্দ্র করে , বলা ভালো ওকে আশ্রয় করেই বেঁচে আছে বৃষ্টি। কি করবে ও ?রাজি হবে? কিন্তু দিদিরা তো ঠিকই বলছেন, চিনির যা ট্যালেন্ট তার সঠিক মূল্য পাওয়ার অধিকার আছে ওর। সেখানে বৃষ্টি তো বাধা হতে পারেনা। না ও কাল ই কথা বলবে।

**************

“মাম্মাম,কি ভাবছো?”

অন্যমনস্ক বৃষ্টি বুঝতেই পারেনি কখন ছোট্ট চিনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ঘর অন্ধকার । সন্ধ্যে পড়ছে ঘরে ঘরে,এবার উঠতেই হবে,চিনি এসে মা এর কাছে বসলো।

মেয়ে কে কোলে টেনে নিয়ে বৃষ্টি বললো,”মা, তোর ভয় করবে না তো, টিভিতে, অত লোকের সামনে গান গাইতে?”

-”ভয় এর কি আছে, তুমি তো বল মাম্মাম যার মন এ পাপ তার মনে ভয়।”

নিজের স্বভাব সিদ্ধ আধো আধো গলায় নিজের অজান্তেই বড় দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো হেলায় বলে দিল ছোট্ট চিনি ।চোখে-মুখে গলার স্বরে ভয়ের লেশমাত্র নেই।

ভয়ের বদলে যেন চিনির চোখে মুখে উত্তেজনা । সর্বভারতীয় মঞ্চে সর্বসমক্ষে গান গাইতে পারার সম্ভাবনার আনন্দে চোখমুখ ঝলমল করছিল চিনির । সেই উদ্ভাসিত মুখের হাসির আলোয় বৃষ্টির মনের আঁধার হার মানছে ।

কতক্ষন ধরে মা মেয়েতে গল্প করেছে কে জানে, সময় যেন থমকে গেছে সুরের সামনে । মুগ্ধ হয়ে চিনির আর একটা সৃষ্টি শুনছিল বৃষ্টি । চোখ দুটো বুজে, বন্ধ চোখে নোনতা জল কখন উপচে গাল বেয়ে নেমেছে, বুঝতেই পারেনি । হুঁশ ফিরল চিনির কচি হাতের স্পর্শে ।

যেটুকু দ্বিধা মনে ছিল বৃষ্টির আজ সেটুকু ও নিরশন হয়ে গেল, এবার নতুন যুদ্ধের পালা।

(বেশ কিছুদিন পর)

নিজের অসামান্য গলা, সুর মূর্ছনা আর সারল্য য় এতদিনে আপামর জনতা থেকে জাজ সবার মন জয় করে নিয়েছে চিনি , ওর ভালো নাম মেঘলা। এই নামে এই প্রতিযোগিতায় ঢুকলেও সবাই ভালোবেসে ওকে চিনি বলে ই ডাকে। এমনকি টিভি, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন সব জায়গায় এখন চিনির ছবি আর নাম। ওর গানের ভিডিও এখন রীতিমতো ভাইরাল ।এরকম একটা ভিডিও ই অলকের চোখের সামনে এসেছিল, যেদিন চিনি ,ওর মা ,বাড়ি এসবের কথা বলেছিল আর সাথে ছিল চিনির মা বৃষ্টি । অলকের কলিগ ভাস্কর প্রথম চিনির ভিডিও আলোককে দেখায় তার আগে তো চিনি আলোকের মেয়ে সেটাই জানত না ।চিনির অস্তিত্বের কথা আলোক জানত ,আর যেদিন থেকে জানতে পেরেছিল কন্যা সন্তান আসছে চিনি কে শেষ করতে বলতেও মুখে বাঁধেনি আলোকের…

**************

আজ ফাইনাল , ফাইনাল রাউন্ডে চিনি হয় জিতবে নয় হবে রানার্সআপ। কিন্তু আজ পুরো ভারতের মানুষ ছোট চিনির জন্য প্রার্থনা করছে। আজ আলোকও টিভির সামনে, মনে পড়ছিল বারবার সেইদিনটার কথা, যেদিন সব জেনে আলোক, আলোকের মা, বৃষ্টির উপর ঐ অবস্থায় অকথ্য চাপ সৃষ্টি করছিল, শুধু একটা পুত্র সন্তানের আশায় । ঐ অবস্থায় বৃষ্টির গায়ে হাত তুলতেও ছাড়েনি । আর আজ যখন চিনিকে দেখছে, যার চোখ, নাক, মুখ আলোকেরই কার্বন কপি, একটা অসম্ভব টান অনুভব করছে ও, নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে আজ । বৃষ্টি আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে, কোনদিন বৃষ্টিকে ভালবেসেছিল ও? না, ভালবাসলে ঐ অবস্থায় কখনো নিজের স্ত্রীর হাত ছাড়তে পারত না, বাড়ি থেকে চলে যেতে দিতে পারত না ; এভাবে হেলায় ভুলে যেতে পারত না ।

তবে যেদিন থেকে জেনেছে চিনি ওর সন্তান, ওর মধ্যে হয়তো কোন বদল এসেছে, হয়তো বা আসেনি কিন্তু কোন এক অজানা টানে আজ ও টিভির সামনে।

*****************

শুরু হলো প্রতিযোগিতা ।না ,জেতেনি চিনি।কয়েকটা ভোটের জন্য ।চিনির কচি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিযোগিতার এংকার বললেন,” তুমি নিশ্চয়ই পরের বছর জিতবে তবে তুমি যা পেয়েছ সেটাও কম না। নিজেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্টেজে হুইল চেয়ারে বসা ছোট্ট চিনি বলল ,”আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই ।”

নিজের সন্তান ‘কন্যা’, আর ভবিষ্যতে হুইল চেয়ারে বসার ইঙ্গিত টুকু পেয়ে আর পৃথিবীর আলো দেখাতে না চাওয়া আলোকের মাথাটা আজ বড্ড নীচু।বৃষ্টি-র চোখে জল। মেয়েটা কে বাঁচানোর জন্য ওই বাড়ি ছেড়ে ও যা যা করেছে তার একটুও বিফলে যায় নি।

ছোট্ট চিনি তখন হাসি মুখে অনেক প্রাইজ, ভালোবাসা আর আশীর্বাদ কুড়োতে ব্যস্ত…

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

হারিয়ে যাওয়া ‘আমি’

।।১।। “এই বেলটা বাজছে, একবার দেখ না, তরকারিটা নামাচ্ছি তো, দেখ রে,আরে এই টুসি, কোন সাড়াশব্দ নেই।” “আরে আমি রেডি হচ্ছি মা, তুমি দেখো।” “উফফ,

Read More »

লজ্জা

লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে চুপচাপ সবার নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে এল রিনি। কিছু আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাদটা ভিজে এখনও, মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ

Read More »

আজ বাঁচুন

আবাসনেরর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই চিৎকার কানে এলো… সিকিউরিটি কে ছুটে যেতে দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ওরা |কিন্তু তারপরই আবাসনের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল যেন চারপাশটা…

Read More »

রদ্যি খবর

“তোকে কতবার আর বলব পুপু, আজ অন্তত দস্যিপনাটা একটু কমা। দেখছিস তো বাড়িতে লোকজন আসবে আজ।” মেয়ে পুপুকে আবার একবার খানিক ধমকে দিলো রাধিকা, বিক্রমপুরের

Read More »

এই বেশ ভালো আছি

।।১।। ট্রাঙ্ক থেকে ন্যাপথালিন দেওয়া গুটি কয়েক তোলা শাড়ি থেকে একটা শাড়ি বের করছিল মায়া । ছোট্ট দু’কামরার ঘরে এককোণে খাট, ছোট্ট আলনা, ট্রাঙ্ক, কুঁজো,

Read More »

Share with