“মা আমায় আজ আবার বেরতে হবে”,বলেই তড়িঘড়ি উপরে গেলো পিয়ালী রেডি হতে | কোন অনুমতির অপেক্ষা না করেই বৌমার এহেন গমন দেখে খানিক বিরক্ত হয়েই তাকালেন গিরিজা দেবী |
খানিক বাদে পিয়ালীকে এমন হন্তদন্ত হয়ে বেরতে দেখে প্রশ্নটা করেই ফেললেন,”কী ব্যাপারটা কী বৌমা? বাপের বাড়িতে কিছু হয়েছে কী? কিছু বললেও না…”|
গিরিজা দেবীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই পিয়ালী বলল,”এসে সব বলছি মা, এখন না, প্লিজ, বেরলাম |’
পিয়ালী দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই ভ্রু কুঁচকে বারান্দা দিয়ে দেখতে দেখতে গিরিজা দেবী ভাবছিলেন, ‘কী একেবারে হলো, কিছু বলারও প্রয়োজন বোধ করল না |’, খানিক দাঁড়িয়ে উনি নিজের কাজে মন দিলেন |
||২||
(রাত ১০.০০)
বাড়িতে থমথমে পরিবেশ | বাড়ির বৌমা এখন বাড়িতে না ফেরায় শ্বশুর মশাই, শাশুড়ি মা, স্বামী সবারই কপালে ভাঁজ, ফোনটাও ধরছে না | ভাবতে ভাবতেই বেলটা বাজল, দরজা খুলতেই স্বাভাবিক ভাবেই অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হলো পিয়ালী | বিধ্বস্ত পিয়ালী উত্তর দিতে যাবে তার আগেই নানা দিক থেকে প্রশ্ন আসতে শুরু করল, তো আর উত্তর দেয় কার সাধ্যি |
অনেক প্রশ্নের ভিড় পেরিয়ে অবশেষে পিয়ালী বলল,”আরে নিউজগুলো দেখো, বিহুর কাছেই গেছলাম “, স্বামী সৌগতর দিকে তাকিয়ে | পিয়ালীর কথা শুনতেই সৌগতর খেয়াল পড়ল, আরে হ্যাঁ, বিহু তো পিয়ালীর খুবই কাছের বন্ধু | পিয়ালীর বন্ধু বিহুই যে রেপটা হয়েছে সেই কেসের মেয়েটা, কথাটা চোখের সামনে পরিষ্কার হতেই সৌগতর মুখের ভাব ভঙ্গিই পালটে গেল, যেন গুরুতর একটা অপরাধ করে ফিরেছে পিয়ালী |
-“তোমার লজ্জা করে না, তুমি কাউকে না বলে বিহুর কাছে চলে গেলে?”
-“ও আমার বন্ধু সৌগত, আমি এই সময় যাব না? কী ধরনের কথা বলছি তুমি?”
-“না যাবে না, তোমায় এখন এই বাড়ির সম্মানের কথাটাও ভাবতে হবে, লোকে কী বলবে?”
কথাবার্তা শুনে পিয়ালীর শ্বশুর শাশুড়ি এতক্ষনে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করলেন, তারপরই বাক্যবাণ শুরু হওয়া সময়ের অপেক্ষা | কিছুক্ষন পর ক্লান্ত, শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত পিয়ালী নিজের ঘরে ঢোকার সুযোগ পেল |
ডাইনিং টেবিলে সেদিন থালা, বাটি, চামচের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই | কাঁচের ঠোকা ঠুকিগুলো যেন বড় বেশি করে সংসারের মধ্যে তৈরি হওয়া অদৃশ্য দেওয়াল গুলোর কথা আরও বেশি করে জানান দিচ্ছিল |
***************
অনেক রাত অবধি বারান্দায় চুপ চাপ বসেছিল পিয়ালী, আশপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক, স্ট্রিট লাইট আর একলা আকাশ এর তারাগুলো জেগে ওর সাথে | কত রাত খেয়াল নেই…অনেকগুলো এলোমেলো চিন্তা আজ ওর মনে ঝড় তুলেছে, আকাশেও বিদ্যুতের ঝলকানি, ঝড় উঠবে উঠবে করছে | হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াজ, “কী গো বৌদি, এত রাতে এখানে?”
বুবাই-এর রাত অবধি ডিউটি ছিল, এই এতক্ষনে একটু আগে ফিরেছে | অশান্তির সময় বুবাই বাড়ি ছিল না তাই কিছু শোনেনি, ঐ জন্যই একটু আগের হয়ে যাওয়া ঝড়ের কোনো আভাস এখনো পায়নি |
বুবাই বসল ওর বৌদির পাশে, এই বাড়িতে পিয়ালীর বন্ধু বলতে বুবাই, মানে এই দেওরই তাও ওকে বোঝে বা ওর সাথে ওর মানসিকতাটা মেলে | পিয়ালীর মনটা অশান্তই ছিল, ভাঙতে বেশি সময় নিল না | সবটুকু পিয়ালীর থেকে জেনে বুবাইও হতবাক | এইরকম একটা পরিস্থিতে বন্ধুর পাশে না দাঁড়িয়ে মান সম্মানের কথা ভাবে কী করে সুস্থ একটা মানুষ? রাত বাড়তে লাগল… ওদের কথাও ফুরোল তখনকার মতো, শুধু শেষ হলো না ঘটনাটা, ভগবানের চিন্তা আরও কিছু ছিল |
||৩||
(কয়েক বছর পর )
“তিতলি তুমি চুলটা বেঁধে নাও সোনা, স্কুলে দেরী হয়ে যাবে তো |” সকাল থেকে পিয়ালীর এই রুটিন, তিতলিকে ঘুম থেকে তোলা, ওকে স্নান করানো, খাওয়ানো, রেডি করা, সব শেষে ওকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে একটু সময় পেলে নিজের দিকে একবার তাকানো , মাঝে মাঝে ঘরের আয়নাটাও বলে যেন,”বাবা! এতদিন পর”, নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে পিয়ালী | ওর জীবন নিয়ে ও কী কী ভেবেছিল আর আজ কী হয়েছে বা হচ্ছে ওর জীবনে, সেটার হিসেবে করতে বসলে একটাই কথা মাথায় আসে, এটার জন্য কী ওই দায়ী নয়? ও নিজে যদি আজ একটু কিছু বলার ক্ষমতা রাখত, তাহলে হয়তো…|
শ্বশুরবাড়ির অনিচ্ছার জন্য চাকরি করার ইচ্ছা টুকুও জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছিল পিয়ালী, যে সৌগতকে ভালবেসে এত কিছু এখন সেই সৌগত আর ওর মধ্যেই যেন কয়েকশো যোজন দূরত্ব | টেবিল থেকে ওদের বিয়ের বাঁধানো ছবিটা মুছতে মুছতে পিয়ালী ভাবছিলো, ‘চিনতে এত ভুল হলো তোমায়? ভেবেছিলাম একসাথে পথ চলবো, তুমি তো পাশেও থাকলে না |’
হঠাৎ জানলা দিয়ে তাকিয়ে আচমকা তাল কাটলো পিয়ালীর, ট্যাক্সিতে করে একজন মহিলা এলেন, কেমন বিহুর মতো দেখতে না? ট্যাক্সিটা দ্রুত গতিতে পেরিয়ে গেল তাই আর বোঝা হলো না পিয়ালীর | ঐ ঘটনার পর থেকে বিহুর সাথে কোনও রকম যোগাযোগ নেই, বন্ধুত্ব ভাঙতে একরকম বাধ্যই হয়েছিল পিয়ালী | নিজের এত কাছের বন্ধুর ওরকম একটা সময়েও ওর সাথে যা ব্যবহার করলো, বিহু কোনদিনও আর ওকে ক্ষমা করবে? ক্ষমা না করাই তো উচিত, ভাবনায় দাঁড়ি টেনে নিজের কাজে মন দিল পিয়ালী |
এখন বুবাইও ট্রান্সফার হয়ে কলকাতার বাইরে, ঐ একমাত্র বন্ধুছিল প্রকৃত অর্থে পিয়ালীর, এই বাড়িতে, ফোনে আর কত কথা হয় ?
সামনের দিকে বোস কাকুদের বাড়িতে মনে হয় নতুন কেউ এলো, অনেক ব্যাগ ব্যাগেজ,দেখতে দেখতে বারান্দা থেকে জামা কাপড় নিয়ে ঘরে চলে গেল পিয়ালী |
******************
(কিছুদিন পর)
-“হ্যাঁ হ্যালো বৌদি, গেস হোয়াট?”
বেশ অবাক হয়েই পিয়ালী জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছে বলতো?”
-“আমার পোস্টিং কলকাতা হয়ে গেছে | আমি নেক্সট উইক কলকাতা ব্যাক করছি | আবার আড্ডা হবে, দাও ফোনটা মা কে দাও |”
শাশুড়ি মাকে ফোনটা দিয়ে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল পিয়ালী |বুবাই এর সাথেই কথা হচ্ছিলো ফোন এ যাক বাবা, দমবন্ধ করা বাড়ির পরিবেশটা অন্তত ঠিক হবে |
***************
বাজার থেকে ফিরছিল পিয়ালী, ফলের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতেই পরিচিত একটা গলা কানে এল | ফিরে তাকাতেই দেখে…………বিহু | নাহ, কোন চোখের ভুল নয়, ওদের পাড়ার বাজারেই বিহু দাঁড়িয়ে দর দাম করে ফল কিনছে | তার মানে বিহু ওদের পাড়াতেই বাড়ি নিয়েছে !
একমুহূর্তের জন্য বিহুকে দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল পিয়ালীর, পরক্ষণেই মুখের হাসিটা ম্লান হয়ে গেল এটা ভেবে যে কী বলবে বিহুর সামনে গিয়ে ? আর যাবেই বা কিভাবে? ওর কী দাঁড়ানোর মুখ আছে আর… অনেক ভেবে চিন্তে ফিরেই গেল পিয়ালী, পারেনি দাঁড়াতে বিহুর সামনে |
||৪||
-“তোমায় আর একপিস মাছ দি দাঁড়াও |”
-“আর না বৌদি, আর পারছি না |”
বহুদিন পর বুবাই বাড়ি ফিরেছে, মা, বৌদি মিলে বুবাইকে পছন্দের খাবার খাওয়াতেই ব্যস্ত |
খাবার পর বুবাই ছোট্ট তিতলিকে নিয়ে খেলতে ব্যস্ত ছিল | পিয়ালী পাশে বসে গল্প করছিল | হঠাৎ, বুবাই-এর ফোনে রিং হতেই চোখ গেল পিয়ালীর, তাকাতেই বুবাই ঝট করে ফোনটা নিয়ে উঠে গেল | ঐ মুহূর্তের মধ্যেই পিয়ালী দেখতে পেয়েছিল নামটা…’বিহু’ | কী হচ্ছে কিছুই এবার মাথায় ঢুকছে না পিয়ালীর | আচ্ছা বিহু তো অন্য কোন মেয়ের নামও হতে পারে রে বাবা, আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতেই বুবাই ঘরে চলে এল | কথায় কথায় ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেলো তখনকার মত |
****************
মার্কেট থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরতে বেরতেই ব্যাপারটা দেখল পিয়ালী | নাহ, এবার ওর কোন ভুল হয়নি, বিহু আর বুবাই একসাথে, একটা ক্যাবে উঠল | প্রথমে অবাক হলেও আসতে আসতে পুরোটা সাজিয়ে বুঝে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি |
বাড়ি ফিরে একলা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল পিয়ালী, চোখ বুজে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলো | ওর এখন আনন্দ করা উচিত নাকি দুঃখ? ওর এত কাছের দুজন মানুষ আজ একসাথে, এতো আনন্দের কথা, কিন্তু এদের এই একসাথে থাকাটা ক’জন মানবে? মানবে এই বাড়ি? মানবে এই সমাজ? আর এই সমাজবদ্ধ জীব আমরা, তো সমাজে মুখ দেখাব কী করে, আর লোক কী বলবে, ভাবতে ভাবতেই অর্ধেক জীবন পার করে দিলাম | চোখ বুজে ভাবতে ভাবতেই পিয়ালীর হঠাৎ মনে হলো যদি সত্যিই বুবাই আর বিহুর মধ্যে কোন সম্পর্ক তৈরি হয়ে থাকে, ওদের দুজনের ভাল থাকার জন্য এবার অন্তত পিয়ালী মুখটা খুলবে | তবে তার আগে একবার আসল ব্যাপারটা বুবাই-এর থেকে জানতে হবে |
||৫||
বিহুর সাথে কী একবার দেখা করবে? কী বলবে ওকে ও? এরকমই অজস্র চিন্তা মাথায় তাল গোল পাকাতে পাকাতে অবশেষে খোঁজ করে বিহুর বাড়ির দরজার বেলটা বাজাল পিয়ালী | কিছুক্ষন পর দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল বিহু |
……………….. আজ কতদিন পর দেখা দুজনের! সেই পিয়ালীর বিয়ের পর ঐ ঘটনাটা হলো, ব্যস | বিহু জানতও না এখানেই পিয়ালীর শ্বশুরবাড়ি | স্বভাবতই পিয়ালীকে দেখে বিহু কিছুই বলতে পারল না, না তো পিয়ালী | নৈঃশব্দ বিরাজ করছে একসময়ের পরম প্রিয় দুই বন্ধুর মাঝখানে | বিহুর চোখে একরাশ ধিক্কার, পিয়ালীর চোখে জল | কিছুক্ষন পর পিয়ালীই বলল,”ভিতরে আসতে বলবি না?”
সম্বিত ফিরল বিহুর, চোখ নামিয়ে ভিতরে আসতে আহ্বান জানাল, তবে কিছু বলল না | পিয়ালী চুপচাপ ঢুকে রইল | ছোট্ট-র মধ্যে ছিমছাম, সুন্দর করে সাজান ঘরটা, চারপাশটা দেখতে দেখতেই বিহু বলল,”বল কী মনে করে?তুই এখানে?”
পিয়ালী কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না, কোনমতে বলল,”কেমন আছিস?”
বিহু কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে,”ভালই, হঠাৎ এতদিন পর এইটা জিজ্ঞেস করতে এলি?”
পিয়ালী জানতই, এগুলো শুনতেই হবে ওকে, এগুলোই ওর প্রাপ্য | ও আর কোন ভনিতা না করে সরাসরি বলল,”আমায় প্লিজ ক্ষমা কর বিহু, প্লিজ”, বলেই বিহুর হাতটা ধরল পিয়ালী |
বিহু এরকম কিছু আশা করেনি, ওর মুখের অভিব্যক্তিও সেই কথাই জানান দিল |
পিয়ালী আবার বলল,”আমি জানি, আমি ভুল করেছি, কিন্তু আমার অবস্থাটা তুই যদি জানতিস তাহলে…”|
বিহু পিয়ালীকে শেষ করতে না দিয়েই প্রশ্ন করল,”আজ এতদিন পর হঠাৎ এসব কেন বলছিস বলতো? আমি আর সেসব মনে রাখতেও চাই না |”
পিয়ালী নিজেকে সামলে বলল,”কারণ আছে বলার, সেদিন যেটা করতে পারিনি, যে কারণে আমাদের মধ্যে এত দূরত্ব, আমি এবার সেটাই করব |”
বিহু-“মানে?”
“তোকে আর বুবাইকে আমি একসাথে দেখেছি, বুবাই মানে সুগত |”, বলে খানিকটা বিরতি নিল পিয়ালী |
বিহু-“তুই সুগতকে চিনলি কী ভাবে?”
পিয়ালী-“সুগতকে চিনব না? ও আমার নিজের দেওর হয় |”
কথাটা শুনে যেন বিহুর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল | বলল,”সুগতর দাদা বৌদি আছে জানি, কিন্তু সেটা তুই-ই এটা জানতাম না |”
-“বুবাই আমায় কিছু বলেনি, তুই কিন্তু ওকে ভুল বুঝিস না, ও খুব ভাল | আমার শ্বশুরবাড়ির বাকি লোকেদের মতন না ও, তুই প্লিজ ওকে…”, কথাটা বলতে বলতেই থামল পিয়ালী |
বিহুর মুখটা ফ্যাকাসে, হয়তো আবার একটা ঝড়ের আশঙ্কায় |
পিয়ালী আবার ওর হাতটা ধরে বলল,”তুই কিচ্ছু ভাবিস না, আমি তখন তোর পাশে থাকতে পারিনি, কিন্তু এবারে তা হবে না | এবারে থাকব আমি তোদের সাথে | তখনও হয়তো গলার আওয়াজ তুললে পারতাম তোর পাশে থাকতে | কিন্তু না, এবার আর না, তুই শুধু আমায় ক্ষমা কর | বন্ধু হয়ে অসময়ে আমি থাকতে পারিনি তোর পাশে, সেই অনুতাপে অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছি |”
বিহুর চোখে জল, বহুদিন পর হারিয়ে যাওয়া প্রাণের বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে |
শুরু হলো দুই সখীর প্রাণের গল্প, শেষ হলো মান অভিমানের পালা | প্রাণের বন্ধু যাই করুক কতক্ষণ রাগ করে থাকা যায় তার ওপর? অনেকক্ষণ কথার পর পিয়ালীর খেয়াল পড়ল আরে তিতলিকে আজ আনতে যেতে হবে যে | আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়ল পিয়ালী | অনেকটা হালকা লাগছে আজ মনটা ওর |
||৬||
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমি সব জানি, বিহু তোমায় ঠিকই বলেছে”, বুবাই-এর প্রশ্নের উত্তরে বলল পিয়ালী,”এতদিন ধরে চলছে, আর বৌদিকে একবার জানানো গেল না? আমি কিন্তু এটা এক্সপেক্ট করিনি তোমার থেকে |”
-“আরে তোমায় বলতামই, ইনফ্যাক্ট তোমাকেই আগে জানাতাম | জানোই তো, মা বাবা কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে | এবারে আমার আর বিহুর বিয়েটা তোমাকেই বলতে হবে, রাজী করাতে হবে, তুমি ছাড়া আর কাকে বলব?”
পিয়ালী বলল, “আমি সবসময় আমার দুই বন্ধুর পাশে আছি |”
****************
(দু’দিন পর)
গোটা ড্রয়িং রুমের পরিবেশটা থমথমে গুমোট , যেন একটা সুতো নড়বারও অনুমতি নেই এখানে | ঝড়ের আগে আকাশটা যেমন গুমোট থাকে তেমন |
শ্বশুর মশাই-ই অবশেষে মুখ খুললেন,”তোমায় আমি বুদ্ধিমান ভাবতাম বুবাই, তুমি এধরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছ আমি তো ভাবতেই পারছি না | যাকগে , আমি তালতলায় পাত্রী পছন্দ করে নিয়েছি,আমাদের পাল্টি ঘর, এসব ভুল ভাল চিন্তা বের করে দাও মাথা থেকে | কোন লাভ নেই এসব ভেবে |” শ্বশুর মশাই নিজের সমন জারি করে দিলেন |
অন্য সময় হলে পিয়ালী মেনে নিতো চুপচাপ, মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকে যেত, কিন্তু আবারও একই কাজ করবে না ও, ওর জীবনের দু’জন প্রিয় মানুষ বিনা দোষে আলাদা হয়ে যাবে আর ও সেটা অন্যায় জেনেও আবারও মেনে নেবে তা হয় না |”বাবা বিহুর ব্যাপারে সবটুকু জেনেই তো বুবাই এগিয়েছে, তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? বিহুকে বিয়েটা তো বুবাই করবে, তাহলে ওর যখন অসুবিধা নেই…”|
পিয়ালীর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই শ্বশুর মশাই এমন ভাবে তাকালেন যেন পিয়ালীর কথা বলার কোন যোগ্যতাই নেই এই বাড়িতে | সৌগতও রীতিমত লজ্জিত পিয়ালীর এরকম কথাবার্তা শুনে, পারলে এখুনি ভস্ম করে দেয় |
“বৌমা, কাকে কী বলতে হয় ভুলে গেছ তুমি, যাও এখান থেকে |” ঝাঁঝিয়ে উঠলেন শাশুড়িমা |
“না মা, বলা অনেক আগেই উচিত ছিল, বললে এতগুলো বছর অপরাধী হয়ে কাটাতে হতো না আমায় এভাবে, নিজের প্রিয় বন্ধুকে দুঃসময়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম, এটা কী একটা বন্ধুর কাজ? আপনি তো একজন মেয়ে, ঐ ঘটনাটায় বিহুর কী অপরাধ ছিল যে আমরা সবসময় একজন ধর্ষিতাকেই একঘরে করি , ধর্ষককে নয় | জিনিসটা তো উল্টো হওয়া উচিত ছিল, তাই না? ধর্ষককে বাঁচানোর জন্য আইনজীবীও পাওয়া যায়, আর যার পাশে থাকার কথা থাকলাম না, নাক সিঁটকোলাম , ১৪ টা দোষ খুঁজে বার করলাম, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট বানালাম | হ্যাঁ পাশে থাকে না সমাজ সেটা ভুল, থাকে, সেটা যখন ধর্ষক খুন করে তখন | ও তো বেঁচে আছে না? এখন ভালও আছে | তাই কাউকে পাশেও পায়নি | মরে গেলে আহা, উহু, মোমবাতি মিছিল এগুলো যেমন হয় ঠিকই হতো, তাই না মা?” একটানা বলে থামল পিয়ালী |
বুবাই পিয়ালীর কাঁধে হাত রাখল, পিয়ালী তাকাল সৌগতর দিকে, ওর চোখ নীচু, ঘরে বাকী দুটো মানুষেরও আর কোন বুলি বেঁচে নেই মুখে |
“এত কিছুর পরও বলব বিহু লাকি কারণ ও বুবাই-এর মতো একজন জীবন সঙ্গী পেতে চলেছে, আমার মতন অবস্থা ওর নয়|” ঘরে চলে গেল পিয়ালী, চোখের কোণের জলের কুচিটা দ্রুত ছুঁড়ে ফেলে দিল হাতের আঙ্গুল দিয়ে | তিতলি ঘুমে কাদা, তিতলির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ভাবল পিয়ালী,”তৈরি হ, তোকেও অনেক লড়তে হবে রে মা, তৈরি হ |”