।।৫।।
মানুষের সময় সবসময় একরকম যায় না। আর কথাতেই আছে, সুখ ক্ষণস্থায়ী। বাবাই-এর জীবনটাও তাই। বাবার রিটায়ারমেন্টের পর ওর উপার্জনে যেই সংসারটা একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিল তখনই এরকম হতে হলো?
দেশজুড়ে এই রিসেশন-এর সময়ে হাজার হাজার মানুষের চাকরী যাচ্ছে। বাবাই-ও তাদের মধ্যে একজন। ওর চাকরীটা যে চলে গেছে বলবে কীভাবে বাড়িতে? সবে মা একটু একটু করে সংসারটা সুন্দর করে সাজাচ্ছিল, তখনই এমন হতে হলো। বহুদিন হলো ওদের ঘরদোর রঙ-ও হয়নি। ঘর সারানোর সময় বাবা যা করার করিয়েছিল, তারপর আর বাবার পক্ষে ঘরদোর-এ রঙ করার ক্ষমতা হয়নি। চাকরীটা পাবার পর এবছর ঘরদোর রঙ করানো হলো। আর তারপরই।।।।। ওর তো সামনেই বিয়ে। ওর তো মাথাতেই আসছে না এবার।।।। কী করবে? কী বলবে? কাকেই বা বলবে?
এই দুঃসময়ে অভীকের কথাই সবার আগে মনে পড়ল ওর। কিন্তু, অভীক চাকরী ছেড়ে দিয়েছে বেশ ক’দিন হলো, স্টার্টআপ শুরু করেছে। ওই হয়তো কোন হেল্প করতে পারে। ওর নিজের একটা ছোট অফিসও করেছে নাকী বাড়ির নীচে। পিছনে একটা স্ট্রং সাপোর্ট আছে সেই জন্যই এত তাড়াতাড়ি এতটা করতে পারল ও। আর বাবাই-এর তো এখন আবার সেই কলেজের অবস্থা। ভাড়ার টাকা বাঁচানোর জন্য যেমন হেঁটে হেঁটে যেত সব জায়গায় পড়তে, তাই।
আজ ট্রেনে শিয়ালদা স্টেশনে নেমে তারপর হাঁটা লাগল শোভাবাজার অবধি।
অভীকের অফিসে যখন পৌঁছাল তখন সূর্য মাথার উপর, বেলা প্রায় ১১:৩০টা। বাড়ীতে এখনও কিছুই বলেনি, রোজ অফিসের নাম করে এদিক ওদিক অফিসে-টফিসে ইন্টারভিউ দিতে যায় এখন, বেকার তাই আর টিফিন খেয়ে টাকা নষ্ট করে না, বাড়ীতে গিয়ে বেশী খিদে পেয়েছে বলতেও পারে না, পাছে মা সন্দেহ করে।
চলতে চলতেই পৌঁছে গেল অভীকের বাড়ি, নীচেই অফিসটা, বেড়ে বানিয়েছে তো অফিসটা।অভীককে ফোন করা ছিল আগে থেকেই।
অভীকই বেরিয়ে এল, ছোট্টর মধ্যে ছিমছাম সুন্দর অফিসটা। বেশ গুছিয়েছে, কোণে মানিপ্ল্যান্ট, অ্যাকুয়ারিয়াম রেখেছে, কাচের টেবিল, সিস্টেম, সৌখিন পর্দা, এসি, এল ই ডি লাইট সবমিলিয়ে বেশ ভালই। চেয়ারটা টেনে বসল বাবাই। উফফ, বাইরে যা গরম। দু গ্লাস জল ঢকঢক করে গলায় ঢেলে একটু শান্ত হলো বাবাই। অভীক উল্টো দিকে চেয়ার টেনে বলল,”বল এবার।”
**************
বাবাই বাড়ী ফিরে এসেছে আজ বিকেল ৪:৩০টা নাগাদই। এই রোদে আর ঘোরাঘুরি পোষাচ্ছিল না, আর ওর মনের অবস্থাও ঠিক নেই আজ। কাকে বিশ্বাস করবে ও? অভীক যে এরকম করতে পারে, ওর ধারণার বাইরে। ছি ছি ছি, একে বন্ধু বলতো ও? মানুষ চিনতে এত ভুল করলো কী করে ও?
বাড়ী ফিরে না হয় আজ শরীর খারাপ তাই চলে এসছে বলে দেবে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে বেলটা বাজাল বাবাই।
দরজা খুলেই বিনতাদেবী ছেলেকে প্রশ্ন করতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু, বাবাই কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে চলে গেল,”আজ এত তাড়াতাড়ি…অফিস…।”
-“শরীরটা আজ ভাল নেই মা, আমি একটু রেস্ট নেব।”
-“তোকে ফোন করেছিলাম…।”
-” ও, শুনতে পাইনি, সাইলেন্ট ছিল”, বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল বাবাই।
***************
সন্ধ্যে নামছে, মা বাইরে সন্ধ্যে দিল, বাবাই চুপ করে শুয়েই ছিল, মা আর আজ ডাকেনি, খিদেয় পেটটা চোঁ চোঁ করছে। তার মধ্যে রোদে ঘুরে মাথাটা যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে আজ। তার মধ্যে…।
***************
“আজ ইলিশের দামটা এইবারে একটু কম ছিল, তাই কিনতে পারলাম, ছেলেটাকে রাত্রে দিও” সুবিনয়বাবু ফিরে চটি খুলতে খুলতে বললেন কথাগুলো, “চা দাও গো, আজ একটু সিঙ্গাড়া এনেছি।”
রোজ বিকেলে সুবিনয়বাবু একটু হাঁটতে বেরোন, হেঁটে ফেরার পথে আজ একটু সাধ হলো, নিয়ে এলেন। ছেলের খরচটা একটু কম হয় যাতে, তাই এইবারে এই প্রথম ইলিশ কিনলেন। নয়তো ইলিশ-এর যা আকাশ ছোঁয়া দাম সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে।
“ডাকো ছেলেটাকে, ওর জন্যই আরো আনলাম সিঙ্গাড়া, ওর জন্য পনিরের চপও এনেছি, ডাকো।” বলে চেয়ারটায় বসলেন সুবিনয়বাবু।
**************
অভীকের বিজনেসটা মূলত অনলাইন-এ বিভিন্ন সাইট, ওয়েব পেজ ব্লগ মেন্টেন করার উপর, ক্লায়েন্ট-এর থেকে তার ভিত্তিতে টাকা পায়, ব্যাকলগ-এর কাজ, অপটিমাইজেশন, ট্র্যাফিক কীভাবে বাড়বে একটা সাইটে এসব-এর কাজই করে ও। অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল আজ ও। বাবাই-এর লেখাগুলোর উপর ওর নজর বরাবর, বাবাইকে বারবার বলেও কোনদিন রাজী করাতে পারেনি, কারণ রাজী হয়ে লাভ নেই, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখাগুলো আনার জন্য বা দুই মলাটের মাঝে প্রকাশ করার মত সাধ্য, সাহস, কন্ট্যাক্টস, টেকনিক্যাল জ্ঞান কোনটাই নেই। শুধু ভাল লিখে কী হবে আর? আজ সেই অভীকই চায় এই সমস্ত লেখাগুলো যেন বাবাই ওর হাতে তুলে দেয়, চাকরির কোন খোঁজ নেই ওর কাছে, কিন্তু বাবাই-এর লেখাগুলো যদি দেয় বাবাই তাহলে কিছু একটা হতে পারে। তার পরিবর্তে বেশ কিছু টাকা ও বাবাইকে দেবে, বাকী লাভটা ওর, ও সেগুলো নিয়ে যা করার করবে, সেটা ওর ভাবনা।
মানে, ও, বাবাই-এর লেখাগুলো কিনে নিতে চায়, আর কোন অধিকার থাকবে না বাবাই-এর নিজের লেখার উপর, নিজের সৃষ্টির উপর।
এরকম লোভী, স্বার্থপর মানুষকেই ও বন্ধু ভেবেছিল। উঠে বেরিয়ে এসছে ও। চাকরিই খুঁজবে, ঠিক একটা জুটিয়ে নেবে কিছু। আজ তিতলির সাথে দেখা করার কথা ছিল, একবার বেরিয়ে ওর বাড়ী যাবে ভাবছে, কাউকে না বললে তো ও পাগল হয়ে যাচ্ছে চিন্তায় চিন্তায়। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য আদৌ তৈরী ছিল না বাবাই, কিন্তু তিতলির বয়স হয়ে যাচ্ছে, ওর বাড়ী আর বেশী দিন অপেক্ষা করতে পারবে না, সামনের বছর বিয়ের দিনও ফিক্সড হয়ে গেছে, আর ক’দিন পর বাড়ী বুকিং-এর টাকাটা দেওয়ার কথা, কীভাবে সামলাবে ও এত কিছু? বিয়েটা কী পিছিয়ে দিতে বলবে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না আর।
।।৬।।
(বেশ কয়েকদিন পর)
-“কাল রাত থেকে বাবার শরীরটা ভীষণ অসুস্থ, এখন টাকার ভীষণ দরকার, এখনও কোন চাকরী জোটাতে পারেনি, এই লেখাগুলো দিয়ে যদি কিছু হয় দ্যাখ, আর এখন কিছু টাকা পেলে।।।।”
-“তোকে তো আগেই আমি ভাল অফারই দিয়েছিলাম, বেকার বেকার এত দেরী করলি।” বলতে বলতেই বাবাই-এর থেকে ব্যাগভর্তি কাগজগুলো নিয়ে নিলো অভীক, “দ্যাখ তোর যা লেখা, এটার পিছনে ঠিকঠাক প্ল্যান নিয়ে এগোলে ভালই ট্র্যাফিক পাবো, ভালই টাকা আসবে, চিন্তা করিস না, একটা পার্সেন্টেজ আমি তোকে।।।”
অভীকের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বাবাই বলল,”প্লিজ, এত কথা ভাল লাগছে না শুনতে, তুই যা করবি কর, আমায় টাকাটা দিয়ে দে, বাড়ীতে গিয়ে বাবার…। যাইহোক, তাড়াতাড়ি কর।”
অভীক আর বেশী কথা বাড়াল না, কথামতো টাকা দিয়ে দিল বাবাই-এর হাতে, টাকাটা নিয়ে বাবাই বলল, “তোর এই ব্যবহার আমি কোনদিনও ভুলব না, আমায় আর কোনদিন ফোন করিস না।”
অভীক বাবাই-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশ, ভেবে বললি তো?”
-“এত ভেবে এর আগে কখনো কিছু বলিনি বিশ্বাস কর, চললাম।”
অভীকের অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা লাগলো বাবাই বাড়ির দিকে। ঘেন্না করছে ওর। বাবাকে সুস্থ করে তোলা ছাড়া ওর সামনে আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিচ্ছু না।
*************
(মাস আটেক পর)
বাবার গলব্লাডার অপারেশনের পর এখন বাবা অনেকটাই সুস্থ। বাবাই একটা ছোট ফার্মে ঢুকেছে এই মাস তিনেক। মাইনে টা একটু কম আগেরটার থেকে, কিন্তু বাড়ির কাছেই। যাতায়াতের টাকাটা বেঁচে যায় তাই। তিতলিদের বাড়ি যে বুঝেছে এটাই বড় ব্যাপার।2 মাস পিছিয়েছে ওরা বিয়ে টা, যা টাকা পায় তাতে এখন আর খুব বেশী শখ শৌখিনতা করার সুযোগ নেই ওর, যদিও আগেই কত ছিল? অফিস থেকে সোজা বাড়িই ফেরে এখন, বিয়ের জন্য অনেকটা খরচ এখন সামনে, একটা পার্সোনাল লোনও নিতে বাধ্য হয়েছে ও।
বাবার ওষুধটা কিনতে একটু ঘুরপথে যেতে হয়, ওষুধটা কিনেই ফিরছিল ও। হঠাৎ পাশ থেকে একজন কাপল,”আপনিই অনির্বাণ না?”
-“উমম… হ্যাঁ…মানে…কিন্তু আপনাদের তো চিনতে পারলাম না ঠিক।”
-“স্যার, একচুয়ালি অ্যাম আ বিগ ফ্যান অফ ইয়োর্স”, বলেই মেয়েটা এসে হ্যান্ডশেক করল বাবাই-এর সঙ্গে, মেয়েটির ছেলে বন্ধুটিও, “এভাবে এখানে আপনার সাথে দেখা হবে ভাবতে পারিনি, ভাগ্যিস আপনি ছবিটা দিলেন, তাই চিনতে পারলাম, আপনি কি এদিকেই থাকেন? প্লিজ স্যার আপনি লাইভ আসুন। আপনার ‘সায়াহ্নে’ আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয়। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ স্যার।”
এত কিছু বলে টলে অটোগ্রাফ নিয়ে ওরা চলে গেল।
জাস্ট কিচ্ছু মাথায় ঢুকলো না বাবাই-এর, অদ্ভুত একটা কারণ না জানা দারুণ অনুভূতি হচ্ছিল। ও সেভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাক্টিভ না, একটা একাউন্ট ছিল বটে, কিন্তু সেভাবে ও কোনদিনই কিছু করেনি। এসব ব্যাপারে ও বড্ড কাঁচা। ফোনটা হাতে নিয়ে সার্চ করল ও। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে এসে গেছে ততক্ষণে। গুগল সার্চ করতেই লিংকগুলো চলে এলো সব পর পর। প্রথমটায় ক্লিক করতেই চক্ষু চড়কগাছ বাবাই-এর, এসব আবার কী? হ্যাঁ, ওরই তো ছবি দেওয়া, ওরই নাম দেওয়া। একী, এই লেখাগুলো তো ওর! এ কীভাবে সম্ভব? ও তো এসব কিছুই করেনি, কিন্তু, সত্যি এসব লেখা, নাম, ছবি সবই ওর। কত লোকের শুভেচ্ছা, হাজার হাজার লাইক কমেন্ট কীভাবে হলো এসব? এই জন্যই ওরা ওর অটোগ্রাফ নিয়ে গেল। কত শুভেচ্ছা বার্তা তাতে রিপ্লাই-ও আছে ওর নাম দিয়েই। কিন্তু ও তো কিছুই করেনি এসব। লেখাগুলো তো সেই কলেজ পড়তে লেখা, কতদিন হয়ে গেল, আর এখন তো লেখাগুলো ওর কাছেও…।
বাড়ির কাছে কোথাও বাজ পড়ল ভীষণ জোরে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাবাই। তার মানে এই সমস্তটা, এই সমস্ত কিছু।। ওহ মাই গড। বাড়ির সামনের সিঁড়িতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল ও। এই আধঘন্টা আগেই ওর আরেকটা লেখা পাবলিশ হয়েছে, শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিচ্ছে পাঠক কমেন্ট বক্স, ও তো এগুলোই স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু ওর সেই জ্ঞান, সেই ক্ষমতা কোনদিনই ছিল না। কতজন ওর সাথে দেখা করতে চায় বলে লিখেছে, কতজন ওর বই পড়তে চায়।।।।। পড়তে পড়তে চোখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, আনন্দে। এভাবে হঠাৎ ওর স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়ে যেতে পারে, ও তো জীবনে কোনদিন ভাবতেও পারেনি।
কতক্ষন এভাবে চুপ করে বসেছিল ও খেয়াল নেই, মা-র ফোনে টনক নড়ল। চোখ মুছে মা-এর ফোনটা ধরে একটু পরে যাচ্ছে বলে ফোনটা রাখল বাবাই। ঘোরটা যেন কাটছেই না, এমনও হয়?
অভীক তার মানে যে বলেছিল ঐ লেখায় আর তোর কোন অধিকার নেই। ও নিজের বিজনেসের জন্য।।।।। তার মানে সব মিথ্যে? সব। অভীক ওকে মিথ্যে বুঝিয়েছিল তার মানে? ও ওর লেখা দিয়েই আড়াল থেকে কেমন জিতিয়ে দিল? আর যে তোমায় এভাবে জেতাতে চায়, তাকে হারাবে কার সাধ্যি? আর অভীককেই ও এভাবে ভুল বুঝে।।।।। ছি ছি ছি।
অভীকের নাম্বারটা তাড়াতাড়ি ফোনবুক ঘেঁটে বের করল বাবাই। কী বলবে জানা নেই, কিন্তু ওকে ফোনটা করতেই হবে। কী বোকা ও, আসল নকলের পার্থক্য বোঝে না। রিং হয়ে ফোনটা কেটে গেলো। নিশ্চয় ভীষণ রেগে আছে ও, রাগটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, ও-ই বা এভাবে মিথ্যে বলল কেন? এত ঘোর প্যাঁচ বাবাই কোনদিনই বোঝে না।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই কল ব্যাক করল অভীক।
কিছু বলতে পারছিল না বাবাই। গলার কাছে একটা কষ্ট, আবার অনেকটা ভাললাগা যেন দলা পাকিয়ে আটকে রয়েছে। বৃষ্টি আসছে, ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, চোখ বন্ধ করেছিল বাবাই, নিঃশব্দে নোনতা জল গাল বেয়ে পড়ছে।
-“কেমন আছিস ভাই?” অভীকই জিজ্ঞেস করল প্রথম।
-“তোকে এত কিছু বললাম, তাও আমায় সত্যিটা বললি না, খুব মহান হয়ে গেছিস তাই না? সব একাই করবি? শালা, মিথ্যুক একটা। আজ আমি কাউকে জীবনে প্রথম অটোগ্রাফ দিয়েছি রে, তারপরই সব জানতে পারলাম, নয়তো আজও জানতে পারতাম না। কী করছিস রে পাগলা?”
-“ব্যস, আজই তো জেতার দিন, আমার সব পরিশ্রম, নাটক, মিথ্যেকথা সব স্বার্থক এবার।”
-“তুই আমায় এতদিনে একবার ফোনও করলি না? আর অতগুলো টাকা তাহলে কেন দিয়েছিলি যদি আমার নামেই সব করলি? আমি কেমন আছি একবার।।।।”
-“দাঁড়া, দাঁড়া, শোন, ফোন করতে তো তুইই আমায় মানা করেছিলি, কী করে করি বল? আর আমি জানতাম তুই ঠিকই করবি, যাই হোক, কাল একবার পারলে দেখা কর ভাই।।।।”
-“নিশ্চয়, নিশ্চয়, কাল যত কাজই থাকুক, কাল দেখা হচ্ছে। এখন তাহলে রাখলাম।” বাই করে ফোনটা রাখল বাবাই। কী যে হচ্ছে ওর সাথে ও নিজেও জানে না। বাড়ীতে ঢুকল, মা-কে এখন এসব বলে লাভ নেই। মা এখন কিছুই বুঝবে না, ও নিজেই এখনও ধোঁয়াশায় ।
**************
কালকের রাত থেকে আজকের এখন দুপুর ৩টে অবধি, কীভাবে যে কেটেছে বাবাই-এর বাবাই-ই জানে একমাত্র। বসকে বলে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে ও। অভীকের অফিস অবধি পৌঁছাল যখন, তখন ঘড়ির কাঁটা ৩টে পেরিয়েছে।
**************
না, এতগুলো দিন পর দেখার পরও কোন জড়তা, কোন আতিথেয়তার নাটক ছিল না দুই বন্ধুর মধ্যে, বরং, আজ এতগুলো দিন পর দেখা হলে দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। বেশ কিছু গালাগালি, আর প্রাণের বন্ধুর কাছে অনেকটা ভাললাগার মুহূর্ত, কোথা দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল খেয়ালই নেই।
কফিমগটা টেবিলে রাখতে রাখতে অভীক বলল, “তুই আসবি বলেই আজ কোন কাজ রাখিনি এখন। বল এবার, জানি তোর মনে এখন অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।”
-“হ্যাঁ, কেন করলি এসব? মাঝখান থেকে এই ভুল বোঝাবুঝিটা।।।। আমি যদি এখনও না জানতাম, যদি কোন দিনও না জানতাম।।।। তাহলে তো।।।।”
-“নেভার, কখনোই সম্ভব না, এটা একদিন না একদিন হওয়ারই ছিল, শুধু তুইই বুঝতিস না, তোকেই আমি শুধু বোঝাতে পারিনি, তাই এটা করতে বাধ্য হলাম। তুই যখন সাহায্যের জন্য এলি, তোর জন্য কিছু করার এর থেকে ভাল আর কোন সুযোগ আসত না আমার কাছে। আর আমি জানতাম এই দিনটা আসবেই একদিন। আমি তোর পোটেনশিয়াল অনেকদিন আগেই বুঝেছিলাম। শুধু তোর বোঝাটা দরকার ছিল। দিনটা আসতে একটু দেরী হলো, কিন্তু অ্যাটলাস্ট এলো তো, ব্যস।”
-“কিন্তু, তুই এগুলো যে করলি আমার নামেই, তাহলে টাকা কেন।।।”
-“হোল্ড অন, হোল্ড অন, আমি অতটাও মহান নই, তোকে যে টাকাটা দিয়েছি সেটা তোর প্রাপ্য, তোর লেখার জন্য আজ ওয়েবসাইটে যা ট্র্যাফিক, যা লোকের মধ্যে চাহিদা, তার জেরেই মাসান্তে একটা ভাল টাকা ট্র্যাফিকের জন্য পাই, তারই একটা অংশ হিসেবে কিছু থোক টাকা আমি তোকে দিয়েছিলাম। আর তোর আর কোন অধিকার নেই বলেছিলাম কারণ, আমি জানি আমি তোর লেখাগুলো নিয়ে কী করতে চাই। প্ল্যানটা পুরোই আমার, আর লেখা তোর। তোকে তোর স্বপ্নের পিছনে দৌড়তে সাহায্য করার জন্যই এই প্ল্যাটফর্মটা বানানো। আর এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তুই যথেষ্ট সাকসেসফুল, এটা তুই বুঝেই গেছিস। এবার মানুষ তোর বই চাইছে পড়তে। এটাই তোর আসল জিত রে। আমি শুধু তোর জায়গাটা তৈরী করতে সাহায্য করেছি, বাকী যা করেছে তোর লেখা। তুই লিখবি আমি প্রকাশ করব। ট্রাস্ট মি, ইট উইল গেট আ হিউজ সাকসেস, হিউজ।”
মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বাবাই-এর। এ’সমস্ত কিছু যে ঘটতে পারে, এ ধারণাও ওর ছিল না। এভাবে নিজের স্বপ্নকে সত্যি হতে দেখবে ভাবতে পেরেছিল ও? অভীক যদি আজ না থাকত।।।।।
***************
(বছর খানেক পর)নিজের বই-এ সই করে নিজের ফ্যানদের হাতে তুলে দিচ্ছে আজকের অনির্বাণ চ্যাটার্জী।সেদিনকার বাবাই আজ অনেক বড় লেখক। নিজের স্বপ্নকে এভাবে সত্যি হতে দেখবে কোনদিন, কখনোই ভাবেনি ও। আজ পাশে ওর মা বাবা, স্ত্রী তিতলি। বাবা আর এই লেখক ছেলেকে অপদার্থ ভাবে না। প্রেমিকা থেকে স্ত্রী হতে আজ তিতলি আর দু’বার ভাবেনি। মা আজ ছেলের সাফল্যে গর্বিত। আর পাশে অবশ্যই অভীক, যাকে ছাড়া এই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প, এই উড়ানের গল্প, এই বন্ধুত্বের গল্পটাই অসম্পূর্ণ । এমন বন্ধু থাকলে এভাবেও স্বপ্নকে ছোঁয়া যায়।