আলো-আবছায়ায় (তৃতীয় পর্ব)

তৃতীয় পর্ব

।।১।।

ঘরটা বাগানের কাছে, সামনের একমুঠো সবুজটা এখন অন্ধকারে যদিও দেখা যাচ্ছে না। 

আদিত্যই বলল, ” এই জানলাটা দিয়েই দিনের প্রথম আলোটা আমার এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৃষ্টিগুলোকে ছোঁয়, এই ঘরটা আমার ভীষণ ভীষণ প্রিয়।

বিশাল ঘরটায় আদির আঁকা অনেক অনেক ছবি। সত্যি ছবিগুলো দেখতে দেখতে কোথাও একটা হারিয়ে যাচ্ছিল হিরু। আঁকার ব্রাশ, রংগুলো টেবিলটার উপর রাখা। একটা সাদা টিশার্ট লাল নীল তুলির আঁচড়ে জড়ো করে রাখা।

-“এটা ঐ আঁকার সময়ে বারবার রঙ লাগে তো তখন, ঐ জন্য রাখা।”

-“ও আচ্ছা” জামা টা তুলে নিয়ে একবার রঙের ঘ্রাণটা নিল হিরু, আদির সামনেই। ভীষণ এট্রাকটিভ এই গন্ধটা, হিরুর মাথা কাজ আর কাজ করে না তখন, রেখে দিল জায়গার জিনিস জায়গায়। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ৯টা। আদি এসে দাঁড় করাল ক্যানভাসটার সামনে।

আদিত্য যখন হিরুকে বাড়িতে ডাকার কারণটা উন্মোচন করল হিরুর সামনে, হিরু বুঝতেই পারছিল না কী বলবে। যাকে বলে হতভম্ব, পুরোপুরি পাজল্ড। কী বলা উচিত, কীভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছে না হিরু।

ক্যানভাসে হিরুর হাসিটা জ্বল জ্বল করছে। এরকম একটা সারপ্রাইজের জন্য তো একদমই রেডি ছিল না। কোন মুহূর্তটাকে বন্দী করেছে ও?

ওর মনের কথার রেশ টেনে নিয়েই যেন আদি বলল, ইন্টারভিউ-এর আগে তোমার ঐ চেয়ে থাকাটাকেই। মনে পড়েছে?

ঠিক, তাই-ই তো। এভাবেই মুগধ দৃষ্টিতে আদির হাসির দিকেই চেয়েছিল হিরু। ও সেটা লক্ষ্য করেছিল তার মানে, আর ঐ কয়েক মুহূর্তকে কেমন বন্দী করে ফেলল।।।

ভীষণ লজ্জা লাগছিল হিরুর, কিন্তু তার সাথে অনেকটা ভালো লাগাও ছিল। এরকম ফিল কখ্খনো হয়নি। কখ্খনো না। কিছু আর বলতে পারেনি হিরু।

একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরলো ও। এই প্রশ্নটুকুও করতে পারেনি যে, ও-ই কেন ক্যানভাসে জায়গা পেল? হয়তো আরও অনেক মেয়ের মুগধ দৃষ্টিই ফ্রেমবন্দী হয়েছে। ও-ই প্রথম তার কী মানে। নিজেকে এটাই বোঝাচ্ছিল ও। যদি জানতে পারে, ও-ই প্রথম ? নিজেকে এটাই বোঝাচ্ছিল ও। যদি জানতে পারে, ও-ই প্রথম, ও আর… থাক, আর কিচ্ছু বলেনি ও। স্কুটিতে উঠতে যাওয়ার আগে আদি-ই আটকাল আবার, ” আর একবার প্লিজ আসবে আমার বাড়ি, আমার আঁকার ঘরটা দিনের আলোয় তোমায় দেখাব একবার। এখন তো আসল রূপটা দেখাতেই পারলাম না। আসবে?”

-“ওকে” কিচ্ছু না ভেবে আগুপিছু, মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দিল হিরু।

-“অনেকটা রাত হয়ে গেছে, চাবিটা দাও, আমি ছেড়ে দিচ্ছি।”

হিরু কিছু বলার আগেই ওর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে নিল আদি। চাবিটা নেওয়ার সময় ওর হাতটা হিরুর হাত ছুঁয়ে গেল। 

হিরুর মধ্যে যে কী চলছিল, তা ভাষায় বলা যায় না, আর কাকেই বা বলবে? অনীককে? অনীক কিছু মনে করবে না তো? 

অনীক ওর বেস্ট ফ্রেন্ডও। কিন্তু এত রাত হয়ে গেছে অনীক একবারও ফোন করল না তো। আর ওর একবার মনেও পড়েনি ওর কথা। ফোনটা বের করতেই দেখল ফোনটা সুইচ অফ হয়ে গেছে চার্জ আউট হয়ে। ইসস, খেয়ালই করেনি। নিশ্চয় খুব টেনশন করছে। 

-” কী হলো বসো।”

কোনরকম আপত্তি করার ইচ্ছে বা শক্তি হিরুর আর ছিল না। কেন, হিরুর নিজের কাছেও তার কোন উত্তর নেই।

**************

রাতের মহানগরীর রাস্তাটা চিরে স্কুটিটা যখন ছুটছিল, স্কুটির পিছনে বসা হিরুর চুলগুলো উড়ছিল ঝোড়ো হাওয়ায়। স্কুটির আয়নায় প্রতিবিম্বতে বারবার ঐ চোখ, ঐ মুখ এর হাসিটাই দেখছিল ও। বড্ড, বড্ড মিষ্টি সে হাসি। না তাকিয়ে তো পারছেও না ও। সারাটা রাস্তা আদিই বকে গেল, হেসে গেল, হিরু আজ চুপ, ও শুধু অনুভব করতে চাইছে, বুঝতে চাইছে কী চলছে ওর মধ্যে, কেন চলছে।

বাড়ী এসে গেছে, হিরু সাইড করে রাখতে বলল।

-“এবার আপনি, মানে তুমি কী ভাবে ফিরবে?” স্কুটি থেকে নেমে হেলমেটটা খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল হিরু।

ওর ডান হাতটা ওর অজান্তেই এতক্ষণ আদির চওড়া কাঁধেই ছিল, সেটা এই খেয়াল হলো ওর।

হিরুকে ইশারায় দেখাল স্কুটির থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আদির অডি টা , ড্রাইভার আদির অপেক্ষায়।

-“তোমার সাথে বহুদিন পর খোলা হাওয়ায় যেন উড়লাম। থ্যাংকস। গুড নাইট।”

ব্যস, এটুকু বলেই নিজের গাড়িতে উঠে চলে গেল আদি। হিরু গাড়িটা পুরো না মেলানো অবধি তাকিয়েই ছিল। আদি একবারও আর ফিরে তাকালো না। হিরু মাথাটা নীচু করে খানিক দাঁড়িয়ে পা বাড়াল ফ্ল্যাটের দিকে।

চলন্ত গাড়িতে আদি তখন ফোনের স্ক্রিন লকটার দিকেই তাকিয়ে। হিরুর হাসি জড়ানো ক্যান্ডিড শটটাই আদির ওয়ালপেপার এখন।

**************

-“কীরে, তোর ফিরতে এত দেরী হলো? আর কখন থেকে তোকে কল করছি বলতো, ফোনটা কোথায় তোর? আর তোর মুখটা এরকম দেখাচ্ছে কেন?”

হিরু সবে ফ্ল্যাটে ঢুকে সোফায় বসেছে ব্যাগটা রেখে। অনীক স্বাভাবিক ভাবেই প্রচন্ড চিন্তায় ছিল, এত রাত হয়ে গেছে, ফোনেও পাচ্ছে না।

-“কীরে, কী হয়েছে বলবি?” হিরুর হাতটা ধরে পাশটায় বসে পড়ল অনীক, “তোর জন্য খাইওনি এখনও। পাস্তা করবো, সব রেডী করে রেখেছি, আর ম্যাডামের পাত্তাই নেই।”

-“আরে ফোনটা চার্জ-আউট হয়ে গেছে, এ দ্যাখ।”, বলেই ফোনটা বের করল হিরু।

-“দে আগে চার্জে বসাই। তুই ফ্রেশ হ, আমি খেতে দিচ্ছি এখুনি”, বলেই হিরুর নরম গালে হাতটা দিয়ে নিজের ভালবাসাকে একবার দেখল অনীক।

অনীকের চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে হিরুর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, কারণটা ওর ও অজানা। কিন্তু খুব ইচ্ছে করছিল অনীককে জড়িয়ে ধরতে। ওর চোখে হিরুর জন্য উদ্বেগ-এর ছায়া এর আগেও তো দেখেছে হিরু, কিন্তু আজ? কেমন একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ কাজ করছিল হিরুর মধ্যে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে অনীক উঠতে যেতেই ওর হাতটা ধরল হিরু। অনীককে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরল হিরু। কোথাও যেন একটা শান্তি হচ্ছিল। হারিয়েও ফিরে পাওয়ার যেমন একটা আনন্দ, ঠিক তেমনই।

অনীক হিরুর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে উঠে পড়ল সোফা থেকে। 

একটা ঘোরের মধ্যেই হিরু ফ্রেশ হলো, খেতে বসলো। অনীক অনেক বকবক করছিলো, হিরুর কানে কিছু ঢুকছিল না। কানে কেমন যেন একটা তালা পড়ে গেছে, এরকম একটা অনুভূতি। কান মাথা ভোঁভোঁ করছে। অসম্ভব টায়ার্ড লাগছে। পাস্তাটুকু খেয়ে কেমন হয়েছে সেটাও বললো না, তার বদলে চেয়ে রইল অনীকের দুচোখের দিকে। আর বারবার ওর চোখে ভেসে উঠছিল ঐ চোখ জোড়া। যতই চেষ্টা করছে, কিছুতেই সরছে না। স্খলিত পায়ে ঘরে ঢুকে, বিছানায় শুয়ে চোখদুটো ক্লান্তিতে বুজল হিরু। অন্যদিন অনীকের আদরে নিজেও জেগে উঠত হিরু, কিন্তু আজ অনীকের মুখ ওর ঘাড়ের কাছে যখন আদরের গন্ধ ছড়াচ্ছে, কিছুতেই পারছিল না আজ অনীককে ভালবাসতে। চুপচাপ শুয়ে রইল ও। অনীক বুঝল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওর চোখ বুজিয়ে দিল। এই বেশ ভাল। এর থেকে নিরাপদ আশ্রয় আর কী বা হতে পারে।

।।২।।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের আঁকার ঘরে পৌঁছে যায় আদি। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওর ভালবাসা, সাধনাকে মন প্রাণ দিয়ে আগলে রাখে, সম্মান করে ও। কিন্তু তফাতটা অন্য জায়গায়। ও যতই চাইছে, নিজেকে সরাতে ততই ঐ হাসি, ঐ মুখ, ঐ বিস্মিত দৃষ্টি ওকে যেন ধাওয়া করছে। হাতের রঙ তুলি যেন টানছে ক্যানভাসের সামনে। হাতের তুলি দিয়ে যাতে মনের কোণের ছবি ক্যানভাসে জায়গা পায়, একটু যদি রক্তক্ষরণটা কমে। কিন্তু পারছে কই?

আজ অবধি কোন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়নি ও। হ্যাঁ, ঐ প্রেমটা বাদ দিয়ে বাকী সবই হয়েছে ওর জীবনে, কিন্তু এবার সব হিসেবে এলোমেলো করে দিচ্ছে মেয়েটা।

ওর জীবনের এই ৩২টা বসন্তে যেন একরাশ লাল আবির ছুঁড়ে দিয়েছে মেয়েটা। তাই সবসময়, সব মুহূর্তে ওর ফোনের ওয়ালপেপারে, বা ক্যানভাসে একটাই মুখ। এই প্রথম, এই শেষ।

নিজেকে উজাড় করে কাউকে ভালোবাসার সুযোগ কখনো আসেনি আদির জীবনে। কিন্তু আজ এই ঘরে দাঁড়িয়ে হিরুর কালকের ফেলে যাওয়া একটা রুমালের মধ্যে ওর স্পর্শ খুঁজে পাওয়ার আকূল চেষ্টাটাই প্রমাণ করে দিল ওর কাছে এ-ই সে, এ-ই আর কোন সংশয় নেই।

নিজের মনের কথা মনে রেখে দেওয়ার মতন মানুষ আদিত্য রায়চৌধুরী নয়। কিন্তু আজ কোথাও যেন একটা বাধছে, কোথাও যেন একটা ভীতি, সঙ্গ হারানোর ভয়, ‘না’ শোনার ভয় কাজ করছে। খুব মূল্যবান কিছু যদি পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলে? না, না। আজ অবধি ওকে কেউ ‘না’ বলেনি, বরং ওর সবটা জড়িয়ে নারী সঙ্গ প্রকট হয়েছে বারবার, রঙ্গীন হয়েছে রাতগুলো।

কিন্তু আজ, সমস্ত কিছু পেরিয়ে একটা মেয়ে,শরীরী বিভঙ্গ, কোমরের ভাঁজ নয়, তার হাসিটাই যেন বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে ওর ভিতরকার প্রেমিক সত্ত্বাটা।

আজ আর জিমেও যায়নি আদি। তার জায়গায় ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে ক্যানভাসে। যতক্ষনে একটু থামল তখন বেলা ১টা প্রায়। আর আরও একবার, আবার কালকের মুহূর্তটা ভেসে উঠল ক্যানভাসে। সেই সমুদ্র-নীলে ভরা দুটো চোখ, সেই মুক্ত ঝরানো হাসিটা, খোলা চুল, আবারও হিরু। আদির চোখ, হাত, মনটা ক্যানভাসে আর কাউকে তুলে ধরার পারমিশন দিচ্ছে না যে। মাথাটা ধরে বসে পড়ল আদি মাটিতে। বেশ ঘেমে গেছে। মাথার চুলগুলোও ভিজে, মুখ চোখ উদ্বিগ্ন। গায়ে আর শার্টটাও পড়েনি আজ, শুধু পরনে একটা ট্রাউজার্স।

ও এঘরে থাকলে কেউ সাধারণত ডিস্টার্ব করে না, আজও করেনি। ফোনটা ওর কাছে নেই, এটা এতক্ষনে খেয়াল পড়ল ওর। হিরুর সাথে বড্ড ইচ্ছে করছে দেখা করতে, ওকে না বলে তো ওর শান্তিই হচ্ছে না। এরকম পাগলের মত বাঁচা যায় নাকী? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ফোনটা নিয়ে ফোন করল হিরুকে। কিন্তু রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল।

আর পারছিল না আদি। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে তার তলায় মাথাটা দিয়ে দাঁড়াল ও।

মাথায়, সারা শরীরে যেন আগুন ছুটছে। কিছুতেই মনটা স্থির হচ্ছে না, শান্ত হচ্ছে না। শরীরে বিন্দুবিন্দু জল, ঘাড়ে সাদা তোয়ালেটা দিয়ে বেরিয়ে এল আদি ফোনের শব্দে। কলব্যাক করছে হিরু। উফফ, তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করল ও।

ওপাশ থেকে হিরুর গলাটা শোনার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল আদি।

-“হ্যালো”

-“হ্যাঁ, হিরু, কোথায় আছ”

-“আমি তো অফিসে, কিন্তু আপনি কি ফোন করেছিলেন?”

-“হ্যাঁ, আজ একবার দেখা কর।”

ফোনের স্ক্রিনে আদির নাম্বারটা দেখেই হৃৎপিন্ডটা লাফাতে শুরু করেছিল হিরুর। চাইলেও পারছে না ও এড়াতে। ঐ মুহূর্তে তাই ফোনটা না ধরলেও ও জানে ও ফোন না করে পারবে না। বাথরুমে গিয়ে তাই কলব্যাকটা করেই ফেলল। আদির ভয়েসটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওর শিরা উপশিরায় রক্ত প্রবাহ যেন বহুগুন বেড়ে গেছে। কানে, গালের কাছে রক্তগুলো যেন একসাথে জড়ো হয়ে গেছে। ‘না’ বলার ইচ্ছে ওর ছিল না, কিন্তু ‘না’টা বলাটাও যে খুব জরুরী।

-“না, মানে, আদি, আজ তো।।।”

-“প্লিজ, আমি ‘না’ শুনব না। আজ তোমার অফিসের সামনে আমি ওয়েট করব, ছুটির পর, এভাবে এমনিও কোন কাজ হচ্ছে না আমার।”

-“মানে?”

-“কিছু না, বাই।”

ফোনটা রেখে দিল আদি। রেস্টলেস ভাবটা যেন একটু কাটল। আর পারছিল না, ফ্রিজ থেকে মদের বোতলটা বের করে গলায় ঢালল ও। ও হিরুকে কোন কিছুর মূল্যেই হারাতে পারবে না। যাই হয়ে যাক, সামনে যেই আসুক, ও সহ্য করবে না। বহুবছর পর নিজের অজান্তেই ওর চোখের কোণে জল। চোখটা মুছে আবার গলায় ঢালল সুরা। নিজেকে শান্ত করতে নেশায় ডুবিয়ে দিল নিজেকে।

***************

দুধ সাদা সেডানের সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্য। হাত দুটো মুড়ে নিজের বুকের কাছে রেখে। চুলটা বেশ এলোমেলো, চোখটা রক্ত লাল, জামার প্রথম দুটো বোতাম খোলা। হিরুর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে আদি। আদির চোখের দিকে তাকাতেই হিরুর সারা শরীরে কেমন একটা শিহরন খেলে গেল। এরকম পাগল করা দৃষ্টি উপেক্ষা করে, এমন মেয়ের দেখা পাওয়াই ভার।

-“কী হয়েছে আদি? হঠাৎ? আমি তো বললাম।।।”

-“তোমার বেশী সময় নেব না আমি, প্লিজ গাড়িতে ওঠ, তোমার কী স্কুটি আছে সঙ্গে?”

-“না, কিন্তু।।।”

আর কোন কথা না শুনে আদি ওর দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে বসতে ইঙ্গিত করল।

বাইরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে , তাড়াতাড়ি বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাড়িতে ঢুকল হিরু। ড্রাইভারের সিটে বসে সিট্ বেল্ট বাঁধতে গেল, হিরু হাতটা ধরল আদি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদি, “তোমার বাড়ি যাওয়া অবধি পথটুকু পার করার সময়টুকুই নেব, আর কিছু না,” বলে নিজের সিট বেল্টটা লাগিয়ে হিরুর সিট বেল্ট লাগিয়ে দিতে গেল, হিরু বাধা দিল না, জাস্ট দিল না। আদির মুখ ওর খুব কাছে, বাইরে বৃষ্টির দাপট তখন বেড়ে গেছে। কাচ পুরোপুরি ঝাপসা। আদির চাহনির মধ্যে হিরু ওর জন্য পাগলামি দেখল আজ। যেটা কিনা প্রেম, ভালবাসা, এসবের থেকেও বেশী কিছু! একটা আগুন জ্বলছে আদির চোখে। ওর দেহের পুরুষালী গন্ধটায় আবার মাথা কাজ করছে না হিরুর। আদি সিটবেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

কেন করছে আদি এটা? হিরু আদির জন্য যা ফিল করতে শুরু করেছে, ও তো বলেনি আদিকে। তাহলে? আর অনীক? অনীক জানলে এবার কী করবে? অনীককে কোন কষ্ট কিভাবে দেবে ও?

-“অনীক চিন্তা করবে।”, ইচ্ছে করেই অনীকের কথাটা তুলল হিরু, আদির সামনে।

-“অনীক মানে? তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

-“হুম, উড বি। আমাদের সামনেই বিয়ে।” এক নিঃশ্বাসে বলে দিল কথাগুলো।এখন না বললে আর বলতে পারবেও না।

-“বাহ, কনগ্রাচুলেশন দেন।” কথাগুলো খুব নির্জীব, মেকী শোনাল। কানে লাগল হিরুর।

-“থ্যাঙ্ক ইউ।”

-“আমি তোমায় বাড়িতে ডাকলাম, তুমি ডাকবে না একদিন?”

কথাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না হিরু। ওর কিছু বলার আগেই আদি বলল, “ভয় পাওয়ার দরকার নেই, জাস্ট মজা করছিলাম।”

কখন যে গাড়িটা, ওর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই করেনি।

-“খুব বেশী সময় নিলাম না আশা করি। যাইহোক, বাই।”

-“কিন্তু তুমি তো কিছু বলবে বলেছিলে, কিছুই তো বললে না।”

-“নাহ, থাক, চলো বাই। ভাল থেকো।”

হিরুকে ড্রপ করে দিয়ে গাড়িটা চোখের নিমেষে চলে গেল। হিরু আজ বৃষ্টিতে একটু ভিজতে চায়। ওর চোখ আর্দ্র কেন? ওই মানুষটার জন্য? এই আদি কাছে থাকলেই হিতাহিত জ্ঞান কাজ করে না।এটা কোনো প্রেম নয়। ও অনীককেই ভালবাসে, তাহলে? সব বড্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু সব গোছানোর জন্যই এলোমেলো করছে ও আজ।তখনই ফোনের রিংটা বেজে উঠল। ও ভুল করে আদির ফোনটা নিয়ে নেমে পড়েছে। কেটে গেল ফোনটা, স্ক্রিন লকটা দেখেই চমকে উঠল হিরু।।।  

চতুর্থ পর্ব

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with