আলো-আবছায়ায় (চতুর্থ পর্ব)

চতুর্থ পর্ব

।।১।।

আজ ঘরে ঢুকে চারপাশটা কী সাংঘাতিক রঙীন লাগছে হিরুর। ভীষণ প্রাণবন্ত, ফ্রেশ। সে মিয়োনো ভাবটা যেন কেটে গেল একলহমায়। আদিত্য বেশ খানিকটা চলে গেছিল, তারপর হিরু ফোন করে ওকে, ফোনটা দেবার জন্য। ফোনটা ফেরত দেবার সময় কী মারাত্মক লজ্জা লাগছিল ওর। যেন সব রক্তগুলো কানের কাছে, গালের কাছে এসে জড়ো হয়েছে। আদিত্য একদৃষ্টে হিরুর দিকেই তাকিয়ে ছিল। হিরুই তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল, আদির নিজের মনের ইচ্ছেটাকে লোকানোর কোন ইচ্ছেই নেই যেন। যেন বুক চিরে দেখাতে চায়, কে রয়েছে ওর মনের কোণে? আদিত্য আজ অল্প ড্রাঙ্ক ছিল, তাই আর কোনরকম কথা বাড়ায়নি হিরু।

হিরুর খুব ইচ্ছে করছিল আজ নিজের সাথে সময় কাটাতে। আদির কথা আজ নিছকই অকারণেই ভাবতে ইচ্ছে করছিল। ওয়াশরুমে শাওয়ার তলায় জলকনাগুলোকে নিয়ে খেলতে খেলতে, বা স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নরম বিছানায় শখের টেডি বিয়ারটার সাথে খুনসুটি করতে করতে, খুব ভাল লাগছে ওই মানুষটার কথা ভাবতে।

ওর হিরুর দিকে তাকিয়ে থাকা, ওর কথা বলা ধরন, হাসিটা সবকিছু যেন পাগল করে দিচ্ছে ওকে, আর আজ সেই মানুষটার পাগলামোর কারণও হিরু, এটা হিরু যখন জানতে পেরে গেছে, এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে? ফেসবুক খুলে আদির একের পর এক ছবি স্ক্রল করছিল ও। সুইমিং পুলের একটা ছবি দিয়েছিল, প্রায় একবছর আগের ছবি।

আদির পুরুষালী চেহারাটা বেশ ভাল বোঝা যাচ্ছে, ওর বামহাতের কাছে একটা ট্যাটুও আছে। আদির অনাবৃত পিঠে আঁকা আর একটা ট্যাটু, ধরা দিল হিরুর চোখে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিল হিরু। আর যেন কিছুই ভাল লাগছে না। খুব খুব দেখা করতে ইচ্ছে করছে আর একবার, আজ। এই তো কিছুক্ষণ আগেই দেখা হলো, কিন্তু মনে হচ্ছে কতক্ষণ যেন দেখা হয় না। ওর ভাবনার মাঝে দাঁড়ি টেনেই কলিং বেলটা বেজে উঠল। এক ঝটকায় বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ল হিরু। অনীক এলো বোধহয়।

****************

দরজা খুলতেই বড়সড় ব্যাগ হাতে অনীক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।

-“দ্যাখ কী এনেছি তোর জন্য?” বলেই হিরুর কপালে একটা চুমু এঁকে ঝোলা নিয়ে ঘরে ঢুকল অনীক।

আগে অনীকের ছোঁয়ায় নিজেকে সম্পূর্ণ লাগত হিরুর। আজ সেই অনুভুতিটা মিসিং। অস্বস্তিই হলো বরং, হিরুর।

-“কী এত এনেছিস বোঁচকা ভরে?”

-“চিংড়ি, চিংড়ি। এই যে এতদিন ধরে তোর মেজাজ খিটকেল হয়ে আছে, কী ভাবছিস কিছু বুঝছিনা? সাইজগুলো দ্যাখ খালি। কাতলা মাছও এনেছি। তোর ফেভারিট, পেটির মাছ।”

-“তুই জানিস অনীক এত হাঙ্গামার রান্না আমি পারি না, কেন এত পাকামো মারিস বলতো?”

-“আরে দাঁড়া, দাঁড়া, তার ব্যবস্থাও আছে। ওদিকে তাকা একবার।”

-“মানে?” 

দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই হিরু দেখল, মা বাবা দুজনেই হাজির। শুধু তাই নয়, সঙ্গে অনীকের মা বাবাও। কিছু বোঝার আগেই যেন একটা বাজ পড়ল হিরুর মাথার উপর।

***************

-“মা, একটু মাছটা এগোবে?”

-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, নে, তা কী বলেন মিত্তির মশাই, সামনের অঘ্রানের থাকে বেশী দেরী করাটা ঠিক হবে না, শুভ কাজে দেরী করে লাভ নেই।”

অনীক আর হিরুর বিয়ের ডেট কবে ঠিক করা হবে, সেই নিয়ে যখন দুই বাড়ির মধ্যে আলোচনা চলছিল, তখন একমাত্র হিরু, নিজের বিয়ে সম্পর্কে এতটুকু উৎসাহ নিজের মধ্যে অনুভব করছিল না। কিন্তু এমনটা ছিল না, আগে ও-ই বিয়ের জন্য লাফাত, অনীক বরং সময় চাইত। আর এখন যখন অনীক রেডী, তখন হিরু পুরোটা মেনে নিতে পারছে কই?

কেন এরকম হচ্ছে ওর, সেটা ওর থেকে ভাল আর কে জানে।ওর যে অনেক কাজ বাকি | কিন্তু এখন কাকে কী বলবে ও? বললেও শুনবেটা কে?বলাটাও অসম্ভব | আদির মতন এত বড় মাপের একজন মানুষের সাথে ওদের বাড়ি, আদৌ সমকক্ষ নয়, আর আদি ওকে অফিসিয়ালি বলেওনি কিছু। বললেও তাও কথা ছিল।

এসব কী ভাবছে ও? ছি ছি ছি, অনীককে চিট করবে ও? কী করে সম্ভব এটা? কিন্তু ও চোখ বুজলে যাকে দেখতে পাচ্ছে সে যে অনীক নয়। তবে? ও যে সেই মানুষ তার জন্যই নিজের জীবনে বাজি রাখতেও রাজি |

মা বাবা ওর আর অনীকের সম্পর্কটা মানেনি প্রথমে, আর যখন তারা বিয়ে নিয়ে ভাবছে তখন হিরু এখনই … না না, এ হতে পারে না। ও অনীককে ঠকাবে না কোনো কিছুর মূল্যেই ।

***************

চোখ বন্ধ করে নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছে হিরু। ওর মধ্যে কী হচ্ছে ও বোঝাতে পারবে না। যেন কেউ কিছু একটা উপরে নিতে চাইছে ওর মধ্যে থেকে, যা ওর একান্ত নিজের। কিছু বুঝতে পারছে না হিরু, এভাবে বাঁচবে কী করে? কিন্তু কী করবে ও?

বাইরে ওদের বিয়ের ডেট শর্টলিস্ট হচ্ছে, পুরুত মশাইও আসছেন কিছুক্ষনের মধ্যেই। সবাই ভাবছে ও হয়তো লজ্জা পাচ্ছে, তাই ঘরে চলে এল। কিন্তু মা তো জানে এত লাজলজ্জার বালাই হিরুর কোনদিনও ছিল না। মা যদি একবারটি জিজ্ঞেস করতো।।।

অনীক জিজ্ঞেস করছিল, “সারপ্রাইজ কেমন লাগলো বল?”

কিচ্ছু বলতে পারেনি হিরু। জোর করে হাসল একটু, “অনীক, তুই তো চিনিস তোর হিরুকে, তুই বুঝতে পারছিস না কিছু?”

***************

কখন যে চোখটা লেগে গেছে, বুঝতেই পারেনি, ঘরে ঢুকে মা আলোটা জ্বালাতে ঘোরটা কাটল আদির। খাটের পাশের খোলা মদের বোতল, গ্লাস, মাকে দেখে বৃথা আড়াল করার চেষ্টা করছিল। উঠতে গিয়ে টাল খেয়ে আবার হেলে পড়ল বিছানায়।

-“কী হচ্ছে এগুলো বাবাই? হঠাৎ কী হলো? কোনদিন তো… “

-“মা, একটু বস না আমার কাছে।”

ছেলের নিতান্ত শিশুর মতো ব্যবহারে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন আদিত্যর মা। বললেন, “কিন্তু, কী হয়েছে সেটা তো বলবি।”

মা-এর কোলে মাথাটা রাখল আদি, আজ কত বছর পর কে জানে। মা-এর সাথে কতদিন ভালভাবে কথা বলা হয় না, আর আজ যখন মা কাছেই , কতকিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে কই? হিরুর উড বি-র কথা শুনে ও এতটা রিয়াক্ট করছে কেন, এতো ওরও অজানা। মেয়ে তো জীবনে কম আসেনি, বহু সম্পর্কেও জড়িয়েছে, কিন্তু ভালো বেসেছে কী? না। কিন্তু আজ, বছর ২৩-২৪-এর হিরু, ৩২-এর আদির সমস্ত হিসেবে তছনছ করে দিচ্ছে। আর এই যে প্রলয় উঠছে আদির মনে হিরুর জন্য, তাকে বাগে আনার কোন পথও জানা নেই আদির। হিরুকে ফোনেও পাচ্ছে না বহুক্ষণ ধরে। একবার সামনে সামনি কথা বলাটা খুব দরকার।

***************

-“১২ই অঘ্রানই শুভ, তাহলে ঐ দিনটাই স্থির রইলো, কী বলেন?”

বাইরের টুকরো টুকরো কথাগুলো কানে আসছিল হিরুর। ওর বিয়ের দিন ঠিক হচ্ছে আর ওর মধ্যে কোন উন্মাদনাই নেই, কিন্তু এখন কাকে বলবে ও এসব? 

ফোনটা কখন থেকে চার্জে গুঁজে রেখেছিল, সুইচ দিতেই ভুলে গেছল, চার্জ-আউট হয়ে বন্ধ, উফফ।

বাইরে মা-বাবাদের আমোদ আহ্লাদ ব্যস্ততা তুঙ্গে, অনীক ঘরে এসে দেখল হিরু জানলার ধরে বসে সিগারেট খাচ্ছে।

পাশটায় গিয়ে বসল অনীক, হিরুর হাতটা ধরতে হুঁশ ফিরল হিরুর, কোন খেয়ালে হারিয়েছিল এতক্ষণ । আগে তো হিরু অনীককে কাছ ছাড়াই করতে চাইত না। আর এখন, অনীক-এর প্রতি এতটা উদাসীন কবে হয়ে গেল হিরু? অনীক হাতদুটো ধরে হিরুর চোখে চোখ রাখল। হিরুর মুখে উদ্ভাসিত হাসি, চোখটা চিকচিক করছে যেন আনন্দে। কিন্তু আর কেউ না দেখতে পাক, মনের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছে অনীক, ওর চোখের আয়নায়। মেকী হাসি দিয়ে পারেনি ঢাকা দিতে ওর মনের দ্বন্দ্ব। কই ওর মুখের হাসি পৌঁছায়নি তো চোখ অবধি। ওর চোখের আয়নায় অনীক বারবার নিজেকে খুঁজে পেলেও কই আজ তো পাচ্ছে না খুঁজে।

-“কে ছেলেটা?”

অনীকের আচমকা এই আক্রমনের জন্য তৈরী ছিল না হিরু। মুখ দিয়ে “আ।।।” উচ্চারণ করেও তাই শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে বলল, “অনীক।”

অনীক শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ওর হিরুর দিকে, মুখে স্মিত হাসি, যেন, “আমাকেও মিথ্যেও বলতে হবে রে? পারিস না তো সেটা। প্রেমিকের আগে তো আমি তোর বন্ধু, তাও এত দ্বিধা? কোন শব্দ বিনিময় নেই, শুধু চোখের ভাষাই যথেষ্ট।

তখনই বাজল ফোনটা।

।।২।।

সেদিনকার পর থেকে অনেকগুলো সম্পর্ক নিজেদের সমীকরণ বদলে ফেলছিল একটু একটু করে। অনীক – হিরু – আদি। হিরুর চোখের ভাষা সেদিনই অনেক কিছু বলে দিয়েছিল অনীককে। আর তাতে ঘৃতাহুতি দিল আদির বারংবার ফোন, হিরুর মোবাইলে।একবার-দুবার-তিনবার, যেন ওপাশের মানুষটা একটিবার কথা বলার জন্য অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। হলোও তো তাই, আবারও একবার অনীককে মিথ্যে বুঝিয়ে বেরিয়ে গেল হিরু। ঐ জন্যই তো চোখ দুটো অবনত ছিল হিরুর। এমন কী ঘটে গেল হিরুর জীবনে একদিনে, যে আজ অনীককেও মিথ্যে বলতে হচ্ছে।

তখন থেকে ভাবতে ভাবতে মাথাটা পুরো ধরে গেল অনীকের। হিরু এমনিও কিছু বলছে না, জানতে চাইলেও বলছে না। ওদিকে আর ক’দিন পর ওদের বিয়ের বাড়ি বুক হয়ে যাবে। কি করছে ও? কেন করছে এটা? ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে উঠল অনীকের। পুরো ঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়া। সকাল থেকে একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই চলেছে। বারান্দায় বেরিয়ে ফোনটা রিসিভ করল ও।

**************

আজ অফিস থেকে যে করেই হোক একটু আগে বেরবে হিরু|এটাই সঠিক সময় |সব 

সেদিনকার রাত্রের উন্মত্ত আদিকে দেখে অবাক হয়ে গেছে হিরু। কেউ কারো জন্য এতটা পাগল কী ভাবে হতে পারে, এত রাত্রে উন্মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে হিরুর ফ্ল্যাটের নীচে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে। হিরু যেতে আপত্তি জানিয়ে দিলেও পরে দোকান যাওয়ার জন্য নীচে নেমে দেখে আদি তখনও ওভাবেই…

জাস্ট অবাক হয়ে গেছল হিরু, আদির চোখে হিরুর জন্য পাগলামো দেখে। আর এই পাগলামোই ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কূল কিনারা কিচ্ছু নাই, কিচ্ছু না ভেবেই ওর থেকে ৭-৮ বছরের বড় একটা মানুষের সাথে ও-ও আজ পাগল হচ্ছে। কেন? উত্তর একমাত্র হিরুই জানে, কিন্তু এখন বলার সঠিক সময় নয় | শুধু এটুকু জানে, এসব কিছুর মধ্যেও অনীককে কোনভাবেই কষ্ট দেবে না। তাই, আজ। ১টা বাজতে চললো, উঠে পড়ল হিরু।

ঘড়ির কাঁটা গড়িয়েছে ৩টের ঘরে। হিরুর নাম্বারটা ডায়াল করেও রেখে দিল অনীক। থাকে, দরকার নেই আর। চেষ্টা করেও নিজের কাজে মন বসাতে পারছে কই? আর জোর করে অধিকার ফলানোর মতো পুরুষমানুষ অনীক নয়।

আজ বড্ড মনে পড়ছে, ওর আর হিরুর প্রেমের প্রথম দিককার কথাগুলো। সব কেমন পাল্টে গেল না? আচ্ছা হিরু, তোর আর মনে পড়ে না তাই না?

ফোনটা বাজল আবার,

-“তুই তাহলে সিওর তো?

-“আরে হ্যাঁ, সিওর।”

-“ওকে, রাখ এখন।” 

সিগারেটের কুন্ডলীকৃত ধোঁয়ায় সামনের দৃষ্টিটা ঝাপসা ততক্ষণে অনীকের।

**************

-“হ্যাঁ, আদিত্য বাবুকে বলুন আমি এসছি, খুব দরকার।”

-“আপনি বসুন ম্যাডাম, আমি ডেকে দিচ্ছি। ম্যাডাম চা-কফি দেব, না ঠান্ডা কিছু?”

-“ওসব কিছু লাগবে না, আগে তুমি ভিতরে গিয়ে খবর দাও।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই গেটকিপার ভিতরে নিয়ে গেল হিরুকে। কাল রাত থেকেই আদির ধূম জ্বর। এখন জ্বরটা নেই, কিন্তু শরীর একদমই কাহিল। ওঠার ক্ষমতা নেই। হিরুকে দেখেই আদির ক্লান্ত চোখে যে উচ্ছাস, তা হিরুর চোখ এড়াল না। কিন্তু হিরু তো আর এসব ভাবতে চায় না, এই জন্যই ওর এখানে আসা।

আদির ঘরের সোফাটায় বসতে না বসতেই আদির মা এসে হাজির। দু-চারটে কুশল বিনিময় ছাড়া আর বিশেষ কিছুই বললেন না বটে, কিন্তু মুখটা দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলার আছে ওনার। যাওয়ার আগে দেখা করে যেতে বলে বিদায় নিলেন, ততক্ষণে শরবত স্ন্যাক্স হাজির। নাহ, কিছু বলার আর সুযোগ পাচ্ছে না হিরু। ও জাস্ট যে ভাবে হোক, বলতে চায়। বেশী ভাবলে আবার মন আর মগজের যুদ্ধ শুরুর হয়ে যাবে যে। ঘর ফাঁকা হতেই আদিত্য হাতের ইশারায় বোঝাল সোফার এদিকটায় এসে বসতে। আদির মুখোমুখি বসতে বসতে নিজের ভিতর কথাগুলো গুছিয়ে নীল হিরু। বরাবরই সোজা কথা বলার মানুষ, কিন্তু ঐ চোখদুটোর দিকে তাকালেই ওর মাথায় ভীড় করে অনেক কিছু | বেশী না ভেবে চোখে চোখ রেখেই হিরু বলল, “কোনদিনও ভাবিনি এভাবে কখনো তোমার বাড়ি আসবো , কিন্তু এই অসময়ে ভর দুপুরে বাধ্য হয়ে এসেছি আমি। আমি জানি তুমি এখন অসুস্থ, এগুলো এখন বলা ঠিক না, যথেষ্ট অমানবিক। কিন্তু বিশ্বাস করো আদি, আমার আর কোন উপায় নেই।”

হিরুর হাতটা ধরল আদি। বেশ গরম হাতটা, আবার জ্বর আসছে হয়তো, চোখগুলো হালকা লাল। অগোছালো এই আদিকে পরিপাটি আদির থেকেও যেন আরও বেশী ভাল লাগছে।

“কী হয়েছে?” আদির শান্ত গলার স্বরে যেন সব দুশ্চিন্তা মুখ লুকোয় আড়ালে।

আদির হাতটা ছেড়ে চাদরটা আদির গায়ে ভালোভাবে ঢাকা দিতে দিতে বলল হিরু, “আমার জীবনটা তোমার ভালবাসায় অগোছালো হয়ে যাচ্ছে আদি। এলে যখন আগে এলে না কেন? আমি যাই হয়ে যাক, পারব না অনীককে এত কষ্ট দিতে।”

হিরুর হাত দুটো আদি নিজের বুকের কাছেই ধরে রেখেছিল পরম যত্নে, হিরুর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, “তোমার ব্যাপারে সব জেনে তো তোমায় ভালোবাসিনি হিরু। আমি যে আর পারছি না নিজের সাথে যুদ্ধ করতে। যুদ্ধটা চালাতে পারলে তোমায় আর বলতে ছুটে যেতাম না সেদিন, কিন্তু আমি তো সত্যিই পারছি না। মিথ্যে মিথ্যে পুরুষমানুষের কঠিন আবরণটা কীভাবে বয়ে বেড়াব রোজ? এভাবে তো বাঁচা যায় না। আচ্ছা, অনীক আমার থেকেও বেশী ভালবাসে তোমায়?”

-“অনেক দেরী হয়ে গেছে আদি, আমি অনীককে কোনদিন মিথ্যে বলিনি, কিন্তু এখন রোজ বলছি, এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সব তো ঠিকই ছিল, কেন এলে বলো তো আমার জীবনে? কেন? তোমায় তো কষ্টই পেতে হবে আমায় ভালবেসে। আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমায়-ও ।।।”

কথাটা শেষ করতে পারল না আর হিরু। কথা বলতে বলতে হিরুর দুচোখ বেয়ে নোনতা জলের ধারা। আদির কারণে? এটা কী করে মানবে আদি? আদি ওর ক্লান্ত অশক্ত হাতেই হিরুকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে গভীরভাবে মিশিয়ে দিল হিরুর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট, আচমকাই। হিরু, আদি কেউই প্রস্তুত ছিল না এই মুহূর্তের জন্য। আবেগে, ভালোবাসায় কী ঠিক ভুল-এর হিসাব হয়? হয় না হয়তো। হিরুর ঠোঁট পেরিয়ে আদি ওর মুখটা ডুবিয়ে দিল হিরুর ঘাড়ের কাছে। হিরুর গন্ধটায় নিবিড়ভাবে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো আদি, হিরু যেন শুধুই ওর। কবে যে এত নিজের হয়ে গেল, কে জানে । নিজের দুহাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে যেন আঁকড়ে রয়েছে হিরুকে, কেউ যাতে কেড়ে নিতে না পারে ওর হিরুকে ওর থেকে। কখনও যে ভালবাসা আসেইনি জীবনে। টাকা, লালসা সবই এসেছে, শুধু ভালবাসাটা ছাড়া। কতক্ষণ এভাবে হিরুকে নিজের বুকে আঁকড়ে রেখেছিল কে জানে। হিরুও পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে নিচ্ছিল ভালবাসার ঘ্রান, ঠিক-ভুলের হিসেব পেরিয়ে। আদির ফোনটা বাজতে টনক নড়ল ওদের।

***************

অগোছালো নিজেকে গুছিয়ে নেবার, সরিয়ে নেবার মরিয়া চেষ্টা করছিল হিরু, হিরুর হাতটা ছাড়ার কোন প্রশ্নই নেই, হিরুর হাতটা ধরে আদি আবারও বলল, “আমি পারব না তোমায় ছাড়া বাঁচতে। জানি না কী হয়েছে, কবে হয়েছে, কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্লিজ, যেও না।।।” 

আদিত্যর কথা শেষ করতে না দিয়েই হিরু নিজের ব্যাগটা নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল, ” আজ যা হলো তা আর কোনদিনও যেন না হয়, এর আপ্রাণ চেষ্টা আমি করব। সবকিছু সবার জন্য নয় আদি। আমি পারব না ঠকাতে। অলরেডি অনেক ভুল করে ফেলেছি, ক্ষমা চাইতে হবে আমায় অনীকের কাছে। প্লিজ আর কখনো এস না আমার লাইফে। সামনে আমার বিয়ে, ১২ই অঘ্রান। প্রার্থনা কোরো যেন ভাল থাকি, তুমিও গুছিয়ে নাও না জীবনটা।”

আদির এলোমেলো পোশাকের মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল গলার চেন টা, খুব ভুল না হলে লকেটে কারোর ছবি জড়িয়ে রয়েছে আদির বুকে।হিরুর ভুল হয়নি তা জানে হিরু |

-“ভালো থেকো, আর দূরে থেকো।” আর কিছু উত্তরের অপেক্ষা না করে হন হনিয়ে বেরিয়ে গেল হিরু, একেবারে গিয়ে থামল বড় রাস্তায়। হিরু আর পারল না বেশীক্ষন নিজের মনের অন্ধকারটাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে। একটা আবাসনের নীচেই হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল হিরু যখন, তখন ঘড়িতে প্রায় ৪:৩০টা।

**************

সময় কতটা গড়িয়েছে, হিসেব নেই হিরুর। শুধু জানে ও এখন কারো সঙ্গ চায় না, শুধু নিজের সাথে সময় কাটাতে চায়। বাগবাজারে মায়ের ঘটে বসে নিবিষ্ট মনে দূরে নৌকার চলাচল দেখছিল হিরু। সূর্য পাটে বসেছে কিছুক্ষণ হলো। নিজের লাল-হলুদ আভা পরম যত্নে ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশটায়। সবাই ঘরে ফিরছে, নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

খুব শান্তির এই জায়গাটা। আগে কলেজ থেকে ফিরতে ও আর অনীক প্রায়ই আসতো এখানটায়। একসাথে হাতে হাত রেখে স্বপ্ন দেখতে একসাথে ঘর বাঁধার। ঠিক ঐ পাখিগুলোর মতন। হিরুর ফোনটা অফ। ইচ্ছে করেই অফ করে রেখেছে ও। কারো সাথেই আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। ওর নিজের প্রতি কেমন যেন একটা ঘেন্না হচ্ছে, আবার খানিকটা করুণাও, আবার হতাশাও। সবকিছু কেমন জটিল হয়ে গেল, হঠাৎ করেই। কিন্তু ও তো অনীককে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না তা ও ও জানে । আদ্যপ্রান্ত ম্যাচিওর্ড আদির ওর জন্য এই পাগলামো, বারবার তো এটাই চেয়েছে হিরু। এমনকী আজও, আদির বুকে যেটুকু মুহূর্ত নিজেকে সঁপে দিতে হয়েছিল, আশপাশের আর কোন চিন্তায় মাথায় আসেনি, শুধু… ।

আর একদিকে অনীক, সেই কবে থেকে ওরা একসাথে, ওর নাড়ী নক্ষত্র, শিরা উপশিরা সবকিছু যদি কেউ সব থেকে ভাল জানে ওর মা বাবার পর, তবে সে হলো অনীক। অনীক ওকে বুঝবে তো?কিন্তু, চোখ দুটো সেই থেকে ঝাপসা,মানুষের মন বড় জটিল, এর তল পাওয়া কী এতই সোজা? কতক্ষণ সময় কেটেছে, কে জানে? হাতের ঘড়ি, মোবাইল ফোন সবকিছু বিচ্ছিন্ন করে নির্জন, একাকী ঘাটে সন্ধ্যেটা একান্ত নিজের সাথে কাটিয়ে একটু নিজেকে শান্ত লাগল হিরুর। আরেকটা ঝড় যে বাকী। অনীকের সাথে বোঝাপড়াটা এবার করতে হবে তো।

পঞ্চম পর্ব

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with