আলো-আবছায়ায় (পঞ্চম পর্ব)

পঞ্চম পর্ব

ছন্নছাড়া হয়ে নিজের ঘরের বারান্দাটায় বসেছিল আদি। বিগত দু-চারদিন হাতে তুলিটা ধরার ক্ষমতাও ছিল না। এই ক’দিন রঙ ছাড়া কাটিয়ে আজ বড্ড হাসফাঁস করছে যেন মনটা, আর তাই বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলো না। কিছু আঁকার সরঞ্জাম এইখানেই দিয়ে যেতে বলেছে। ও একটু আঁকতে চায় – এই নীল আকাশটা, সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো, কিছু একটা ক্যানভাসে আজ তুলে ধরবেই। কতক্ষণ শরীর সায় দেবে জানা নেই, কিন্তু আজ মনটাকে আর বন্দী রাখতে চায় না ও। কোথাও যেন আজ হিরুর জন্য খুশী আদি, হিরু যদি আদিকে ছেড়ে সুখী হয়, তবে তাই হোক। এভাবে কোনদিন ভাবেনি ও, আজ এভাবে ভাবতেও ভালো লাগছে, হয়তো হিরু বলেই। হিরুর টোল পড়া মিষ্টি হাসির কারণ নাই বা থাকুক আদি, কি যায় আসে।।। ওর হিরুর জন্য ভালবাসাটা তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, ওটা তো ওর একান্ত নিজের। ওর ক্যানভাসে হিরু তো ওর দিকেই চেয়ে থাকে, মুগধ দৃষ্টিতে, এটা তো আর কেউ পারবে না নিয়ে নিতে। এভাবেই থাকুক না হয় ভালোবাসা। রংতুলিতে ভরে উঠুক আজ সাদা ক্যানভাস। ওর মনের রক্তক্ষরণ ফুটুক সাদা ক্যানভাসে, এভাবে ঠিক কাটিয়ে দিতে পারবে, হিরু ভাল থাক, সুস্থ থাক।

***************

একুয়ারিয়াম-এর ভিতর কমলা মাছটা পিটপিট করে চাইছে ওদের দিকে, প্রথম থেকেই ওদের ভালবাসার মুহূর্তগুলোর সাক্ষী এই মাছটা, একদম প্রথম থেকে ও আছে এদের সাথে, কিন্তু আজ মাছটাও হয়তো অবাক পানে চেয়ে, কী হয়েছে এদের? সেই হাসি-মজা, আদর-ভালবাসা, খুনসুটি কোথায় হারিয়ে গেল সব?

অনীক আর হিরু সামনে সামনি বসে। মা বাবার চলে গেছে দিন-দুয়েক হলো। ওনারা না গেলে অনীককে সেভাবে পাচ্ছিলোই না হিরু। আজ তাই সব বলেছে ও অনীককে। প্রেমিকেরও আগে বন্ধু, তাই কিচ্ছু লুকোয়নি আর, এটুকু আনুগত্য তো অনীক-এর প্রাপ্য। হিরু অনীকের হাত দুটো ধরে যখন ওর সাথে ঘটা সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিচ্ছে, তখন অনীক শুধু হিরুর চোখের দৃষ্টিটা পড়ছিল। না, হিরু অনীককে চরম সত্যিটা বলেনি।সঠিক সময়ের অপেক্ষা শুধু | কিন্তু হিরুর দিকে তাকিয়ে অনীক শুধু নিজেকে একটা কথাই বোঝাচ্ছিল, কোথায় লেখা আছে, একজনের সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন তাকে ভালোবাসাকালীন আরেকজনকে ভাল লাগতে পারে না? যদি বা হয় সেটা অন্যায়, সেটাই বা কোথায় লেখা? অন্য একজনকে ভালবেসে ফেললে তাতেই বা মানুষটা কী করবে? ভালোবেসে ফেলেছে। হ্যাঁ, ব্যস। এরপর? এরপর কার ভালো থাকাটা তার কাছে বেশী ইম্পরট্যান্ট সেটা তো একান্ত নিজের সিদ্ধান্ত। কিন্তু হিরু এগুলো কেন করছে? এতো কৈফিয়ত কেন? খুব প্রয়োজন কী?

সবটা বলে হিরু অনীকের হাতদুটো নিজের দুহাত ধরে বসেছিল, মাথা নীচু, যেন অপরাধী। অনীক হিরুর মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলল, “তোর ভাল থাকাটা আমার কাছে জরুরী। তুই শুধু তোরটা ভাব। তুই ভাল না থাকলে আমিও।।।” কথাটা আর শেষ করতে পারল না অনীক, হিরুর কপালে পরম ভালবাসায় একটা চুমু এঁকে উঠে পড়ল অনীক।ব্যস, এটাই তো চায় হিরু, আর নিজেকে ঘেন্নাটা করছে না… 

-“তুই আমার কথাটা।।।”

-“না আর কোনো কথা নয় হিরু। তুই শুধু তোর ভালো থাকাটা ভাব আগে, বাকীটা আমি সামলে নেব।”

না, আর দাঁড়ায়নি অনীক। চলে গেল নীচে। হিরু বসে রইল একা। এই ঘর, ওদের সাজানো দুস্টু-মিষ্টি সংসারটা, এই সবই ওর জন্য, ওরই অপেক্ষায়। সবই ওর, কিন্তু ও যা কিছু করছে,তার প্রভাব যে ওদের সংসার এও পড়ছে, হিরু র যে এখন সংসার করার থেকেও আরো বড়ো দায়িত্ব কাঁধে | এখন কী? কিন্তু।।। সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে যে, এই ঘরের পর্দা, সোফায় কুশন, রান্নাঘরের ক্রোকারি সেট, বুক সেল্ফের প্রিয় বইটা, কফিমাগ, বারান্দার রেলিং সবকিছু শুধু ওদের দুজনের ছোঁয়াই যে চেনে। তার মধ্যে থেকেই আর একটা আগাছা, বেড়ে উঠছে তরতরিয়ে। নাহ।

**************

এই ক’দিন পর নিজেকে একটু সুস্থ মনে হচ্ছে আয়নায়। ক’দিন হলো হিরু মা বাবার কাছে এসেছিল, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। আজ বাড়ি থেকেই অফিস এসছে। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একদিকে যখন, তখন একটা মানুষই পাশে থেকে, মা। মা-র কাছে থাকাটা খুব দরকারী ছিল হিরুর জন্য, একলাফে যেন সমস্ত খারাপ লাগা, বিরক্তি, ডিপ্রেশন, অশান্তি ধুয়ে মুছে সাফ। মুখে চোখে জল দিয়ে নিজের সীটে বসল হিরু।

।।২।।

(কয়েকমাস পর)

“আরে না না, আপনি আজই ডেলিভারি দিয়ে দিন। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। নমস্কার।”

“মিষ্টি রেডী। এবার শুধু ফুলটা দেখে নিতে হবে একবার।” বলতে বলতেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল মৈনাকবাবু, হিরুর বাবা।

হ্যাঁ, কাল হিরু আর অনীকের এনগেজমেন্ট। প্রস্তুতি তুঙ্গে, আর একমাস পর বিয়ে। এসেই গেল। সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নের মুহূর্ত একটার পর একটা। হ্যাঁ, হিরু ভালোই আছে, ঐ যে অনীকের মুখের চওড়া হাসিটা, ওটাই হিরুর ভালো থাকার রসদ, হিরু সেটা জানে,শুধু কাজ টা বাকি, আর তাই।।। আর বাড়তি একটা কথাও আর প্রশ্রয় পায়নি হিরুর মনে। 

এই ক্যাটারিং-এর লোক এল বোধ হয় ওদিকে। হিরুর ছিমছাম বাড়িটা এখন লাল সোনালী আলোয় দিব্যি সেজেছে, হালকা শীতের আমেজ পড়তে শুরু করেছে এই সময়টায়। কাল হিরুও সাজবে, মিষ্টি গোলাপী কাতানে, অনীকের জন্য।

****************

হাতের অনামিকায় আংটিটা আরেকটা আঙ্গুল দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাইরে দেখছিল হিরু। মেয়েদের এই সময়টাই মনে হয় সব থেকে আনন্দের। একটা যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি, ঘরে বাইরে। কিন্তু সে যুদ্ধে রক্তক্ষরণ নেই, আছে অনেকদিনের অপেক্ষা আর ভালবাসার এক মধুর পরিণতি, ভালবাসার মানুষটাকে আজীবনের জন্য নিজের করে পাওয়ার লাস্ট মিনিট প্রিপারেশন, খাটনি কিন্তু শান্তি।।। নিজের মনে ভাবতে ভাবতে কখন যে ওর ঠোঁটের কোণে হাসিটা উঁকি দিতে শুরু করেছে, ও নিজেও জানে না। আজ ওই ইন্টারভিউ-এর জন্য আসা এখানে, এই হোটেলটায়, এটা হলেই ছুটতে হবে ওকে, ওদিকে মা, অনীকের মা সব অপেক্ষা করছেন, লাস্ট মিনিট কেনাকাটার আছে কিছু, ও না গেলে নাকী হবে না।

***************

ইন্টারভিউটা শেষ করে বেরতে বেরতে প্রায় পৌনে ছ’টা হলো।ইচ্ছে করেই একটু দেরি করলো হিরু, বেরতে যাবে তখনই আটকাল সিকিউরিটি গার্ডটা।

-“ম্যাডাম, এখন আর এদিকটা দিয়ে বেরনো যাবে না, আপনি প্লিজ ২নং গেটের দিকে চলে যান।”

না, ঘুরে চলে যেতে কোন প্রব্লেমই ছিল না। একটা জটলা ছিল ছোটখাটো, এই হোটেলে এরকম বহু ব্যক্তিত্বই আসেন, মিটিং ইন্টারভিউ লেগেই থাকে, কিন্তু ঐ ভিড়ের মধ্যে দুধ সাদা ব্লেজার্সের লোকটাকে দেখেই চোখ আটকে গেল হিরুর।

কালো শার্টের উপর দুধ সাদা ব্লেজার্স, হাতের দামী ঘড়ি, চোখে দামী ফ্রেমের চশমা। ভিড় ঠেলে সিকিউরিটি যাকে ভিতরে নিয়ে আস্তে ব্যস্ত, সে আর কেউ না… আদি। আবারও একবার, প্রায় ছ’মাস পর, আদির মুখোমুখি হিরু।

এককোণে হালকা নীল কুর্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা হিরু, আদির চোখ এড়ায়নি। হিরুর চোখে চোখ পড়তেই হিরু একটু নড়ে চড়ে বসল। কিন্তু আদি একবারও আর দাঁড়াল না, যেভাবে এসেছিল, সেই গতিতেই বেরিয়ে চলে গেল।

একটু অদ্ভুত লাগল ওর, যে ক’টাদিন আদির সাথে মিশেছে, ও সেলিব্রিটি সুলভ কোন আচরণ অন্তত হিরুকে দেখায়নি। সেখানে এরকম ব্যবহার এতদিন পর, কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে খানিক ভেবে ওদিকের গেটের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই রিসেপশন থেকে ডাকল মেয়েটা, “ম্যাম, মিঃ পাল, মানে মিঃ আদিত্য-র সেক্রেটারি একবার আপনার সাথে দেখা করবেন। উনি এখুনি আসছে, প্লিজ একটু বসুন।”

কথা শেষ হতে না হতেই মিনিট খানেকের মধ্যেই মিঃ পাল এলেন। খুবই ভদ্র মানুষ, আর ভীষণ বিনয়ী। আদিত্যবাবু একবার দেখা করতে চান। কিন্তু হিরুর আদৌ সময়, সুযোগ বা ইচ্ছে আছে কী না প্রথমেই জেনে নিলেন। হিরুর ক্যালকুলেশন মিলে গেল,সময় আসন্ন |মিঃ পাল-এর পুরো নাম অসীম পাল। অসীম বাবুর সাথে এর আগে কখনো পরিচয় হয়নি হিরুর। অসীমবাবুর সাথে যখন হোটেলের লবি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল হিরু, একটাই শব্দ মনে আসছিল, এতটা পরিবর্তন এই ক’দিনে কারো হয়? নাকী ওরই ভুল হচ্ছে ।।। ওহ, এই তো এসে গেছে।

**************

হোটেলটা ১৮তলার, এটা ১৫তলা, নীচের সবকিছু খুব ছোট ছোট, ব্যস্ত কলকাতা মহানগরী। ঝলমলে আলো, ঝাঁ চকচকে ঘরে সুসজ্জিত টেবিলে ওয়াইনের বোতল, আর দুটো গ্লাস। এসি রুম হলেও চলছে না, বরং উত্তাল হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে ঘরের রঙিন পর্দাটা। কাঁচের স্লাইডিং দরটা পেরিয়ে লাগোয়া ব্যালকনি, সেখানেই হাতে ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল আদি।

অসীমবাবু হয়তো না জেনেই সৌজন্য বিনিময়ত করালেন, পূর্বপরিচিত নয় এমনই ভান করে দুজন হাত মেলালো | আদি অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেই কথা বলছে, অনেকটা স্টারডমে মোড়া। গ্ল্যামারের আড়ালে ঐ লোকটা কোথায়? যাকে হিরু চিনতো। যে হিরুর জন্য একদিন পাগল ছিল, ছুটে এসেছিল শুধু হিরুর জন্য, কোথায় সে? আদির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে এই কথাগুলোই মনের মধ্যে ঘুরছিল হিরুর, “বসো, দাঁড়িয়ে কেন?” আদির কথায় টনক নড়ল হিরুর, “মা-কে একটা ফোন করে দি”, বলে ব্যালকনিতে গিয়ে ফোন থেকে ডায়ালটা করছিল হিরু। মা বকাবকি করলো, হিরু চুপচাপ শুনে নিল, কিচ্ছু বলল না আর এখন। কথাটা বলতে বলতেই চারপাশটায় একবার চোখ গেল হিরুর, কী অসম্ভব উজ্জ্বল চারদিকটা, উপর থেকে নীচটা ছোট, আর আকাশটা কত কত কাছে। এত সুন্দর এখন লাগছে শহরটাকে, একটু আগে অকালের বৃষ্টিতে একটা বৃষ্টি ভেজা সোঁদা গন্ধ ঝোড়ো ঠান্ডা হওয়ার সাথে হিরুর মুখে এসে ঝাপটা লাগাল। চোখ বুজে কয়েক মুহূর্ত উপভোগ করছিল হিরু। হঠাৎ করেই যেন একটা অদৃশ্য জীবনী শক্তি এসে গেছে হিরুর মধ্যে। পিছনে ঘুরতে যেতেই ধাক্কা খেল আদির সঙ্গে। আদি কখন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। চশমাটা খুলে রেখেছে আদি, হাতে ওয়াইনের গ্লাসে রেড-ওয়াইন। 

একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিল হিরুর দিকে। 

কিন্তু ওয়াইন খাওয়াটা কি ঠিক হবে এখন ওর সাথে? আচ্ছা ওর তো মিটিং ছিল, এভাবে তাহলে এখন হিরুর সাথে।।। অনেকগুলো কথা একসাথে পাক খাচ্ছিল হিরুর মনে।

আদিত্য যেন হিরুর মনের কথার রেশ ধরেই বলল, “পোস্টপন্ড করেছি মিটিংটা, আর ওয়াইনে কিচ্ছু মেশানো নেই, নিশ্চিন্তে খেতে পারো।” বলেই হিরুর দিকে একভাবে তাকিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল আদি। ঠোঁটের কোণে সেই হাসিটা।

আদিত্য ভীষণ ম্যাচিওর্ড, গ্ল্যামার আর স্টারডমে মোড়া জীবনে হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। আর হয়তো সেইজন্যই, হিরুর জন্য যখন এই পরিণত মানুষটা পাগল প্রেমিক হয়ে গেছিল, জাস্ট বেশি কিছু করতে হয়নি । তবে হ্যাঁ এই ম্যাচিওর্ড পার্সোনালিটিটা দেখে মুগধ হয়েছিল হিরু।

স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে হিরু আজ আবারও একবার ভাসতে চলেছে । ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল হিরু, ওর গোলাপী লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটটা যখন ওয়াইনে ডুবল, সেদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই আদি বলল, “এবার বলো কেমন আছো? বিয়ে কবে করেছো?”

।।৩।।

হাতের আংটিটা একবার নিজে দেখে আদির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, হিরু, “তোমার observation power তো মারাত্মক আদি। হুম আর মাস দেড়েকের মধ্যেই বিয়ে।”

-“বাহ, দারুন।” বলেই নিজেই হিরুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আংটিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জেনেই তোমায় ভালবেসেছিলাম। আমার নিজেরও এখন অবাক লাগে ভাবলে, আমি এত ম্যাচিওর্ড হয়ে এতটা ইমম্যাচিওর্ড-এর মতো কাজ করলাম কী করে? তোমার মনে হয় না?”

তখনও হিরুর হাতটা আদির হাতেই ধরা, হিরু বুঝতে পারছে না এর কী উত্তর হয়? “ভালোবেসেছিলাম”, “ইমম্যাচিওর্ড-এর মতো কাজ”, কথাগুলো খুব কানে লাগছিল হিরুর। কোথাও যেন ভয় টা কাজ করছিলো মনে, তীরে এসে তরী না ডোবে |

-“তুমি কী এই কথাগুলো বলার জন্য আমায় ডেকেছ? আদি তুমি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছ যে আমি একজন জার্নালিস্ট, আমারও সময়ের দাম আছে। তুমি।।।”

কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছিল না হিরুর। “ভালবেসেছিলাম”, মানে কী? ইমম্যাচিওর্ড-এর মতো কাজ করে ভুল করেছে বলে কী বলতে চাইছে? হিরুর নিজের অজান্তেই একটা ভয় কাজ করছিল, ও নিজে সেটা খেয়ালও করেনি।

-“তুমি অযথা রেগে যাচ্ছ হিরু, আমি বললাম কাউকে এতটা না জেনে বুঝেই যদি তার জন্য এতটা পাগলামো করা যায়, তাহলে তাকে জানলে, চিনলে, বুঝলে তার জন্য কতদূর যাওয়া যায় বলতো?”

হুট করেই আবার নামল অকাল বৃষ্টিটা। লাগোয়া ব্যালকনি থেকে সরে এলো আদি হিরুকে নিয়ে, আচমকা। হালকা ঝাপটা আসছিল জলের, আদি হিরুর হাতটা করে ঘরে ঢুকে এল।

সোফায় বসে গ্লাসটার দিকে দেখতে দেখতে বলল, “তোমার সম্পর্কে কী-ই বা জানি আমি? কিছুই না, অথচ কিছু না জেনেও তোমায় পাগলের মতো ভালবেসেছি। হ্যাঁ, এতে তোমার কোন দায় নেই, তোমায় ভালবাসতে তো বাধ্য করতে পারি না আমি। বহু ঘুমহীন রাত কেটেছে আমার, ঘুমের ওষুধও সঙ্গী হয়েছে কখনো কখনো। জানি, লোককে বললে লোকে হাসবে। এই ক’দিনে এসব নাটক কে করে? কিন্তু ভালবাসা দিনক্ষণ মেপে হয় না, এটা আমি এখন বুঝি। তোমার কোন দোষ নেই হিরু, কিন্তু আজ তোমায় দেখে মনে হলো এই কথাগুলো তোমায় বলি। যাক গে, তোমার সময় নষ্ট করলাম কী খুব?” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশী সময় নিনি, জাস্ট আধ ঘন্টা, আচ্ছা বললে না তো বিয়েটা কবে? অনীক কেমন আছে?”

হিরুর কিছু বলার ছিল না আর। সামনে যেন একটা বন্ধ দরজা, একটা দমকা হাওয়া যেন প্রবল জোরে ধাক্কাচ্ছে দরজাটা, ইচ্ছে করছে ছুটে বেরিয়ে যেতে, শুধু পায়ের বাঁধনটুকু ছিঁড়তে হবে,বহুদিন এর অপেক্ষার পর । হিরু আর জিতের খুশি ধরে রাখতে পারছিল না।হিরু আর নিজেকে ধরে রাখেনি , চোখের জল গাল বেয়ে বইতে শুরু করেছে, মাটিতেই মাথা নত করে বসে পড়ল হিরু।

এতদিন ধরে হিরু যার জন্য এত কিছু করেছে এত compromise এত নিজেকে ছোট হতে দেখেছে আয়নায়, সে মানুষটা আজ… 

আদি হিরুর সামনে বসে হিরুর হাত দুটো নিজের হাতে ধরল শক্ত করে। আজ বহুদিন পর আদির বলিষ্ঠ হাতটা হিরুর হাতকে ছুঁলো, হিরু চোখের জল না মুছেই বললো , “আমি আর পারছি না আদি, I really really love you, কিন্তু আমি তোমার সাথে ভালো থাকতে গিয়ে অনীককে কি করে শেষ করে দিয়ে আসি বলো? না আমি ওর সাথে ভালো আছি, না ওর সাথে থেকে তোমায় মন থেকে সরাতে পারছি। কি করবো আমি আদি? বলো, কী করবো এবার? অনেক-এর জীবনটা শেষ করে নিজে কিভাবে সুখী হবো আমি? আর ওকে সুখী করতে গিয়ে নিজে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি তোমায় ছাড়া ভালোই ছিলাম, শুধু বেঁচে ছিলাম না। উদ্দেশ্যহীন একটা রাস্তায় ঘুরে মরছি শুধু। আমি আর এভাবে সত্যি পারছি না, আদি।” 

আদি হিরুর থুতনিটা তুলে বলল, “হিরু, তাকাও আমার দিকে। একটা কথা শুধু বলো, তুমি নিজে ভাল না থাকলে তো অনীককেও ভাল রাখতে পারবে না, এটা কেন বুঝছো না।” হিরুর চোখ দুটো মুছিয়ে আদি বলল আবার, “নিজেও ভাল থাকো, অনীককেও ভাল থাকতে দাও। তুমি যে পথে এগোচ্ছো, তাতে কেউ ভাল থাকবে না, বোঝো সেটা। তুমি আমার ওপর একটু ভরসা করো, আমি গিয়ে কথা বলবো সবার সাথে, কিন্তু এভাবে নিজেকে আর আশপাশের মানুষকে কষ্ট দিও না প্লিজ।” হিরুর চোখ দুটো মুছিয়ে দিচ্ছিল আদি। 

হিরু হাঁ করে আদির দিকেই তাকিয়েছিল। এখনও যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর,কে বুঝবে কে আসল কে নকল এ পৃথিবীতে… 

সেদিন ফিরতে প্রায় রাত ৮টা হলো হিরুর। আজ বহুদিন পর মন থেকে যেন একটা বড় পাথর কেউ তুলে নিয়েছে। আদি পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার পর একদৃষ্টে ওর গাড়ির দিকেই চেয়েছিল কিছুক্ষন। না, আজ আর এই দৃষ্টি লুকোনো নয়, আজ আর কোন ভয় নেই। 

লিফটে উঠে নিজের মনে আজ বহুদিন পর গুনগুন করে গান গাইছিল হিরু। এখন মা এসে আছে ওদের সাথে… 

মা-র সাথে আজ ভিন্ডি খাওয়া নিয়েও কোন ঝামেলা লাগলো না, ঘরে এসে শুলো যখন হিরু, বারান্দা দিয়ে মেঘ কেটে পরিষ্কার আকাশে ঝলমল করছে তারাগুলো, আর সাথে পূর্ণিমার চাঁদ।

**************

তথাকথিত প্রেম বলে কিছু হয়নি আদি আর হিরুর মধ্যে, অনেকটা দূরত্বের পর কাছে পাওয়া, অজস্র জটিলতা এসবের বাইরেও যে একটা মিষ্টি অনুভূতি, একসাথে হাত ধরে চলা, বিয়ের পর কে কোন কাজটা করবে সে সব ভেবে খুনসুটি – না, এগুলোর কোনোটাই হয়নি।

আদি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা বলে একসাথে ট্রামলাইন ধরে হাঁটা, একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া, গঙ্গার ঘাটে শান্ত নদীর দিকে চেয়ে সূর্যাস্ত দেখা এগুলো কোনদিনই হয়তো সম্ভব না, জানে সেটা আদি । কিন্তু আজ যে বড় ইচ্ছে করছে। আজ যে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে একসাথে ভিড়ের মাঝে মিশে যেতে, কিংবা ভিড় থেকে আলাদা কোথাও একদম দূরে, কিংবা কোন পাহাড়ের কোলে একসাথে হারিয়ে যেতে, বা হয়তো সবুজ উপত্যকায় একসাথে সূর্যের আভা গায়ে মাখতে।

আজ বৃষ্টি ভেজা জানলার কাঁচের পানে চেয়ে এই সব আজগুবি চিন্তাই করছিল আদি । আজ বড় ইচ্ছে করছে এই বৃষ্টি ভেজা দিনে দূরে লং-ড্রাইভে যেতে, এই ভিড় থেকে অনেক দূরে। দুপাশে সবুজের সারির বুক চিরে যে রাস্তাটা, সে রাস্তা ধরে কোন এক অজানা গ্রাম, অজানা যেখানকার লোক, যেখানে কেউ চেনে না, আর শুধু ও আর হিরু । ভাবতে ভাবতেই ফোনটা নিয়ে হিরুকে একটা মেসেজ করলো আদি । এই হিরুর রিপ্লাই ও চলে এলো|হিরু রাজি? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না আদি ।-“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।।।” গুনগুনিয়ে বারান্দায় বৃষ্টি আর ঝোড়ো হওয়ার সামনে খানিক দাঁড়াল আদি। আদি আর গান !ভাবা যায় !!!ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি… খানিক পরে বেরোবে। কোথায়? কে জানে। কোনো নিরুদ্দেশের পথে হয়তো।

ষষ্ঠ পর্ব

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with