আলো-আবছায়ায়

১ম পর্ব

।।১।।

“চল, চল বেরো ৬টা বাজে প্রায়” বলতে বলতেই সিগারেটটা শেষ করে রূপালীর সাথে পা বাড়াল নীহারিকা। আর পাঁচটা সাধারণ ঘরের মেয়ের সাথে নীহারিকাকে মেলাতে গেলে ভুল করবেন প্রথমেই। অবিন্যস্ত চুল, চোখে কাজলটাও পরিপাটি নেই। না, লিপস্টিকের বালাই নেই, দু-আঙুলের ফাঁকে সিগারেট, টিশার্ট জিন্স, স্নিকার্স, হাতের কালো ব্যান্ড আর কলার বোনের ট্যাটু সমেত একটা অন্যরকম দমকা হাওয়াই হলো নীহারিকা।

নীহারিকার জীবনের ফান্ডা খুব সিম্পল – আমার জন্য যদি কারো ক্ষতি হয়, তাহলে আমি নিশ্চয় নিজেকে সংশোধন করবো, কিন্তু, শুধু আমার ‘ভাল’র কথা ভেবে আমায় জ্ঞান দিতে আসেন যদি, তাহলে বস…প্লিজ আসুন।

তাই, যত্রতত্র সিগারেট খাবার বিরোধী ও, নিজের সুখটানের জন্য অন্য কাউকে বিপদে ফেলার অধিকার নেই ওর। ড্রিংকও ততটুকুই করে যতটুকু সামলাতে পারবে, মদ খেয়ে মাতলামো করে লোককে বিপদে ফেলেনি কখনও। মুখের মিষ্টি হাসিটা দিয়ে সবার মন জয় করে ফেলেছে মেয়েটা। নীহারিকার মুখের হাসি দেখে পাঁচ বছর আগেই পাগল হয়েছিল অনীক , আজ ও পাগল হয়, তবে হাসির সাথে সাথে পাগলামীতেও। নীহারিকার পাগলামি দেখেই ওকে মনে হয় একটু বেশীই ভালবেসে ফেলে ওর চারপাশের লোকজন। ভীষণ স্বচ্ছ, স্পষ্ট ওর কাছে চারপাশের পৃথিবীটা। অনর্থক ভেবে জটিল করে না ও সবটা। যেটা ভাল লাগে, লাগে, যেটা লাগে না, লাগে না, ব্যস।

অনীক আর নীহারিকার বিয়েটা গান্ধর্ব্য মতে, মানে লিভইনে আছে, প্রায় চার বছর হলো। দুই বাড়ি থেকে প্রথমে প্রবল আপত্তি তো ছিলই, কিন্তু নীহারিকা যা মেয়ে, ওর ভাললাগা আর অনীকের ভাললাগা একসাথে থাকায় যখন তখন আর আপত্তি কোথায়? আর এতে তো কারও ক্ষতি হচ্ছে না। আর ‘লোক’-এ কী বলবে? সেটা ভেবে দূরে থেকে ওরা যা কষ্ট পাবে সেটা আশেপাশের লোক লাঘব করতে পারবে তো?

ব্যস, শুরু হয়েছিল এভাবেই ওদের ছোট্ট সংসারটা। নীহারিকা কিন্তু রীতিমতো গুছিয়ে সংসার করে। একটা মেয়ে যে সিগারেট খায়, ড্রিংকও করে যখন ইচ্ছে হয়, সে যে সংসারটাও করতে পারে, রান্নাও পারে, এটা তো মানুষ বিশ্বাসই করে না। কিন্তু এটাই সত্যি। ওদের ছোট্ট 1BHK ফ্ল্যাটের ব্যালকনির বেলফুলের গাছটা থেকে শুরু করে, বিছানার চাদরটা, ঘরের ম্যাচিং পর্দা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের নুনের কৌটো টা সবটা নীহারিকার নিজে হাতে সাজানো।

আর রান্না?

যতই ব্যস্ততা থাক, অনীক বলবে, আর সেটা নীহারিকা করবে না, এটা অসম্ভব, দিনের হাজার ব্যস্ততার মাঝেও অন্তত একটা পদ, হ্যাংলা টার জন্য নীহারিকা করবেই। নীহারিকার হাতের রান্না খেয়ে সুখ্যাতি করেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।

তাই, সবমিলিয়ে, দুজন সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভালবাসায় বেশ ভালোই আছে। অনীক ও ওর হিরুর জন্য পাস্তা বানাতে ছাড়ে না যেমন, তেমনই হিরু ওর হ্যাংলার জন্য রোববার লুচি করবে না? ইম্পসিবল জাস্ট।

বেলঘড়িয়ার মন্দাকিনী এপার্টমেন্টের থার্ড ফ্লোরের ৪০ নম্বর ফ্ল্যাটটার লাল নীল বেগুনী সংসারটা তাই খুব দামী এই মানুষদুটোর জন্য।

**************

-“কীরে ওঠ, তুই এরপর কখন রেডি হবি, খাবি, বেরোবি, আমি কিন্তু এবার বেরিয়ে যাব।”

নীহারিকাকে আদর করে হিরু বলেই ডাকে অনীক | হিরুর চক্ষুদান পর্ব চলার মাঝেই পিছন থেকে আবেশে জড়িয়ে ধরল অনীক,  হিরুর চুল থেকে আবার সেই মায়াবী সুগন্ধটা ভেসে আসছে। আরও একটু জড়িয়ে ধরল হিরুকে ও। চোখের কাজল তখন হ্যাংলার অত্যাচারে গেছে খানিকটা ঘেঁটে, হ্যাংলা বলে ওকে নাকি এভাবেই আরও মায়াবী লাগে। অনীকের দিকে ঘুরে ওর দিকে তাকাল হিরু,

-“আবার বাঁদরামো করবি?”

-“হুম, আমি তো তোরই বাঁদর।”

আলতো করে অনীকের কপালে একটা চুমু এঁকে দিল হিরু, আর একটা চুমু ওর ঠোঁটে, ঘটনা বেশী দূর এগোবার আগেই তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে ছাড়িয়ে নিল হিরু।

-“তাড়াতাড়ি রেডি হ, দেরী হয়ে যাচ্ছে।” বলেই অনীকের মাথাটা একটু ঘেঁটে দিয়ে সরে গেল হিরু।

“খাবার টেবিলে রাখা আছে, খেয়ে নিস, বেরলাম। বাই।।।” বলতে বলতেই ধড়াম করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল হিরু।অনীক পেশায় সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। আজ ওর অফ ডে, তাই আজ একটু ল্যাদ খাওয়াই যায়। টেবিলে ঢাকা খাবারটা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আবার বিছানায় বসল অনীক | খাটের পাশেই রাখা ওদের ছবিটা। কত্তদিন হয়ে গেল!

প্রথম নীহারিকাকে অনীক দেখেছিল কলেজে এডমিশনের সময়। কী ছটপটে, পাগলী মেয়ে রে বাবা। সবাই দাঁড়িয়ে চুপচাপ, আর ঐ মেয়েটাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল এদিক থেকে ওদিক। তখনই ওর চোখ পড়েছিল পাগলীটার দিকে।

তারপর কলেজে এডমিশন। একই ক্লাস, ক্লাসের মেয়েদের থেকে ছেলেদের সাথেই হিরু ঘুরত থুড়ি মারপিট করত বেশী। ফোন নম্বরটা আর চাওয়ার সাহস হয়নি অনীকের, ঐ মারকুটে মেয়ের থেকে। একরকম চুরিই করেছিল ওর নম্বরটা। ফোনে প্রথম তো কিছু বলতেই পারেনি টেনশনে। পরদিন কলেজে এসে সটান মুখের উপর বলেছিল হিরু, “ফোনে কথা বলতে পারিস না তো নম্বরটা নিয়েছিলিই কেন?”

“কী সাংঘাতিক মেয়ে” সেদিনই মনে হয় এই ভয়-ডরহীন, আধপাগলী, স্বচ্ছ মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছিল অনীক।

সেই শুরু অনীক আর হিরুর বন্ধুত্বের। অনীকের মনে হিরুর জন্য এই বিশেষ জায়গা বহু আগে থেকেই ছিল, কিন্তু যেদিন কলেজ ফেস্টে ঐএলোমেলো মেয়েটাকে গুছিয়ে পাট-ভেঙে শাড়ী পড়তে দেখেছিল, সেই সুন্দরী বঙ্গনারীকে না বলে আর থাকতে পারেনি সেদিন। লাল শাড়ী, নির্মেদ চেহারা, মাখনের মত গায়ের রঙ, মায়াবী চোখদুটো, ঠোঁটে হালকা গোলাপী আভা, কানের মুক্তো, আর ঐ পাগল করা দেহের সুবাসটা পাগল করে দিয়েছিল অনীককে।

ব্যাকস্টেজে হিরুর আঁচল টা টেনে ধরেছিল মত্ত অনীক সেদিন। হিরুর চোখ রাঙানিকে সেদিন ছাপিয়ে গেছিল মত্ত অনীকের প্রেম নিবেদনের তাগিদ। ওর হাতটা ধরে নিজের মনের সব কিছু উজাড় করে দিয়েছিলো একদম। ওর নরম গাল দুটো নিজের দুহাতে ধরে, সেদিন হিরুর কাছে নিজের জন্য ভালবাসা চেয়ে নিয়েছিল ও। ওর অজান্তেই আলো আঁধারির মাঝে, ঐ উৎসবের মাঝে সবার অলক্ষ্যে এক হয়েছিল ওদের ঠোঁটদুটো। কতক্ষণ…খেয়াল নেই। বেশ কিছু পরে হিরুকে ছেড়েছিল অনীক। চঞ্চল হিরু সেদিন ছিল শান্ত নদীর মত। কিচ্ছু বলেনি আর, বাড়ি ফিরে গেছল। হিরু তারপর থেকে কখনো “হ্যাঁ”ও বলেন, “না”ও বলেনি।

কখন যে ওর হাতটা ধরে ওর সাথে এতটা পথ চলে এলো বুঝতেই পারেনি। অনীক এরপর লাইন চেঞ্জ করে অন্য কলেজে ভর্তি হলেও, সম্পর্কটা থেকেই গেল।

***************

বেলটা বাজল ফ্ল্যাটের, ডেলিভারিটা এলো বোধ হয়। ভাবনায় দাঁড়ি টেনে উঠে পড়ল অনীক।

।।৩।।

“আজই তাড়া আর আজই এত জ্যাম। উফফ।” নিজের স্কুটিতে বসে নিজেই বিড়বিড় করছিল হিরু। আর বারবার ঘড়ি দেখছে, তার মধ্যে মারাত্মক গরম। উফফ, এই তো সিগন্যালটা ছেড়েছে। এবার জাস্ট উড়তে হবে, তাড়াতাড়ি স্পিড তুলতে লাগল হিরু। সামনের গাড়িটা বারবার পথ আটকে দিচ্ছে। ধুর বাবা, এত সকলে মিলে জ্বালালে হয় নাকি! গাড়িটার গা ঘেঁষে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে বাঁক নিতে গিয়েই ঘটল বিপত্তিটা।

***************

“উফফ, যেত। আরেকটু হলেই প্রাণটাই যেত। এত কীসের তাড়া বলুন তো এই বয়সে।” বলতে বলতেই গাড়ি থেকে নামল ছেলেটা। ছেলে বলা ঠিক না, বয়স টা হিরুর থেকে ৫-৬ বছর বেশীই হবে।

আপাতত উল্টে পড়ে রয়েছে হিরু। কনুই-এ, হাঁটুতে কেটেছে, তার মধ্যে জ্ঞানের বর্ষণ। মুখটা এখনও রাস্তার দিকেই। হেলমেটটা থাকায় আর বড় কিছু ঘটেনি। হাতে ভর দিয়ে উল্টো দিকে উঠল মুখ ঘুরিয়ে হাত পা ঝাড়তে ঝাড়তে।

ফিরে তাকাল জ্ঞান দাতার দিকে। আর দেখেই মাথাটা জ্বলে উঠল…

নিজেদের গাড়ি আছে বলে কী ভাবে রাস্তাটা পুরোটা ওদের? আশ্চর্য।

চোখে হাফরিম চশমা, স্বচ্ছ কালো ফ্রেম, কালো শার্ট, ফুলস্লীভটা কনুই অবধি ভাঁজ করা, হাতের ঘড়িটাও কালো, এমন কী গাড়িটাও কালো। ব্ল্যাক ম্যানিয়াক, খুব পছন্দ মনে হয় কালো রঙ। তেমনি কালি জুবান, পড়ে গেল বেচারা হিরু।

-“দেখুন নিজের চারচাকা আছে বলে কী সব রাস্তাটা আপনার? একটু সাইড দিতে কী হচ্ছিলো?আশ্চর্য। তখন থেকে হর্ন দিচ্ছি, আপনার জন্যই হলো এটা। আমার স্কুটির যা ক্ষতি হয়েছে, চুপচাপ ক্ষতিপূরণ দেবেন।”

ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে থামল ও, হাঁটু কেটে যে রক্ত পড়ছে, সেদিকে খেয়াল পড়ল সামনে অপরিচিত লোকটার কথায়।

-“আপাতত, আপনার ক্ষতিপূরণ হোক, বাকীটাও আমি সামলে নেব, চিন্তা নেই।”

-“আমার ক্ষতি মানে?”

ইশারা বরাবর নিজের পায়ের দিয়ে তাকিয়ে হুঁশ ফিরল রগে অগ্নিশর্মা হিরুর।

**************

অফিসের কাজের বারোটা বেজে তেরোটা। ক’দিন ছুটির পর আজ জয়েনিং, কোথায় তাড়াতাড়ি পৌঁছবে, তা না, এসব উটকো ঝামেলা। ওই লোকটার গাড়িতেই হাসপাতাল গিয়ে ফার্স্ট-এড করিয়ে অফিসের পথে এখন হিরু।

আজ বসের কাছে ঝাড় খাওয়া আটকানোর সাধ্যি কারো নেই। একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংও ছিল, ইন্টারভিউ-এর টাইমও দেওয়া, ভাগ্য ভাল, মিঃ রায় চৌধুরীও এখনও পৌঁছননি। তাই একটু বাঁচোয়া। ভীষণ চেনা লাগছে মানুষটাকে, কোথাও যেন দেখেছে, কিছুতেই মনে পড়ছে না এখন।

হিরু পেশায় একজন জার্নালিস্ট, আর আজ ওদের এই অফিস-উইংটার ৫০বছর পূর্তি উপলক্ষ্যেই আমন্ত্রণ মিঃ রায় চৌধুরী এর। সেজন্যই এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ, আর তার দায়িত্বেই হিরু। কিন্তু এখন তো সব ঘেঁটে ঘ।

-“আজ শুধু আপনার জন্যই এতটা ঝামেলায় ফাঁসলাম আমি, স্কুটিটাও কবে পাবো ঠিক নেই, ধ্যুত।” বিরক্তির স্বরে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মুঠো পাকিয়ে সামনে ঘুষি মারতে গিয়েই বুঝল, এখন সঠিক সময় নয়। এখন আপাতত হাতে মারাত্মক লাগছে।

ওর কান্ড কারখানার দিকে তাকিয়ে খানিক হাসল মনে হয় অপরিচিত মানুষটা। এতক্ষণে একটু আড়চোখে ওইদিকে তাকাচ্ছে হিরু, এতক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচিতে ভাল করে তাকায়ওনি। বেশ হ্যান্ডসাম, আর কী বডিস্প্রে ইউজ করে কে জানে, গন্ধটা মারাত্মক, কেমন একটা সম্মোহনী ব্যাপার আছে। ব্ল্যাক শার্ট, ব্ল্যাক বেল্ট, ব্ল্যাক ট্রাউজার্স, এর মধ্যে দিয়ে পুরুষালী বলিষ্ঠ চেহারাটা bjha যাচ্ছে ভালোমতো, ছেলে হিসেবে রঙ বেশ পরিষ্কার, ফর্সা গালে হালকা দাড়ির আভা। কতক্ষন আড়চোখে তাকিয়ে ছিল জানে না হিরু, ব্রেক কষতেই টনক নড়ল। ওহ, এসে গেছে অফিস। 

ভদ্রলোক, হুম এতক্ষনে অপরিচিত থেকে ভদ্রলোকে উন্নীত হয়েছে মানুষটা। ভদ্রলোক বলতে হবে, দরজাটা খুলে হিরুকে নামতে সাহায্য করার জন্য হাতটা বাড়াল। কিন্তু নামতে যেতেই হঠাৎ মাথায় এলো, উনি অফিস চিনলেন কী করে?

-” বাই দ্য ওয়ে, আমি তো আপনাকে কিছুই বলিনি, আপনি জানলেন কী করে আমার অফিস?”

-“চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যায় ম্যাডাম”, বলেই এক প্রকার জোর করেই বলিষ্ঠ হাতে ওর হাতটা চেপে ধরলো লোকটা।

।।৪।।

অফিসে নিজের ডেস্কে একটু শান্ত হয়ে বসল নীহারিকা, বসতে না বসতেই বসের ডাকাডাকি শুরু। একেই এতো দেরী, তার ওপর আজ এমনিতেই কাজের চাপ।

তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হতে উঠল নীহারিকা, তখনই অনীকের ফোন। ফোনটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল ও।

***************

একটু টাচ-আপ দিয়ে নিয়েই তাড়াতাড়ি হলের দিকে পা বাড়াল ও, ১৫ মিনিটের একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আর তারপরই ওর কাজ শুরু। হলের কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখ পড়ল।।।।

একী! এতো সেই অপরিচিত লোকটা। ওহ মাই গড, এই তো মিঃ আদিত্য রায় চৌধুরী। হে ভগবান।।। এই জন্যই এত চেনা লাগছিল। ইন্টারভিউ-এর জন্য রিসার্চ ও সব দিন ই করে, শুধু আজই করেনি ভেবেছিলো অফিস গিয়ে ম্যানেজ করে নেবে টাইম তো আছেই, কিন্তু একে যে কারণ এ চেনা লাগলো সেটা ই যদি হয় তাহলে তো… নাহ ও যেভাবে এগিয়েছে এতদিন ওর ভুল হচ্ছে না… তাই-ই তো, ওকে পৌঁছে দিয়ে লোকটা কোথায় গেল ও তো খোঁজও করেনি একবারও। সামনাসামনি কখনো দেখেনি বলেই ওর মনে পড়ছিলো না এতক্ষণ, কিন্তু এবার যখন… ok then focus…

হলের মধ্যে আলো-আঁধারি তে মনে হয় না নীহারিকাকে দেখতে পেয়েছে বলে। নাকি দেখতে পেল? হ্যাঁ, এদিকেই তো তাকাচ্ছে। এবার তো ওকেই ইন্টারভিউ টাও নিতে হবে। এরকম এম্বেরেসিং সিচুয়েশনে আগে কখনো পড়েনি এভাবে। পুরো অনুষ্ঠানটা চলাকালীন আর মিঃ রায়চৌধুরীর চোখের দিকে তাকাতে পারেনি হিরু। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আগে বেরিয়ে বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কী বলবে ও? ক্ষমা চেয়ে নেবে? কিছু বুঝতে পারছে না। এক্ষুনি যেতে হবে, নয়তো আবার ফোন করবে। খুব বেশী না ভেবে তাড়াতাড়ি রুমের দিকে পা বাড়াল হিরু।

**************

ইন্টারভিউটা শুরু করার আগেই সৌজন্যবোধের জন্য হাতটা বাড়াতেই ওপাশে থেকে মানুষটা বলল, “আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না – এসব বলার কোন প্রয়োজন নেই।”

কিছু শুরু হওয়ার আগেই আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হিরু। কী যে হচ্ছে আজ ওর সাথে, ধ্যুর।

“দোষটা তো দুজনেরই ছিল, তাই আর সরিটরি বলার দরকার নেই কারোর, আপনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি কতটা এম্ব্যারেসড। প্লিজ বি কম্ফোর্টেবল।”

কথাগুলো হাঁ করে শুনছিল হিরু। এত বড় মাপের একজন মানুষ, কিন্তু ব্যবহারে, কাজে আমাদের মতোই। উনি চাইলেই ওর এগেনস্টে কমপ্লেন করতেই পারতেন, ওর আজ চাকরি নিয়েও টানাটানি হতে পারতো, কত কিছু ভাবছিল ও কী বলবে। কিন্তু কোনরকম ভনিতা না করেই ওর আগেই সবটা বলে পরিস্থিতিটাই বদলে দিল মানুষটা।

-“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।” এই টুকুই বলতে পারল হিরু।

-“প্লিজ নো ‘স্যার’, আমায় আদি বলে ডাকলেই আই উইল ফিল কমফর্টেবল।”

-“ওকে, উমমম।।।।আদি।” 

কোনক্রমে এটুকু বলে হেসে ফেলল হিরু। সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যও।

এখনও অবধি খেয়াল করেনি, এই খেয়াল করল হিরু, মানুষটার হাসিটা মারাত্মক অ্যাট্রাক্টিভ। দেখলে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। আর চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল। চশমার কাঁচের মধ্যে দিয়েও সেই চোখদুটো যেন ওর ভিতর অবধি পড়ে ফেলছে।

কয়েক মুহূর্ত এভাবেই তাকিয়ে ছিল হিরু। হঠাৎই, আদির চোখ বরাবর ধাওয়া করে দেখল আদি কিছু না বলতে যাচ্ছে ওকে দেখেই। মন পাখিকে আর উড়তে না দিয়ে, ভাবনায় দাঁড়ি টানল হিরু।

-“আপনার নামটা ভারী সুন্দর, নীহারিকা। বাহ। তা ম্যাডাম, ইন্টারভিউটা শুরু করবেন কী? নাকি আবার কোন ঝগড়ার প্ল্যান আছে।”

-“আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমি তো বলিনি একবারও।”

-“আপনার গলায় আইকার্ডটা সবই বলে দিচ্ছে ম্যাডাম, কী করবো বলুন।”একবার ঘড়িটা দেখে, “আর খুব বেশী সময় দিতে পারব না কিন্তু।”

-“ওহ, সরি সরি স্যার।।।সরি আদি” বলে অবশেষে ইন্টারভিউ শুরু করল হিরু।

।।৫।।

রোজ এই বাড়ি যাওয়ার সময়ই বৃষ্টিটা শুরু হবে, আজও ফিরতে সেই লেট হবে। ভাবতে ভাবতেই শেডের তলায় স্কুটিটা আনতে গেল হিরু। এই বেলা বেরিয়ে পড়লে আর গাড়ি ছোটালে পৌঁছানো যাবে।

শেডের তলায় যেতেই মনে পড়ল, “আরে, স্কুটি তো সার্ভিসিং-এ। ওহ্হো,ইসস, এখন তাহলে ক্যাবই ভরসা।

পকেট থেকে মুঠো ফোনটা বের করে ক্যাব বুক করে দিল হিরু। রাস্তাটার সামনেই অপেক্ষা করছিল ও।

পাশ দিয়ে দেখল ওনার গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে, এত বড় মানুষ, নিজেই ড্রাইভ করেন। ওনার গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে যাওয়াটাই হাঁ করে দেখছিল হিরু। অন্যমনস্ক হয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাকে নিজের মুখে হাতে মিশিয়ে নিচ্ছিল হিরু, মেঘলা আকাশটা সূর্যের মুখটাকে ঢেকে দিয়েছে একেবারে।

হুশ করে গাড়িটা সামনে এসে দাঁড়াল হিরুর, প্রথমটা বুঝতে পারেনি। কাঁচটা নামাতেই ভিতর থেকে আদির গলা, “আজ তো আর স্কুটি নেই, আসুন আমি ছেড়ে দিচ্ছি।”

আদিত্যর চোখে চোখ রেখেই একগাল হেসে দিল হিরু, “লাগবে না, আমি ক্যাব বুক করে নিয়েছি” বলতে বলতেই হিরুর ক্যাব চলে এল। ক্যাবে ওঠার আগে “বাই” বলে চলে যাচ্ছিল হিরু।

“আপনার জন্যই ইউটার্ন নিয়ে এলাম, আর আপনি ক্যাব বুক করে ফেললেন, কী আর করা যাবে? আমারই কপাল খারাপ।” হালকা ফ্লার্ট করে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল আদি।

ক্যাবে চেপে জানলার কাঁচটা উঠিয়ে বসল হিরু। জানলার কাঁচে জলের ঝাপ্টা বাড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। হিরু চোখটা বুজেই ছিল। আজ সারাটা দিন কেমন করে কাটল সেইটাই ভাবছিল চোখ বুজে। ওর খুব প্রিয় একটা গান বাজছে ক্যাবে, “মন মোর মেঘের সঙ্গী।” ভীষণ প্রিয় ওর। হাত পায়ের চোট-এর জন্য হালকা ব্যাথাও বেড়েছে এখন। বাড়ি গিয়ে আজ কিছু অর্ডার করে নেবে,অনীক টা কী করছে কে জানে। আজ সারাদিনে তেমন ফোনই করেনি। ওদিকে ওর নাকি আজ অফ ডে , এই জন্যই রেগে যায় হিরু। চোখ বুজে গান শুনতে লাগল হিরু, কলকাতার বুকে আঁধার নামতে শুরু করেছে ততক্ষণে। বৃষ্টি ভেজা শহরের এই গন্ধটা হিরুর ভীষণ প্রিয়। ক্যাব থেকে নেমে নিজেদের আবাসনের নীচটায় বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল ও। ফোনে সার্ফ করতে করতেই চোখ গেল সামনের চায়ের দোকানটায়। এই ওটা আদি না?

চোখদুটো তৎক্ষণাৎ জানান দিল, ভুল। ধ্যুস, মিঃ আদিত্য রায়চৌধুরী, এত বড় একজন পেইন্টার , এখানে আসবে কী করে? কী সব আলফাল চিন্তা যত্তসব। মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে লিফ্ট-এর দিকে পা বাড়াল হিরু।

**************

দু’বার বেল বাজানো হয়ে গেল। ফোন করলেও ধরছে না। উফফ, কী যে করছে হ্যাংলাটা।

-“কীরে???” চিৎকার করেও তো শুনতে পাচ্ছে না, “ঘুমিয়ে গেল নাকি” বলেই দরজায় ধাক্কা দিতেই দেখল দরজাটা অলরেডি খোলা। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। দরজাটা খুলতেই চমকে উঠল হিরু।

২য় পর্ব

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with