আলো-আবছায়ায় (অন্তিম পর্ব)

ষষ্ঠ পর্ব

।।১।।

আজ সময় যেন কাটতেই চাইছে না, সময়ের থেকে বেশ খানিকটা আগেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে আদি। অপেক্ষা করতে করতেই ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছিল ও। আজ অনেক কিছু বলার আছে হিরুকে। এভাবে ও কোনদিন কখনো পাগল হবে, নিজেও ভাবেনি। একটা লং ড্রাইভ, দুপাশে ঘন সবুজ, বৃষ্টি ভেজা শহর থেকে অনেকটা দূরে, সঙ্গে পছন্দের গান আর পাশে ভালবাসার মানুষটা। আর কী চাই? আচ্ছা, মনে করে জিনিসটা এনেছে তো? একবার চেক করে নিলো আদি।

ঐ তো হিরু আসছে, মুগধ দৃষ্টিতে হিরুর দিকে তাকিয়ে রইল ও, একটা দুধে আলতা রঙের শিফন শাড়ী পড়েছে আজ হিরু, শাড়ীতে হিরুকে এত্ত মিষ্টি লাগছে, এই প্রথম এই রূপে দেখল হিরুকে। এতই মুগধ হয়ে চেয়েছিল, কখন হিরু গাড়ির কাছে এসে কাচে নক করছে, হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিল আদি।

দুধ সাদা ক্যাজুয়াল শার্টে আদিকে মারাত্মক লাগছে। আদির পাশে বসে সিট-বেল্টটা লাগাতে চেষ্টা করছিল হিরু, পারছে না। আদির দিকে তাকাতেই দেখল, আদি ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, চোখে কী যেন ছিল, জানে না হিরু। শুধু এই দৃষ্টি টা দেখলেই মাথায় আগুন জ্বলে যায় হিরুর, কিন্তু সেটা তো প্রকাশ করতে পারে না, কোথাও যেন কোন অতীত এ ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওকে ওই গভীর মুগ্ধ দৃষ্টি ।

আদি ওর দিকে তাকিয়ে সেই হাসিটা হেসে স্টার্ট দিল গাড়িটা। কাঁচটা নামিয়ে দিয়েছে হিরু ইচ্ছে করেই। আদি বারণ করছিল যদিও, কিন্তু ঐ কাচের আড়ালে এসির ঠান্ডা হাওয়ায় অভ্যস্ত জীবনটা আজ একটু বৃষ্টি ভেজা শহরটাকে কাচ দিয়ে নয়, সরাসরি দেখুক না, বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধটা মাতিয়ে দিক না মনটা, বৃষ্টির ঝাপ্টা লাগুক না একটু মুখে। চোখ বুজে পছন্দের গান শুনতে শুনতে স্বপ্নের দেশে হারিয়ে গেছল হিরু।

মন ভরে শ্বাস নিচ্ছে আজ যেন আদি। হিরু চোখদুটো বুজে কী ঘুমের দেশে? থাক, ঘুমোক, একদম পৌঁছে দিয়ে সারপ্রাইজ দেবে না হয়। ওর ঘুমন্ত মুখটাই ফিরে ফিরে দেখছিল আদি। কবে এই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলল ও? ও, আদিত্য রায়চৌধুরী কাউকে ভালবাসবে? এটাই কখনো বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে হিরুর চুলটা এলোমেলো হয়ে মুখের উপর উড়ছে অবাধ্য হয়ে, স্টিয়ারিং থেকে হাতটা সাবধানে সরিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিল মুখের উপর থেকে। আদির হাতের ছোঁয়ায় একটু যেন নড়ে চড়ে আবার চোখ বুজল হিরু। শহরের বুক চিরে তখন আদির গাড়ি বেশ অনেকটা দূরে।

***************

জায়গাটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, ওরা যখন পৌঁছাল তখন প্রায় দুপুর।

সারাটা রাস্তা হিরু দিব্যি ঘুমিয়ে এসেছে, এতক্ষণে চোখ খুলল, চোখ খুলেই দেখে সামনে একটা ফার্মহাউস গোছেরই বাড়ি। 

হিরুর চোখের প্রশ্ন অনুসরণ করেই আদি বলল, “এটা আমারই ফার্মহাউস। আগে আসতাম, এখন আর আসাই হয় না। বহুদিন পর এলাম। এসো।

হিরু আর আদি সামনের সুন্দর গোছানো বাগানটা পেরিয়ে, দরজার কাছে পৌঁছাল। দরজার কাছে একটা মিষ্টি গনেশের মূর্তি তার উপর জল পড়ছে, মাথার উপর আলো, মুগধ হয়ে চেয়েছিল ও। আদির ডাকে ভিতরের দিকে পা বাড়াল হিরু।

ভীষণ সুন্দর করে সাজানো ছিমছাম এই জায়গাটা। বাইরে বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া, যতদূর দেখা যায় শুধুই সবুজ, হিরু জানলায় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল দূরের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজে মোড়া ক্ষেতের দিকে। আদির আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল। হিরুর পাশটায় এসে দাঁড়াল আদি। বৃষ্টিতে অল্প ভিজেও গেছে। সাদা জামাটা গায়ের সাথে লেগে রয়েছে, সেদিকে চেয়েই হিরু বলল, “এখনও চেঞ্জ করোনি, ঠান্ডা লেগে যাবে যে।”

হিরুর কথাটা শুনে আদি ওর সেই প্রেমিক হাসিটাই হাসল হিরুর দিকে চেয়ে, যেটার জন্য যে কোন মেয়েই পাগল হবে। নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে এক লহমায় হিরুকে টেনে নিল কাছে। হিরুর চোখে চোখ রেখে বলল, “কথাটা কেমন বৌ বৌ শুনতে লাগছে, তার মানে কী।।।” বলতে বলতেই হিরুর নরম গালে নিজের গালটা ঘষে হিরুকে যেন আরেকটু আঁকড়ে ধরল নিজের কাছে। হিরু লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে।

হিরুর চুল থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে যেটা পাগল করে দিচ্ছে আদিকে। হিরুকে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে রেখেই প্রশ্ন করল আদি, “তা বৌ বানানোর জন্য শ্বশুরবাড়িতে কবে গিয়ে কথা বলব?”

হিরু সঙ্গে সঙ্গে বলল,”যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এমনিই অনেক দেরী হয়ে গেছে, এরপর আর।।।”

-“Okay, পরশু-ই যাই তাহলে?”

-“আবার পরশু? কালই চলো না।”

-“আচ্ছা দেখছি। তুমি… মানে… অনীককে বলেছ?”

কিছু না বলে হিরু মুখটা নামিয়ে নিল। আদি বুঝতে পারল, কিছু বলল না আর। হিরুর হাতটা ধরে ঘরের কোণের সোফাটায় বসাল। হিরুর পায়ের কাছটায় বসল, হিরুর হাতটা ধরে। হিরুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি অনুসরণ করেই বলল, “তোমায় অনেকগুলো কথা বলার ছিল, সেগুলো জানার দরকার আছে তোমার, অধিকারও।”

-“বলো না।”

হিরুর হাতদুটো ধরেই আদি বলল, “তোমার আগে আমার জীবনে অনেক নারীসঙ্গ ছিল হিরু। আর খবরে যা রটে তার সবটাই যে মিথ্যে তা নয়, তাই সব কিছু শুরুর আগে আমি তোমায় কিছু বলতে চাই। পরে আমি চাই না তুমি আমায় ভুল বোঝ, সবটা জেনে বুঝে তারপর তোমার যদি মনে হয়…”

-“তোমার যাই বলার থাকুক না কেন, কোন কারণই তোমার হাত ছেড়ে দেওয়ার কারণ হতে পারে না, আমি এত কিছু পেরিয়ে তোমায় পেয়েছি, আর…” 

হিরুর চোখটা ছলছল করছিল। আদির চোখ এড়ায়নি সেটা। “একটু দাঁড়াও” বলেই মনে হয় নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছিল। খানিকক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল হিরু। “বলো এবার। একটা ফোন এসছিল, বলো এবার।”

আদি মাথাটা নীচু রেখেই শুরু করল, “তোমার আগে আমার যাদের সাথে সম্পর্ক ছিল, তার মধ্যে কোনটা নিয়েই আমি সিরিয়াস ছিলাম না। পুরোটাই নিজের স্বার্থে, কিংবা সোজা ভাষায় বলতে পারো নিজের ফূর্তির জন্য। সম্পর্কটা… শারীরিক অবধিও ছিল।” এটুকু বলেই একবার হিরুর দিকে তাকাল আদি। হিরুর অবিচল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বেশ অবাকই হলো যেন আদি।

হিরু শুধু বলল,”তারপর?”

আদির হিরুকে এইমুহূর্তে আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো পরিস্থিতি ছিল না, বাইরেটা ঘন কালো মেঘে বেশ আঁধার।

আদি আবার বলল, “সবার নামও আমার ঠিক মতো মনে নেই, এটা যেন একটা নেশায় পরিণত হয়েছিল আমার। মানুষের আবেগ, ভালবাসা কোনকিছুর দামই ছিল না আমার কাছে। মানুষের শরীরে মনুষ্যত্বটা ছিল না আর বেঁচে। অনেক অন্যায় করেছি আমি, খ্যাতির চূড়ায় থেকে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহারও করেছি যথেচ্ছ, প্রিয়াঙ্কার সাথে আমি যা করেছি…

-“সে কে?”

-“প্রিয়াঙ্কাই একমাত্র মেয়ে, যাকে আমি আর চাইলেও কোনদিন ভুলতে পারব না। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটা মেয়ের যতটা ক্ষতি করা যায়…” আর কিছু বলতে পারল না আদিত্য। গলাটা বুজে এল।

হিরুর চোখে জিজ্ঞাসা, “মানে? কি এমন করেছিলে তুমি?”

-“কী করিনি, সেটা বলো। ওর সাথে সাথে ওর গর্ভে আমাদের সন্তানকেও সরিয়ে দিয়েছিলাম আমার প্রভাবের জোরে, নিজের চকচকে কেরিয়ারে যাতে কোন দাগ না লাগে। কিন্তু তখনও বুঝিনি, এই অনুতাপ আমায় এভাবে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। শুতে পারতাম না, বসতে পারতাম না। নতুন কিছু ভাবতে পারতাম না। পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি অপরাধবোধে। সুইসাইড করার কথাও এসছে মাথায়। ও, ওর বাচ্চাটা যেন আমায় তাড়া করতো। বিশ্বাস করো, আমি কিছুতেই পারছিলাম না স্বাভাবিক হতে। তারপর সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বাধ্য হই। অনেকটা সময় লেগেছে, ঐ ঘটনা থেকে বেরতে। জানি, এখন এসব বলার কোন মুখ নেই, কিন্তু এখন ওকে খুব মিস করি, এখন মনে হয়, ও আমার জীবনে, আমার কাছে থাকলেই বোধ হয় ভাল হতো। ওকে কোনদিন ভুলতে পারব না আর আমি। একে ভালবাসা বলে ‘ভালবাসা’ শব্দের অপমান আমি করব না, কিন্তু আমি… আমি জানি না।”

খানিকক্ষণের নৈঃশব্দ, আবার আদিই বলল, “তারপর তুমি এলে, তোমায় দেখার পর আমি শুধু এটাই ফিল করেছি, এটাই হয়তো আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার একমাত্র সুযোগ। তোমায় ভালবেসে, তোমায় সুখী করে।যদি প্রিয়াঙ্কার আত্মা শান্তি পায় , যদি আমি একটা সুস্থ মানুষের জীবনে ফিরতে পারি…যদি… আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। এগুলো আমি চেপে যেতেও পারতাম, কিন্তু আজ আমি তোমায় বলে সত্যি শান্তি পেলাম। তুমি ভাবতেই পারো, এতকিছুর পর আমায় বিশ্বাস করবে কী করে? প্রিয়াঙ্কার মতো অবস্থা তো তোমারও হতে পারে, ভাবতেই পারো। আমি জানি এত কিছু জেনে আমার উপর ভরসা করা যায় না, তাই আমি জোর করব না। তুমি ভেবে চিন্তে কী করবে জানিও, কিন্তু…”

এতটুকু বলে হিরুর গাল , কানের লতিতে, ঘাড়ে, খোলা চুলে আদি নিজের বলিষ্ঠ হাতটা দিয়ে জড়িয়ে ধরল। আদির চোখে অনুতাপ যেমন স্পষ্ট, তেমনই ওর হিরুর প্রতি ভালবাসাটাও স্বচ্ছ, তাতে কোন মিথ্যে নেই।

হিরুর চোখে জল, পাথরের মতো হয়ে গেছে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। আদি বাক্সটা বের করল, হিরুর সামনে হাঁটু মুড়ে তথাকথিত প্রপোজের স্টাইলে বসল আদি, “এই মুহূর্তটা, বিশ্বাস করো, এর আগে আর কারো সাথে হয়নি। এই মুহূর্তটা শুধু তোমার জন্যই, আর তোমার জন্যই থাকবে। পারবে আমার হাতটা ধরতে?”

হিরুর সামনে আদি, আদিত্য রায়চৌধুরী, হাঁটু মুড়ে বসে, হাতে রিং। এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে? কিন্তু হিরু কিছু বলতে পারলো না, মাথাটা নীচু করে বসে রইল কিছুক্ষণ , আদির কাছে এই মৌনতাই বলে দিয়েছে সমস্ত উত্তর। আর কিছু বলল না আদি, উঠে গেল ও, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বক্সটা টেবিলের উপর রেখে দিল। এখন বৃষ্টিটা ধরেছে খানিকটা, মেঘ কেটে মিষ্টি রোদও উঁকি দিচ্ছে। সবুজ গাছের পাতায় জল বিন্দুগুলো রোদ পড়ে চিকচিক করছে, মেঘ আর রোদ্দুর মিলে অদ্ভুত সুন্দর চারপাশটা। হিরু বলল, “আমায় একটু সময় দাও প্লিজ।”

হিরুর এটুকু বলতেই যেন শুধু বাকী ছিল, আদি সঙ্গে সঙ্গে হিরুর হাতদুটো নিজের বুকের কাছে ধরে কিছু একটা বলতে গিয়েও পারল না আর বলতে।।। ওর চোখ যেন খুশীতে উপচে পড়ছে, খানিক আশ্বস্ত হলো যেন, অপার কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নেড়ে শুধু বলল, “নিশ্চয়, তুমি নাও সময়।”

-“আমায় প্লিজ বাড়ি পৌঁছে দেবে, আমি একটু আজ একা থাকতে চাই।”

নাহ, আর কিছু বলেনি আদি, দুপুরে নাকে মুখে গুঁজে একটু খেয়েই বেরিয়ে পড়ল ওরা, হিরুটা একদম চুপ করে গেছে। আদি ড্রাইভ করতে করতে বারবার দেখছিল হিরুর মুখটা। কোন কথাই নেই আর ওর মুখে। আসার সময় না হয় ঘুমিয়ে ছিল, এখন যেন পাথর। আদির বলা রূঢ় বাস্তব টা মেনে নিতে সময় তো লাগবেই। কিন্তু সবকিছুর পরেও আদির আজ খুব হালকা লাগছে। আর কোন মিথ্যে দিয়ে অন্তত এই সম্পর্কটা শুরু হচ্ছে না। কোন লুকোচুরি নেই, কোন আড়াল নেই, সবটুকুই স্বচ্ছ।

****************

হিরুর বাড়ির কাছে যখন গাড়িটা পৌঁছাল, তখন বেশ রাত, ঘড়ির কাঁটা প্রায় পৌনে দশটা। হিরু গাড়ি থেকে নামার আগে শুধু আদির হাতটা ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, গুডনাইট আজ।”

আদি কিছু বলল না আর। হিরুর চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টে। হিরু চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল আদি গাড়িটা নিয়ে। নামার সময় হিরুর মুখে “থ্যাঙ্ক ইউ” টা শুনে একটু হলেও আশ্বস্ত হলো আদি। ও এটুকু তো বুঝেছে যে আদি অন্তত ওকে ঠকাতে চায় না। এটাই যথেষ্ট। নিক না সময়, ক্ষতি কী?

***************

বারবার ফোনের আওয়াজে ঘুমটা যখন ভাঙল আদির তখন ঘড়িতে সকাল ৭টা। কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিল ও, ঘুম আসছিল না কিছুতেই। নানান আজগুবি চিন্তা ভিড় করেছিল মাথায়। দামী পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো এখনও প্রবেশ করতে পারেনি, আদিত্য রায়চৌধুরীর ঘরে। আদি সদ্য ঘুম ভাঙা আবেশ জড়ানো গলায় বলল, “হ্যাঁ, হিরু, বলো।”

-“তুই টিভিটা চালা আগে।”

বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো আদির। গলাটা তো কৌশিকের, কৌশিক হঠাৎ এত সকালে, কী ব্যাপার?

-“মানে? কোন নিউজ চ্যানেলটা?”

-“তুই টিভি খোল না আগে, তাইলেই বুঝতে পারবি।”

-“কিন্তু কী হয়েছে টা কী? আচ্ছা দাঁড়া দেখছি।”

টলতে টলতে ঘুম চোখে বিলাসবহুল গোল খাটটা থেকে নেমে টিভির কাছে গেল আদি, রিমোট দিয়ে টিভি অন করে নিউজ চ্যানেলে দিল ও। তারপর…

***************

এই মুহূর্তে আদিত্য রায়চৌধুরীর বাড়ির সামনে থিকথিক করছে ভিড়, তিনখানা পুলিশ ভ্যান এলেও উন্মত্ত জনতা প্রেমিসেস-এর মধ্যে ঢুকে বেশ কিছু ভাঙচুর করেছে। দরজার কাছে পুলিশ দাঁড়িয়ে, অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আদিত্য-র নামে , কেসটা ফাইল করেছে অনীক ।আদি পুরোপুরি ক্লুলেস। তাহলে কী হিরুর কিছু হলো? নয়তো অনীক হঠাৎ… যাকে চেনে না, জানে না।

এর আগে যাই ঘটে থাকুক না কেন, হিরুর ব্যাপারে আদি যথেষ্ট সিরিয়াস, তাহলে হঠাৎ।

কিছুই কারণ বলছে না, পুলিশও এখনও অবধি মুখ খোলেনি, অ্যারেস্টটা কিসের জন্য? সেটা না জানলে তো আদি কিছু করতেও পারবে না। এর মাঝেই গেটকিপার আদির কাছে খামটা দিয়ে গেল। পুরো কিংকর্তব্যবিমুঢ় আদি, বারবার হিরুকে ফোনে ট্রাই করেও কোন লাভ হয়নি। ওতো চেনেও না অনীককে। তাহলে কেন???

খামটা খুলে দেখল একটা ছোট্ট কাগজে লেখা, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

এরকমই একটা “থ্যাঙ্ক ইউ” কাল হিরুও বলেছিল না? কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না আদির। আর অপেক্ষা করবে না বেশীক্ষণ পুলিশ, আদিকে নিয়ে পাড়ি দিল থানার উদ্দেশ্যে।যা কথা বলার থানায় গিয়েই হবে। বেরনোর সময় আদির চোখ বারবার খুঁজছিল, হঠাৎ করে কোথা থেকে কী হয়ে গেল? নিশ্চয় এর পিছনে বড় কোন মাথা আছে, সে জন্যই এখনো অবধি পুলিশও কিছু বলেনি, যাতে আদির আর কিছু করার না থাকে। ভ্যানে উঠল আদি, ওর এতদিন ধরে একটু একটু করে গড়া নাম, যশ, খ্যাতি একলহমায় আজ মাটিতে মিশে গেছে, এর থেকে বড়ো ক্ষতি আর কী হতে পারে? ছেড়ে দিল ভ্যানটা। আর ঠিক তখনই চোখ পড়ল আদির।।। ওটা হিরু না? ভিড়ের মাঝে অনেকটা পিছনে।।। কিন্তু ভ্যানের ধোঁয়ায় কিছু স্পষ্ট বোঝবার আগে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল ওর বাড়িটা।

অ্যারেস্ট-এর কারণ প্রিয়াঙ্কার মার্ডার

কেস, যেটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। আদিত্যর কালকের কনফেশন-এর রেকর্ডিংটাই ইন্টারনেটে ভাইরাল।

আজকের দিনটা বহু প্রতীক্ষিত। আজ সত্যিই খুব শান্তির দিন, হিরুর জন্য। আজ এতদিন পর ওর দিদিটার আত্মা শান্তি পাবে। হ্যাঁ, প্রিয়াঙ্কা হিরুরই দিদি। কিন্তু যখন ঘটনাটা ঘটেছিল, তখনও আদিত্য, দ্য আদিত্য রায়চৌধুরী হয়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রভাব ছিল যথেষ্টই। সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে কেস বন্ধ করে দিতে বেশী সময় লাগেনি তাই। সেদিন কিছু করতে পারেনি হিরু, জাস্ট কিচ্ছু না। নিজের মা বাবার অসহায় মুখটা দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। তখনও অনীক ছিল না ওর জীবনে। কিন্তু আজ আছে, আর আছে বলেই এটা সম্ভব হলো, ওর কন্ট্যাক্টস, ওর সাহায্য ছাড়া আজ এটা হওয়া সম্ভব ছিল না।

আর সম্ভব হয়েছে হিরুর অদম্য জিদ, ইচ্ছাশক্তি আর মারাত্মক অভিনয় ক্ষমতার জন্য। যেদিন থেকে নিজের মনকে ঠিক করে এই কাজের জন্য নিজের আত্মাহুতি দিতেও রাজি, সেদিনই ডিসাইড করে নিয়েছিল ঘুনাক্ষরেও বুঝতে দেবে না, অনীককেও না। অনীকও ভুল বুঝেছিল, কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না হিরুর, ও ওর লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে, আর তাই আদির ছোঁয়ায় ওর শরীরটা কেঁপে উঠলেও হাসিমুখে অভিনয় করে গেছে। ওর শরীরের পবিত্রতা রক্ষার থেকেও ওই শয়তানের শাস্তি পাওয়াটা বেশী জরুরী ছিল। কালও অভিনয় করে ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিল রেকর্ডারটা অন করে, ফোন এসেছিল এই অছিলায়। সবটা জানলে মা, বাবা, অনীক কেউই এই ভয়ংকর খেলাটায় জড়াতে দিত না ওকে।

অভিনয়ে এতো মাস ডুবে থাকা হিরু, ‘আদির প্রেমে পাগল’ -এই চরিত্রটার মধ্যে ঢুকে থেকে কোথাও যেন নিজেকে প্রশ্ন করত, “এভাবেও কেউ পারে? সত্যিই ও আদির জন্য পাগল নয়তো? “যখন একা তখনও আদির প্রেমে পড়া চরিত্রতেই ডুবে থেকেছে এই ক’মাস।রোজ একটু একটু নিজেকে পাঁকে নামিয়েছে,একটা নোংরা লোক বারবার ছুঁয়েছে ওকে, আর ও প্রেমিকা সেজে সেটা হতে দিয়েছে, বিশ্বাস অর্জন করেছে আদির, কিন্তু তাতে ওর কোনো অনুতাপ নেই, ও যা করেছে ওর দিদির জন্য| ওর প্ল্যান ফেল করতেই পারতো, কিন্তু জীবনের এই মরণ বাঁচন এর এই বাজিটা নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ওর | আদিও এতসব কিছুর পর সত্যিই ভুলে গেছিল সবকিছুর শেষে হিরু একজন জার্নালিস্ট। এটাই আদির জীবনের সব থেকে বড় ভুল। প্রেমে অন্ধ আদিকে শেষ করার এর থেকে ভালো উপায় আর কি হতে পারতো। ঠিক যেটা আদি আজ এতদিন এতগুলো মেয়ের সাথে করেছে, প্রিয়াঙ্কার সাথে করেছে। আদি যেভাবে ঠকিয়েছে, ঠিক সেভাবেই আজ নিজেই ঠকলো…হয়তো হিরুর প্রতি আদির এই ভালোবাসা সত্যি কিন্তু তাতে কি এসে যায়… 

আদির থেকে দূরত্ব বজায় রাখলে যে আদিই এগোবে, এটা ভালভাবেই বুঝে গেছিল হিরু। ঠিক যেমন পতঙ্গ ধেয়ে যায় আগুনের দিকে, তেমনই আদি আবার ছ’মাস পর ফিরে আসে হিরুর জীবনে,কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটাই মনে হচ্ছিলো হিরু আদির দিকে ধেয়ে গেছে পতঙ্গের মত |

সেদিনকার ইন্টারভিউটাও একটা প্ল্যানই ছিল, কোন ইন্টারভিউ ছিল না সেদিন হিরুর। ওখানে, আদির ইন্টারভিউ আছে, সেটার খোঁজ রাখা একজন জার্নালিস্ট হয়ে এমন কোন বড় ব্যাপার না। আর তারপর বাকী কাজগুলো আদির হিরুর প্রতি উন্মত্ত প্রেমই করে দিয়েছে।

এত বছরের পুরনো একটা ঘটনা এভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে আদি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। আর আদি অনীক আর হিরুর ফ্ল্যাটটাই চিনত, হিরুর নিজের বাড়িও কোনদিন দেখেনি নাতো হিরুর বাড়ির লোকজনকে।।। ব্যস, হিরুর কাজে আর তেমন অসুবিধে হয়নি তারপর।

সবটা জানানোর পর আজ অনীক পাশে ছিল বলেই…সব জেনে আর লিগ্যাল ব্যাপারে জড়াতে দেয়নি ও হিরুকে… সবশেষে আজ ও জিতেছে,হোক না প্রথম ধাপ, এই তো সবে শুরু,এখনও অনেকটা পথ বাকী। হিরু জানে, আজ ওর অভাগী দিদিটাও হাসছে। সামনের অঘ্রাণে হিরু অনীক এর বিয়ে… না সব ভুল বোঝাবুঝি পেরিয়ে আজ ওরা আবার একসাথে… ঠিক যেমন টা ছিল এতদিন | 

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with