দ্বিতীয় পর্ব
ঘরটায় একটা লাল আভা ছড়িয়ে, লাল রঙের মোমবাতি, লাল রঙের ল্যাম্পশেড, সবটা লাল। হিরু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল অনীক। চমকে ওঠার সাথে সাথেই অনীক আবেশে জড়িয়ে নিল হিরুকে। প্রেম পরশের একমুঠো লাল আভায় মাখামাখি সব কিছু, আদরে আবেশে। খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছিল হিরু অনীকের সাথে, হাতের চাপ পড়তেই টনক নড়ল, “উফফ, কী ব্যাথা!”
-“একী রে, কী বাধিয়ে এসছিস আবার।”
অনীকের প্রশ্নের উত্তরে তখন আপাতত প্রেম স্থগিত রেখে সবটা বলল হিরু। শুনে হাসবে না রাগবে বোঝা দায় ছিল অনীকের।
হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসতেই হিরুর পছন্দের – মটন দোপেঁয়াজা।
হ্যাঁ, অনীক বেশ ভালোই রাঁধে। এক্ষেত্রে, হিরুকে বেশ ভাগ্যবান বলা চলে।
-“আজ হঠাৎ এত স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট ?”
টেবিলে সাজানো অনীকের নিজে হাতে বানানো প্রতিটি ডিস হিরুর পছন্দের, মটন দোপেঁয়াজা, রাইস, পায়েস, স্যালাড সবটুকু।
-“আজ তো সারাদিনে ফোনও করিসনি তেমন। কী ব্যাপার বলতো?”
হিরুর মুখের কথা কেড়ে নিয়েই টেবিলের ওই দিক থেকে এই দিকে বক্সটা খুলে হিরুর সামনে ধরল অনীক ।
-“তোকে এবার বৌ বানাবো, তাই এত আয়োজন। রাজী কী না বল।”
এতটাই আনএক্সপেক্টেড ছিল ব্যাপারটা যে হিরু কিছু বলতেই পারছিল না কয়েক মুহূর্ত। আর্দ্র চোখটাই যেন সবকিছুর উত্তর দিয়ে দিচ্ছিল।
টেবিল ছেড়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল হিরু অনীকের বুকে। অনীকের বুকে মিশে যাচ্ছিল ও আনন্দে। চোখের জলে ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল এতদিনকার অপেক্ষা।
অনীকের দিকে চেয়ে বলল, “হবোই তো।”
আর দেরী করেনি অনীক। হিরুর অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিয়ে ঠোঁটটা রাখল আঙুলের উপর, “আই লাভ ইউ।”
-“আই লাভ ইউ টু।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই অনীক হিরুর ঠোঁটে ডুবিয়ে দিল নিজেকে। অনীকের বলিষ্ঠ হাতে বন্দী হিরু অনুভব করছে ওর শরীরের উষ্নতা। হিরুর ঘাড়ের কাছে মুখটা ঘষতে ঘষতে অনীক বলল, “আমার সুন্দরী বৌটাকে বউ সাজে দেখার লোভ আর সামলাতে পারছি না,” বলেই আবেশে আরও চেপে ধরল হিরুকে নিজের মধ্যে।
অনীকের চোখে দুস্টুমির ইঙ্গিত, বাইরে বৃষ্টি আর মাতাল করা পরিবেশে মিশিয়ে দিচ্ছিল ওরা দুজন দুজনকে, একে অপরের মধ্যে।
ওদের ভালবাসার সাক্ষী রইল বাইরের বারান্দাটায় বসা পায়রা দুটো। বাইরে ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে তারা দুজন, খুনসুটিতে ব্যস্ত তারাও। আলো-আঁধারি ঘরের মাঝে ভালবাসায় এক হলো অনীক আর হিরু। সুখসাগরে ভাসল দুই প্রেম, বাইরে তখন তুমুল বর্ষণে ভাসছে কলকাতা।
।।২।।
(কয়েকদিন পর)
ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতেই ঐ নামটা সামনে আসতেই মাথায় একটা দুস্টু বুদ্ধি খেলে গেল হিরুর।
মিঃ আদিত্য রায়চৌধুরী, পেন্টিং-এর জগতের স্বনামধন্য নামটা ব্যক্তিগত জীবনেও বেশ রঙীন,ফ্রেন্ডরিকুয়েস্ট পাঠানোর অপশনটাও নেই। ফটোস অপশনে গিয়ে ফটোগুলো দেখছিল হিরু। ছবির জগতের এই মানুষটার নিজের ফটো গুটিকয়েক। নীল শার্ট আর সানগ্লাসের ফটোটায় মারাত্মক হ্যান্ডসাম লাগছে, উফফ।।।
টিফিনের আগের ১৫মিনিট হিরু প্রতিদিনই কাগজপত্র গুটিয়ে ফেলে। আজ প্রোফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন যে ১টা পেরিয়ে আরও ৭মিনিট হয়ে গেছে খেয়ালও করেনি। মালটার বয়স কিন্তু খুব একটা কম না, দেখে অতটা বোঝা যায় না। হিরু হিসাব করে দেখল ওর থেকে পাক্কা ৭ বছরের বড়, অফিসিয়ালি। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই।
রূপালীর তাড়ায় টনক নড়ল হিরুর, “রোজ তো খেতে বেরবার জন্য মাথা খারাপ করিস, ফোঁকার জন্য ছটপট করিস, আজ কী হলো তোর?”
**************
ধোসার টুকরোটা মুখে পুরে চামচে করে সম্বরটা মুখে নিতে নিতে ফোনটা খুলে দেখাল রূপালীকে।
-“কী দেখছিস বলতো তখন থেকে?”
-“দ্যাখ না আগে।”
-“উফফ” বলতে বলতেই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখাতেই রূপালীর চক্ষু চড়ক গাছ।
-“এ তো হেব্বি হ্যান্ডসাম রে। আরে এটা তো আদিত্যর ছবি তাই না?”
-“চিনতে পারলি তুই?”
-“আরে একে চিনবো না?” বলতে বলতেই স্ক্রল করে নামটা দেখল রূপালী, “আরিব্বাস, এই তো সেদিন এসেছিল, ইন্টারভিউ হলো। এই তো?”
-“ইয়েস।”
-“হেব্বি তো।” কিছুক্ষণ প্রোফাইলটা স্টক করে নিল রূপালী,”বড় লোকের বড় ব্যাপার। কী দারুণ দেখতে রে, কিন্তু তাতে আমাদের কি,আপাতত খাওয়ায় কন্সেন্ট্রেট করি বাবা। চল খা জলদি, আবার তো ফুঁকতে যাবি।” হিরু মুচকি হাসলো শুধু |
দুই বান্ধবী মাতল ধোসা, সাম্বর, আর কুলফিতে।
**************
“রাত্রের খাবার আর কতক্ষণ বাকী? এখন তুই সিঙ্গাড়াগুলো কেন কিনলি? এমনি এমনি বানাচ্ছি চাউমিন, চিলি চিকেন? এক থাবড়া দেব।” ঠাস করে অনীকের পিঠে ঘা বসিয়ে দিল হিরু। অনীকের পেটে তখন দেড় খানা সিঙ্গাড়া, হাতে আরও আধখানা।
-“এত রাত্রে ফিরলি, কেউ আনে এতগুলো সিঙ্গাড়া?”
-“কী করবো খেতে ইচ্ছে করছিলো তো, সবসময় এত বকিস কেন? সব খাবো।” বলে আবার খাওয়ায় মন দিল।
হিরু সয়াসস, টমেটো সস নিয়ে তখন যুদ্ধে ব্যস্ত।
হাতের কাজ সেরে গজগজ করতে করতে নিজের ফোনটা নিয়ে বসল ঘরে। স্ক্রিনটা অন করতেই ওর মেসেজের রিপ্লাইটা দেখল, “হ্যালো।”
দেখেই বুকটা প্রথমে ধক করে উঠল হিরুর। মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছিল দুপুরে একটা। রিপ্লাই পাবে আশা করেনি। কিন্তু এখন মেসেঞ্জারে রিপ্লাই। নামের পাশে সবুজ বিন্দু।
আঙ্গুলগুলো কী-বোর্ডে চলেই গেল। টাইপ করে পাঠিয়ে ফেলল এসএমএসটাও, “কী খবর?”
-“আর খবর। আপনার খবর বলুন ম্যাডাম, স্কুটি ঠিকঠাক সার্ভিস দিচ্ছে তো?”
-“আবার এগুলো বলে লজ্জা দেবেন? বাই দ্য ওয়ে, আপনি এত ব্যস্ত মানুষ তাও আপনি রিপ্লাই করবেন সত্যি ভাবিনি।”
-“তুমি এসএমএস করছো আর রিপ্লাই করবো না, তা আবার হয়?”
-“ওহ্হো, ফ্লার্টিং, বাহ বাহ। আবার ‘তুমি’??”
-“ফ্লার্ট করা শরীরের পক্ষে ভাল, ম্যাডাম। তাও আবার সুন্দরী মেয়েদের সাথে।”
কথায় কথায় রাত সাড়ে দশটা বেজেছে কখন, খেয়াল করেনি হিরু।
-ম্যাডাম, চাউমিন চিলি-চিকেন তো ওয়েট করছে আপনার জন্য, আসুন।”
-“চল শালা বাঁদর |”
ফোনটা খাটে ছুড়ে চলে গেল হিরু।
।।৩।।
যে আদিত্য রায়চৌধুরীর তুলির টানে ক্যানভাসও জীবন্ত হয়ে ওঠে, সেইই আজ সন্ধ্যেবেলা ওকে কফি খেতে নিমন্ত্রণ করেছে, তাও নিজের বাড়িতে। হিরুর মত মেয়ের এমন নার্ভাস কখনো লাগে না, আজ লাগছে। বহু মেয়ের হার্টথ্রব যে পুরুষ, তার সাথে আজ হিরু দেখা করবে, উফফ!
অনীককে যখন বলে বেরোল তখন প্রায় সন্ধ্যে ৭টা। একটা সি গ্রিন কালারের নি লেংথ ওয়ানপিস পরেছিল ও, একঢাল খোলা চুল, চোখেও একটু সমুদ্র নীলের ছোঁয়া, কানে এক কুচি হীরে, আর স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও।
আজ কেমন একটা যে লাগছে, বুক-এর মধ্যে রীতিমত হাতুড়ি পিটছে, বলে বোঝানোর না। আচ্ছা কি বলবে ও?
**************
ঠিক ৭টা বেজে ৭মিনিটে পৌঁছে গেল ও আদিত্যর বাড়িতে। বাড়ির সামনে বাগানটা পেরিয়ে দরজায় পৌঁছল ও। কলিং বেলটা বাজাতেই দরজা খুলে ভিতরে বসলেন একজন। বাইরে বসার ঘরে বসল হিরু, চুপচাপ বসার মেয়ে তো ও নয়, ঘুরে ঘুরে দেখছিল চারপাশটা। এটাই আদিত্যর পৈতৃক বাড়ি। পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন, জমিদারি চলে গেলেও ঠাটবাট রয়েই গেছে। বসার ঘরটাই কী বিশাল। আর দেওয়াল জুড়ে কী সুবিশাল সৃষ্টিগুলো, আকারে নয়, চিন্তায়, মননে। আদিত্যর বাবা কাকারাও ছবি আঁকতেন, তাদের আঁকাও রয়েছে, তবে আদিত্যই বিখ্যাত হয়েছেন। ওনার আঁকা অনেক আগেই দেখেছিল হিরু। কেমন যেন একটা অন্যরকম ব্যাপার থাকে ওনার তুলির ছোঁয়ায়। প্রেম, প্যাশনটাকে বড় সুন্দর করে ক্যানভাসে তুলে ধরেন উনি। কত অবলীলায়, কী সাবলীল সে সব ছবি। কী ভীষণ জীবন্ত চরিত্রগুলো। হারিয়ে গিয়েছিল ও ডানদিকের কোণের ছবিটার দিকে তাকিয়ে। চারধারে জ্বলন্ত আগুনের মাঝেও দুই প্রেমী একসাথে, আমৃত্যু, কী অসম্ভব প্যাশনেট ছবিটা, রক্তিম লাল আর আগুনের ছোঁয়া ছবিটায়। ছবিটার নীচেই টেবিলে রাখা একুয়ারিয়ামটা এই দেখল হিরু। এতক্ষণ ছবিগুলোতে হারিয়ে ছিল ও। একুয়ারিয়ামের লাল মাছটার দিকে তাকিয়ে আঙুলের ইশারা করতে যাবে তখনই।।।
-“ওটা Red Flowerhorn Cichlid” বলতে বলতে ঘরে ঢুকল আদিত্য, একটা ক্যাজুয়াল টিশার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার। টিশার্টটা বেশ ফিটেড, তাই বলিষ্ঠ চেহারাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ফর্সা গালে দাড়ি কাটতে গিয়েই মনে হয়, ঠোঁটের কাছে লাল আভা। এলোমেলো চুলে আর আজকের চশমাটায় আরও বেশী হ্যান্ডসাম লাগছে। হিরু হাঁ করে তাকিয়েছিল আদিত্যর দিকে। আদিত্যর নারীসঙ্গ-এর কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু সব জেনেও পতঙ্গ যেমন বহ্নির দিকে ধেয়ে যায়, তেমনই একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করছিল ও। আদিত্য একদম ওর কাছে এসে বলল, “ভিতরে এসো।”
আর হিরুও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওকে অনুসরণ করে ভিতরের ঘরের দিকে চলল।
**************
আদিত্যর বাড়ির লোকজন সত্যি ভীষণ অমায়িক,বিশেষত, আদিত্যর মা। কফির নিমন্ত্রণ-এ ডাকলেও ওনার হাতের রান্না না খাইয়ে ছাড়লেন না। বাড়িতে আদিত্য ওর মা বাবা, ছোট বোন, কাকা, কাকী, খুড়তুতো দাদা, সকলে একসঙ্গে থাকেন। এত সাকসেসফুল হয়েও এই একান্নবর্তী পরিবারে একসাথে থাকা, এটাই সবথেকে ভাল লাগল হিরুর।
-“এবার আসি আদিত্য, আর রাত করা ঠিক হবে না।”
-“তোমায় যে কারণে নিমন্ত্রণটা জানালাম সেটা না দেখিয়ে তো যেতে দেব না।”তাই তো, কেন ডাকলো সেটাই তো এখনো জানা হয়নি হিরুর, কিছুই বলেনি এখনও,সত্যিই হঠাৎ নিমন্ত্রণটা কিসের?