আমন্ত্রণ (অন্তিম পর্ব)

নীলিমাদেবী হাতের থালাটা তাতানের ঘরে রেখে দিলেন, ছেলের প্রিয় চাউমিন বানিয়েছিলেন অনেকদিন পর। বাড়ির সাধারণ আলু, পেঁয়াজ, সবজি, টমেটো-সস দিয়ে চাউমিনটা তাতানের ছোট থেকেই লাঞ্চবক্সের প্রিয় আইটেম ছিল, ওটাই আজ করেছিলেন।

এই অবস্থায় কোন কথাই নিষ্প্রয়োজন, কুরুচিকর। নীলিমাদেবী একটি শব্দও খরচ করলেন না, ফিরে যাচ্ছিলেন, তাতান বলল তখনই,

-“মা, ঠিক কী কী বলেছ তুমি এই মেয়েটাকে? কী চাও বলতো তুমি? এখনও? কেন?”

-“ভদ্রভাবে কথা বলো তাতান, তুমি ভুলে যাচ্ছ কার সাথে কথা বলছো।”

-“কীভাবে ঠিক রাখব মাথাটা? তুমি মাথা ঠান্ডা রাখতে দাও কখনো? তিন বছর আগেও না, বিয়ের আগেও না, আজও না।।। কী এত অসুবিধা বলতো ছিল তোমার পিউকে নিয়ে? যে আজও – মরেও।।।”

-“চুপ, একদম চুপ, আর একটা কথা না।”

ব্যস, আর কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন নীলিমাদেবী। মূর্তির মতন তখনও দাঁড়িয়ে তাতান আর রুহি।

নিম্নচাপের পূর্বাভাস ছিলই, ঝড় এত তাড়াতাড়ি উঠবে ভাবতে পারেনি কেউ। বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো যখন, তখন রাট ৮:৩০টা প্রায়। প্রবল ঝড়ে বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছগুলো নুইয়ে পড়ছে রাস্তায়। জানলার ভিজে কাঁচগুলো কাঁপছে থরথর করে, ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টিও।

তাতান, মা-এর দিকেই তাকিয়ে ছিল। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, এতদিনের চাপা দেওয়া বিষম যন্ত্রনাটা যেন আবার একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পুরোনো ঘা আবার একবার দগদগে। মাকেই বা কেন এত কষ্ট দেয় ও? মা তো, ওরই তো মা, একাকীত্বের অন্ধকারে তো ঠেলেই দিয়েছে, এই কটু কথাগুলো কী খুব জরুরী? কিন্তু পিউ? আজ তো পিউও…

খুব বেশীক্ষণ তাতানের ভাবনা স্থায়ী হলো না, চোখে নিজের অজান্তেই নোনতা জলের ধারা, তার মধ্যেই তাকাল সামনের দিকে, রুহির চোখে চোখে পড়ল। রুহির এই দৃষ্টি কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাতান। চোখে জল, দৃষ্টি টা যেন জ্বলছে!! জাস্ট কিচ্ছু বলতে পারল না তাতান।

রুহিই বলল, “শান্তি হলো তোমার? এবার শান্তি হয়েছে তো? কী পাও ঐ বুড়ো মানুষটাকে কাঁদিয়ে? নিজেকে ঐ মানুষটার ছেলে বলতে, একটা মানুষ বলতে লজ্জা করে না তোমার? আরে, তোমার থেকে বেশী পিউদি মাকে ভালবাসতো। আজ যদি পিউদির জায়গায় তুমি থাকতে? পিউদি কোনদিন মাকে এভাবে একা ফেলে যেত? কখনো না। মা বলে ডাকার পর তার সম্মানটা দেওয়ার শিক্ষা, রুচি পিউদির ছিল, তোমার সেটা নেই। আর তোমার কী মনে হয়, মা খুব ভাল আছে? যেদিন থেকে মানুষটাকে চিনি, একটা নামই প্রথম জেনেছি তার কাছ থেকে, ‘পিউ’, তাতান তার অনেক পরে। গল্প শুনেছি ‘পিউ’র, তাতানের নয়। মিস করতে দেখেছি ‘পিউ’কে, তাতানকে তার পরে।মার আজও পিউদির জন্য যে ভালবাসা, সেটা আমি নিজে চোখে দেখেছি, আর তুমি ছেলে হয়ে, এত বছরে এটা বুঝলে না? তার বাইরের কঠিন আবরণটাই দেখলে? আরে, তোমার থেকে বেশী যত্নে রেখেছিল মা পিউদিকে, এক্সিডেন্ট তো এক্সিডেন্টই হয়। নিজের মেয়ের থেকেও বেশী ছিল সে মায়ের কাছে।

মাকে অনুতাপে দগ্ধে দগ্ধে মরতে আমি না হয় এই ক’দিন দেখছি, তার আগে অনুতাপ, একাকীত্ব, বার্ধক্য এইসব কিছুর তাপে আসল মানুষটা কতটা কঠিন হয়ে গেছে, সেটা তো তুমি দেখতেই আসোনি। ছেড়ে চলে গেলে একা, কী না পিউ-এর স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। কেন? ঐ মানুষটাকে তাড়া করতে পারে না? নাকী ইচ্ছে করে মেরে ফেলেছে নিজের আদরের মেয়েটাকে? কী দায় দিতে চাও ঐ বুড়ো মানুষটার উপর?”

এতদূর বলে কয়েকমুহূর্তের জন্য থামল রুহি। হাঁপাচ্ছে, এই শীতেও রীতিমত ঘামছে, চোখের জল বাঁধ ভেঙেছে অনেক আগেই।

আবার বলতে লাগল, “মা-এর এই যন্ত্রণার প্রত্যেকটা কথা লেখা আছে মা-র ডায়েরীতে। পারলে পড়ে দেখবে কখনো। হ্যাঁ, আমি পড়েছি, লুকিয়ে পড়ে নিয়েছি। জানি, এটা উচিত না, কিন্তু পারিনি নিজেকে আটকাতে। ভীষণ ইচ্ছে করছিল, যে মানুষটা এত করল আমার জন্য, তার কষ্ট একটু যদি লাঘব করতে পারি। একটু যদি সব জেনে তাকে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু তুমি তো এসে সেটা হতে দেবে না। তোমায় এখানে আসার অনুরোধটা করেছিলাম মানুষটাকে অন্ধকার, একাকীত্ব থেকে টেনে বের করার জন্য। বুঝতে আমারই ভুল হয়েছিল, যে নিজের মাকে এভাবে ফেলে চলে গেছে, সে কী করে তাকে আলোয় আনতে পারে? তার কাজই তো অন্ধকারে ঠেলে ফেলে দেওয়া। আর তুমি সেটা ভালই করতে পেরেছো।

সত্যি বলছি, তুমি পিউদির নখেরও যোগ্য না। আর এই মায়ের এই ছেলে কীভাবে হতে পারে ভেবেই আশ্চর্য লাগছে আমার।

পিউদিকে নিয়ে আমি কেন এত কথা বলছি বলতো? পিউদি যখন ওঁর NGO-র সাথে কাজের জন্য আমাদের এলাকায়, আমাদের স্কুলে এসেছিল, খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম মানুষটাকে। এরকম মানুষ কম দেখেছি খুব, দেখাই যায় না বলা ভাল। অনেক সাহায্য করেছিল মানুষটা। পড়াশোনাটা যাতে চালাতে পারি, এগোতে পারি|এই মানুষটার কাছেই তাঁর মা-এর গল্প শুনেছিলাম। সে যে অনাথ তা তো জানতামই না। সেই থেকে বুঝলাম, এখনো পৃথিবীতে মনুষ্যত্ব আছে। তারপর আর ঐ মানুষটার সাথে দেখা হয়নি, হঠাৎ হারিয়ে গেল কোথায়। সে যে আর নেই তা কে জানত? আমার দুর্ভাগ্য, আমার দায় যে সাহায্যের মান রাখতে পারিনি আমি। তাই আজ এই অবস্থা, কিন্তু এখানেই শেষ না। তারপর দেখা মা-র সাথে। আমার মা, পিউদির মা। মাকে দেখে, চিনে, থেকে বুঝলাম, কেন পিউদি ওরকম মানুষ ছিলেন, কেন অনাথ হয়েও কোনদিন তাকে অনাথ মনেই হয়নি আমার। যার জীবনে এমন একজন মা থাকে, সে কখনো অনাথ হতে পারে কী? পিউদির সাথে মার সম্পর্ক এই বাড়িতে এসে জানলাম। তারপর যখন পিউদির বিয়ের ছবি দেখলাম, সব পরিষ্কার হলো। আমার জীবনে এই দুটো মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। আমি বেঁচে আছি যাদের জন্য, তাদের জন্য কিচ্ছু তো করবই, একজনের জন্য পারিনি, কিন্তু আরেকজনের জন্য নিশ্চয় করবো।”

আর পারছিল না রুহি, চুপ করল খানিক্ষণ । হাউহাউ করে কাঁদছিল মাটিতে বসে। না, এদের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু যার সাথে রক্তের সম্পর্ক আছে, তার থেকে যার সাথে নেই, তার যন্ত্রণাটা কেন এত বেশী হচ্ছে, তা ও নিজেই জানে না, হিসেবে মতো তো তা হওয়ার কথা নয়। দাঁড়িয়ে ছিল তাতান তখনও, চুপচাপ। একটিও শব্দ ছিল না আর বলার জন্য।

চোখে মুখটা মুছে আবার বললো রুহি, “আমায়, আমার ছেলেটাকে কেন এই বাড়িতে, নিজের সাজানো আমন্ত্রণে নিয়ে এসেছে জানো মানুষটা? অনুতাপ আর একাকীত্ব-এর বোঝা আর বইতে পারছিল না তাই । তুমি যেমন তোমার স্ত্রী, সন্তানকে হারিয়েছ, সেও তার মেয়ে, নাতিকে হারিয়েছিল। নিজে ডাক্তার হয়েও বাঁচাতে পারেনি, এর থেকে বড় যন্ত্রণার আর কী হতে পারে? একজনকে বাঁচাতে পারেননি, তাই আমায় আমার ছেলেকে বাঁচাতে কোন কসুর ছাড়েননি। আমার মধ্যে নিজের মেয়েকে খোঁজেন বলেই আমায় ‘মা’ বলে ডাকার অনুমতি দিয়েছেন। নিজের বৌমা নয় মেয়েকে ভালবাসতেন, আর আজও বাসেন,কঠিন আবরণের আড়ালে নরম মনের মানুষটা। আদর আবদারের একমাত্র আশ্রয় এই মা-টাকে পিউদি ঠিক চিনে নিয়েছিল। আমি দেখেছি মানুষটার আসল রূপ, আর তুমি নিজের ছেলে হয়েও কোনদিন তা দেখার চেষ্টাই করোনি।

তোমার কী মনে হয়, সেদিনকার এক্সিডেন্টটা এক্সিডেন্ট ছিল না? আদৌ জানো কী হয়েছিল? নিজের মনের ভাবনাটাকে লাগাম লাগাও, নিজেও তো বিদেশের চাকরির ডাক পেয়েই নিজের মা, বৌকে ফেলে ছুটেছিলে চাকরির জন্য। কোন দায়িত্ব নিয়েছিলে নিজের মা-র, নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর? সব দায়িত্ব নিজের বুড়ো মা-এর উপর দিয়ে কেন গিয়েছিলে যদি সত্যিই এত সন্দেহ তোমার মনে?

সেদিনকার পর থেকে পিউদির জন্য এই মানুষটা দিনরাত নিজেকে দোষারোপ করে গেছে, চোখের জল ফেলে গেছে, একাকীত্বে ভুগে গেছে। কিন্তু তোমার উপস্থিতিতে তো এগুলো হওয়ার কথা ছিল না, তুমি ছেলে হয়ে কী করলে তাহলে? সেদিনকার কথাগুলো মার ডায়েরীতে লেখা। সেদিন রাগারাগি, কথা কাটাকাটি নিশ্চয় হয়েছিল দুজনের মধ্যে, সে প্রায়ই হতো, কিন্তু ঝগড়ার পরও পিউদিকে নিজে হাতে যে খাইয়ে দিত, সেটা তার মা-ই।  

সেদিনও এরকম একটা সাধারণ দিন, আর পাঁচটা দিনের মতো। মার পক্ষে সেদিন হসপিটাল সামলে পিউদির সাথে ক্রিসমাসের উদযাপন করতে বেরনো সম্ভব ছিল না, কিন্তু পিউদিও তো ছেলেমানুষ, নাছোড়বান্দা। খুব শরীর খারাপ লাগছে বলে ফোনটা করে দিল মাকে। সারাটা রাস্তা প্রচন্ড টেনশন, অত পেশেন্ট ফেলে ঐভাবে এসে মা যখন দেখল পুরোটাই মজা, মা প্রচন্ড রেগে উপরের চিলেকোঠাতে বসেছিল কিছুক্ষণ । ঐ অবস্থায় রাগারাগি, চিৎকার পিউদির শরীরের পক্ষে ঠিক নয়, সেটা ভেবেই চুপচাপ চিলেকোঠায় বসে ছিল মা। বাড়িটা তখনও সারানো হয়নি পুরো, চিলেকোঠার অবস্থা তথৈবচ। পিউদি বারবার ডাকলেও শুনতে পায়নি চারতলা থেকে মা। পিউদি তাই বাধ্য হয়েই ঐ অবস্থাতেই উপরে ওঠে। মার মাথার উপরই যে সিলিং থেকে চাঙড়টা বিপদজনকভাবে ঝুলছিল, খেয়ালই করেনি মা। পিউ উপরে উঠে সেদিন না দেখলে আজ পিউদি থাকতো, কিন্তু মা আর থাকতো না। মাকে টেনে ওখান থেকে সরাতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে…”

চুপ করে গেল রুহি। মাথা নীচু করে নীচে বসে পড়েছে তাতান। সত্যিই তো, ও তো সবই শুনেছিল, কিন্তু কোনদিনও মার দিকটা জানার, বোঝার চেষ্টাও করেনি। যে নেই, তাকে ঘিরে এতটাই জড়িয়ে, এতটাই ডুবে যে যে আছে তাকে কীভাবে ভাল রাখা যায়, নিজের কাছে রাখা যায় কোনদিন ভাবেনি ও।

কোনদিন বিশ্বাসও করেনি। সবদিন নিজের মত করে মনগড়া একটা ঘটনাকেই বিশ্বাস করে গেছে, নিজের মনে জায়গা দিয়ে গেছে। কিন্তু ডায়েরীর হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো পাতায় দিনের পর দিন নিজের যন্ত্রণা, একাকীত্ব, ভুল বোঝাবুঝি, অশান্তি, দূরত্ব সবটুকু উজাড় করে রেখে দিয়েছে মানুষটা। মা ডায়েরী লেখে, এইটাই তো মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি তাতান। মা যে আছে, এটাই কী…

ডায়েরীটা যথাস্থানে রেখে দিল তাতান, এই মেয়েটা এই ক’দিনে এত কিচ্ছু বুঝে গেল, আর ছেলে হয়ে তাতান…। ও যেমন স্ত্রীকে হারিয়েছে, সন্তানকে হারিয়েছে, ঐ মানুষটাও তো…আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিলো না ও। 

মায়ের বানানো খাবারটুকু পড়েই রইল টেবিলে। রুহি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তাতান বাইরে দিকের জানালাটা খুলে দিল, ঝোড়ো হাওয়া, হালকা বৃষ্টি, ঠান্ডা সব একসাথেই আছড়ে পড়ল ওর মুখে।।। ভাল লাগছিল না তবু। মনটা ভীষণ রকম চঞ্চল। মাকে আর কত কষ্ট দেবে ও? হ্যাঁ, সত্যিই তো, ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় পিউ-এর উপস্থিতি স্পষ্ট। ও না থেকেও এই বাড়ির প্রতিটা কোণে, ওর মার চিন্তায় মননে পিউ ভীষণভাবে আজও জীবন্ত, আজও। ও না থেকেও বেঁচে আছে, ওর মধ্যে, ওর মার মধ্যে, এই আমন্ত্রণে।

মা যে পিউকে, ওকে এত মিস করে, তা কোনদিন জানার, বোঝার, অনুভব করার প্রয়োজনও বোধ করেনি। শুধু প্রথম কয়েকদিন, বা কয়েক মাসের ঘটনা দিয়েই মনগড়া কথা ভেবে বিচার করে গেছে। ঐ যে যেবার, পিউর ডেঙ্গু হলো, ওর মা দিনরাত এক করে যে সেবা করেছিল, তাতান তা কোনদিনও পারত না। প্রেগনেন্সির সময় পিউ-এর রোজরোজ রাতবিরেতের বমি ঐ বুড়ো মা-টাই তো পরিষ্কার করত। ছেলের পরদিন অফিস, এত খেটে বাড়ি ফিরেছে এই বলে কোনদিনও জাগায়নি। পেঁপের চাটনী বানাবার ধূমে পিউ পেঁপে কাটতে গিয়ে হাতটা কেটে ফেলেছিল অনেকটা। আসলে ভাল রাঁধলেও কাটাকাটি টা খুব নিখুঁত পারতো না পিউ, মা ই হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল, সেইদিনই প্রথম তাতান বুঝে গেছিল, মুখে যাই বলুক মানুষটা, এই মানুষটাই পারে আপন করে নিতে, ভালবেসে কাছে টেনে নিতে, মাথার উপর বটগাছের মতো এই মানুষটা থাকতে চিন্তা নেই আর।

আর পারল না থাকতে, একবার যে মার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোটা খুব জরুরী। আর আয়নায় নিজের চোখের দিকে চোখে রাখার ক্ষমতা নেই তাতানের, যতটা কটু কথা বলা যায়, যতটা খারাপ কথা বলা যায়, যতটা খারাপ ব্যবহার দেওয়া যায় সব করে গেছে ও, এতদিন ধরে। আর আজ তো… ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

**************

মা-র ঘরের দরজার সামনে তাতান থমকে দাড়াঁল, কী বলবে ও? সবকিছু আবার কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। ঘরের পর্দা উড়ছিল, মা আরাম কেদারায় বসে, দরজার দিকে পিছন করে। হাতে সেই ছবিটা, লাল বেনারসীতে পিউ। নিজে ফটোফ্রেম পছন্দ করে কিনে বাঁধিয়ে রেখেছিল মা। ছোট থেকেই মার মেয়ের খুব শখ ছিল, পিউ আসার পর তা পূরণ হয়েছে, এই কথাটা মুখ ফুটে না বললেও এই ফটোটা নিজেই বাঁধিয়ে নিজের ঘরে রেখেছিল, সেই থেকেই এটা এখানে। এমনকী তাতানও নেই ছবিতে, শুধু পিউ। ফ্রেমটা মার কোলে রাখা, শূন্য দৃষ্টি জানলার বাইরে কোথায় হারিয়েছে, দিশা নেই। মার চোখে জল। এতদিনকার রাগ, অভিমানে ভাল করে চেয়েই দেখা হয়নি তাতানের, ওর সেই ফিটফাট মা আজ কতটা বুড়িয়ে গেছে, অগোছালো হয়ে গেছে যেন কতটা। মা-এর চুলে পাক, চোখের কোণে চামড়া কুঞ্চিত, চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ, মুখে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। দেখেইনি ও, এবার যে মার ওকে প্রয়োজন, ভাবেইনি ও। আর পারছিল না ও নিজেকে ধরে রাখতে।

হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল গিয়ে মার কাছে, নীলিমাদেবীর সামনে, সেই ছোট বেলার তাতান যেন। অকারণেই যেন দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছিল মা-ছেলের। আজ যেন আবার ফিরে দেখার পালা। নীলিমাদেবীর কোলে মাথা রেখে নিতান্ত শিশুর মতোই কেঁদে ফেলল তাতান।

বাধা দিলেন না নীলিমাদেবী, অনেকদিনের জমা পাথর এভাবেই গলে যাক না হয়।

-“বাঁচাতে পারিনি রে। বিশ্বাস কর, অনেক চেষ্টা করেছিলাম, তবু হেরে গেলাম, আমার চোখের সামনে আমারই মেয়েকে একটু একটু করে শেষ হতে দেখার যে কী যন্ত্রণা… যার যায় সে বোঝে। এই দ্যাখ, ডেলিভারির পর, বাচ্চার জামা তো সবাই বানিয়ে রাখে, মার কথা কারো খেয়ালই থাকে না। দ্যাখ, কিনে রেখেছিলাম সব, পিউ-র প্রিয় রঙের, দেখাইনি কোনদিন, ফেলতেও পারিনি, এখনো আগলে বসে আছি ।” বলতে বলতেই কাঠের আলমারিটা থেকে নতুন প্যাকেটে রাখা পিউর জন্য রাখা জামাগুলো নেড়েচেড়ে দেখাচ্ছিল মানুষটা, চোখে সেই সব হারিয়ে নিঃস্ব শুণ্যদৃষ্টিটা প্রকট, তবু যেন খড়কুটো আশ্রয় করে বাঁচার আকুতি, “চলে গেল, মেয়ের খুব শখ ছিল, পেলাম, সেই ছেড়ে চলে গেল, পারলাম না।।। তুইও চলে গেলি।।।”

বুড়ো মা-টার কান্নায় বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল তাতানের।

-“প্রথমে ঠিক যতটা বিরক্ত হয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম, তারপর ততটাই মনে জায়গা করে নিয়েছিল মেয়েটা। একেক দিন একেকটা বায়না, তুই তো তখব সবে বিদেশ চলে গেলি, ওর ঐ অবস্থা, সত্যি বিরক্ত লাগতো না, মেতে থাকতাম এসব নিয়েই।।।”

“তুমি প্লিজ অন্তত আমায় ছেড়ে যেও না মা, তোমায় ভালো রাখার একটা সুযোগ এবার দাও অন্তত, মা………সরি”, এটুকুই বলতে চাইছিল তাতান। বাধছিল কোথাও একটা। বেশী বড় হয়ে গেলে নিজেদের অজান্তেই নিজের পরম প্রিয় লোকগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরী করে ফেলে মানুষ, আর এভাবেই একটু একটু করে আলাদা হয়ে, একে অপরের থেকে, ছিঁড়ে যায় শিকড়।

আজ কতদিন পর তাতান আর পিউ, নিজের দুই সন্তান একসাথে ওনার কাছে। হ্যাঁ, পিউ-এর শরীরটা হয়তো বিলীন হয়ে গেছে, কিন্তু বড় যত্নে, ভালবাসায় সে আজও আছে এই আমন্ত্রণে। আর একজন হলো রুহি। জেনে, না জেনে, ভাগ্যের পরিহাসে সে-ও আজ এই আমন্ত্রণ এর এক সদস্য। নীলিমাদেবীর আরেক সন্তান।এই বাড়ির মানুষগুলোর অনেক ঋণ যে ওর ওপর, ওর সন্তানের উপর, কীভাবে এই ঋণ শোধ করবে ও? এই ভাবে মা, ছেলে।।। আর ।।। মেয়ের দূরত্ব কিছুটা তো কমল। কিছুটা তো পাহাড় টললো, হিমশৈল গলল। পথ যে এখনও অনেক বাকী। খুব শান্তি পেল তাই আজ, ঋণের বোঝা একটু যেন হালকা হলো।।। দেওয়ালে পিউর ছবিতে যেন হাসিটা একটু উজ্জ্বল।।। বাইরে তখন মেঘ কেটে তারাগুলো চিকচিক করছে।

।।সমাপ্ত।।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with