ধূসর (পর্ব – ১)

।।১।।

“আরে, ও মা, দরজাটা খোলো না, কখন থেকে বেল মারছি, ধ্যুর”, বলতে বলতেই বাড়ির দরজায় বারবার অস্থিরভাবে বেল মারছিল শিবাঙ্গী। ঘড়ির কাঁটায় চোখ বোলাল একবার। গুনে গুনে ছ’মিনিট ধরে পাক্কা দাঁড়িয়ে। কী যে করে, উফফ।।।

একেই বাইরে প্রচন্ড গরম, তার মধ্যে এই ভর দুপুর, মায়ের ওপর সবসময় দোষ দেয়াও যায় না সবসময়, একা মানুষ থাকলে… 

ঠিক যখন এসব ভাবছেই তখনই দরজাটা খুলল দেবাংশী, শিবাঙ্গীর মা।

-“কী করব বল, তুই আজ চাবিটা নিয়ে যাসনি, আর এখন আসবি বলেও যাসনি, কানাইদা-ও আজ নেই, মিনু এই গেল রান্না সেরে, সবে স্নানে ঢুকেছি, কী করব আর।।। যাক গে, হাত মুখ ধো। খেয়ে এসেছিস ও বাড়ি থেকে নাকি খাবি এখন কিছু?”

কিছু আর তেমন বললোনা শিবু মা কে আর… 

-“ঠাম্মি না খাইয়ে ছাড়ে কোনদিন?” হাতের ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে ফেলে জুতোটা খুলতে খুলতে বলল শিবাঙ্গী।

-“তা আজ কী খাওয়ালো ঠাম্মা, আদরের নাতনীকে?”

-“আদরের নাতনীকে মুড়িঘন্ট, মাংস, পোলাও খাইয়েওছে আর আদরের বৌমার জন্য…এই দেখেছ, ব্যাগ থেকে বের করতেই ভুলে গেছি, সরি মা, ব্যাগ থেকে বক্সগুলো বার করে রাখো না, ঠাম্মি পাঠিয়েছে তোমার জন্য।”, বলে হাত পা ছড়িয়ে বসল শিবু।

দেবাংশী ততক্ষণে বক্সগুলো বের করে দেখে শুনে ফ্রিজে তুলতে ব্যস্ত।

-“তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নে বরং, এসেছিস যখন তাড়াতাড়িই। আজ সন্ধ্যেবেলা কিন্তু মিসেস মিত্রর বাড়ি নেমন্তন্ন আছে, বারবার মেয়েকে নিয়ে যেতে বলেছে।”

-“উফফ, আর এই কাকীমা, এত বোরিং, এত বোরিং, ধ্যুর।” বলতে বলতেই উঠে নিজের ঘরের দিকে গেল শিবু,ব্যাগ টা পড়েই রইলো সোফায়, মা আছেই, সব গুছিয়ে রাখার জন্য |

দেবাংশী স্নান সেরে পুজো করে তারপর খায়। এদিক টা গুছিয়ে ঠাকুর ঘরের দিকে গেল ও। ঘড়িতে তখন দুপুর দু’টো প্রায়।

*************

-“এই দ্যাখো, মনে করে রাখলাম, আর সেই ভুলে গেলাম, দেবুটা সাদা নাড়ু খেতে এত ভালবাসে, আর ওটাই পাঠানো হলো না।” বেশ খানিকটা আফশোস করতে করতে রান্না ঘরে ঢুকলেন বেলাদেবী।

-“এত যদি মেয়েকে না দিতে পেরে কষ্ট, একটু হাত পা নাড়িয়ে যেতে পারো তো… একটু হাঁটাহাঁটি করলে তো পায়ের ব্যথাটা কমে, তা না।।।”

-“ব্যস, শুরু হলো, যাই বলি, ঘুরে ফিরে সেই আমার হাঁটা নিয়ে খোটা তোমায় দিতেই হবে না?”

রোজকার এই বুড়োবুড়ির মিষ্টি ঝগড়ার সবদিনের সাক্ষী এই ‘বসু পরিবার’। গিরিশ পার্কের বড় রাস্তার উপর ছিমছাম বাড়িটা আজও উত্তর কলকাতার বনেদীয়ানা, পুরোনো কলকাতার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। একান্নবর্তী পরিবারে বুড়োবুড়ি ছাড়াও আছে দুই ছেলে, বৌ, নাতনিরা। আজও সার সার ফ্ল্যাটের ভিড়ে ‘বসু পরিবার’-এর কড়িকাঠ, খড়খড়ির লম্বা জানলা, বিশাল দালান, বসার ঘরের ঝাড়বাতি সদম্ভে উজ্জ্বল।

ঝগড়াটা একটু থিতোতেই বেলাদেবীর ফোন এসে হাজির। নতুন অতিথি এই ‘মুঠোফোন’টা বেলাদেবীর ভাগ্যে জুটেছে বড় ছেলের সৌজন্যে। পুরোনো আমলের কালো ল্যান্ডলাইন এখন আর চলে নাকী? কিন্তু বেলাদেবীর জিদের কাছে হার মেনে আর তা’ বিদায় করা সম্ভব হয়নি তার ছেলেদের পক্ষে, অবশেষে অতি কষ্টে একটা মুঠোফোন দেওয়া হয়েছে ওনার হাতে, এই ল্যান্ডলাইন বাড়িতে রাখার শর্ত হিসেবেই।

বেলা কয়েক সেকেন্ডের চেষ্টার পর ধরলেন ফোনটা, এখনও হাত সড়গড় হয়নি অত। ফোনটা ছিল আদরের দেবুর, দেবাংশীর। ওনার আদরের ছোট বৌমা… নাহ, মেয়েই বলা যায়।

।।২।।

-“আমি বুঝি না এতো কিছুর পরও এত আদিখ্যেতা করো কী করে তোমরা? তোমার নিজের ছেলের থেকেও আগে হলো? আশ্চর্য লাগে সত্যি, কী ধাতু দিয়ে গড়া তুমি কে জানে?”

বেলাদেবী দেবাংশীর সাথে কথা বলে ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলো বললেন অরুণবাবু।

শাঁখটা বাজছে ঠাকুর ঘরে, চোখ বুজে করজোড়ে ঠাকুর প্রণাম সেরে আবার তাকালেন বেলাদেবী স্বামীর দিকে।

বেলাদেবীর মুখে ভাবনাচিন্তার কোন লেশমাত্র নেই, যেভাবে কাজ করছিলেন, একই তালে করতে লাগলেন।

-“এই তুমি চা টা তাড়াতাড়ি দাও তো, আমি ঘরে যাই, নয়তো লক্ষীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও চা টা। তোমার সাথে তো কোন কথা বলাই বৃথা।”

কথাগুলো বলেই আর কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাঁটা লাগলেন দোতলায় নিজের ঘরের দিকে। বয়স হয়েছে, তাই লাঠিটা এখন ভরসা, লাঠিটা নিয়েই যাতায়াত করেন এখন তাই।

অরুণবাবু চলে যেতেই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন বেলাদেবী।

চা টা করে পাঠিয়ে সন্ধ্যেবেলার জলখাবারের জোগাড়ে লাগলেন, একটু পরেই ছেলেরা, নাতনীরা, সব এসে পড়লো বলে।

**************

-“আরে কখন থেকে খুঁজছি তোকে, কোথায় ছিলি? যতক্ষণ এখানে আছিস অন্তত ফোনটা ছেড়ে থাক, লোকজন কী বলবে? বিশাল কিছু হয়ে যাওনি তুমি যে সবসময় ফোন নিয়ে বসে আছো, ফোনটা রেখে এখানে বোস, কথা বল। আন্টি এক্ষুনি খুঁজছিল, খেতে দেবে এবার, বোস।”

-“মা, কোথাও যাইনি, বাপী ফোন করেছিল, তাই, সবসময় বকাবকি ভালো লাগে না যাও তো, বাপিকে বলে দেব এবার আর কিছু…”

-“মাকে বাপিকে দিয়ে ঝড় খাওয়ানোর চেষ্টা? এক দেব মাথায় গাট্টা, যা বোস, বাঁদর।”

শিবাঙ্গী, দেবাংশী আর সাগ্নিকের একমাত্র মেয়ে, এই বছর ১২-এ উঠবে। মা বাবার আদরের শিবাঙ্গী এই যুগের অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে একটু বেশীই ভাগ্যবতী। কারণ মা বাবার সাথে সাথে দাদু, ঠাম্মা, জ্যেঠু, জ্যেঠীদের আদর, প্রশ্রয় সবই পায় ও। সবসময় ওর আবদার মেটানোর জন্য কেউ না কেউ আছেই, যেটা এখনকার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে দেখায় যায় না প্রায়।

মিসেস মিত্রর বাড়ি থেকে ফিরতে প্রায় রাত দশটা বাজল, কাল আবার টিউশন আছে মেয়েটার। তাড়াতাড়ি মেয়ের বিছানা তৈরী করে দিয়ে লাইব্রেরীতে চলে গেল দেবাংশী। বাড়ির কোণে এই লাইব্রেরীটাই ওর সব থেকে প্রিয় জায়গা। 

শিবাঙ্গী ঘুমিয়ে পড়তে ফ্ল্যাটের আলোগুলো সব নিভিয়ে দিলো ও, বসলো নিজের চেয়ারটায়, শুধু লাইব্রেরীর আলোটা জ্বলছে। মেয়েটা এত বকবক করে না, এখন বকতে শুরু করলে আর থামতো না, আর সকালে পড়তে যেতে যত নখড়া।

নিজের চেয়ারটায় বসে ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল কিছুক্ষন দেবাংশী। কাল 5th july, সাগ্নিকের জন্মদিন। ৪৫ বছরে পড়বে কাল ও, কালকের দিনটা শুধু  ওর জন্মদিনই না, আরও একটা বিশেষ দিনও, এই দিনই তো উৎপল স্যারের ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে বেশী না ভেবে চিন্তে সাগ্নিক বলে দিয়েছিল দেবাংশীকে কথাটা। খুব খারাপ ছিল প্রপোজ করার কায়দাটা, এভাবে কেউ প্রপোজ করে? অনেকবার এই নিয়ে কথা শুনিয়ে সাগ্নিকের লেগপুল করেছে ও, ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হেসে উঠল দেবাংশী।

কত ছেলেমানুষিটাই না করেছে দু’জনে ঐ কলেজের গ্যালারিতে, ক্যান্টিনে, একসাথে দল বেঁধে চুটিয়ে আড্ডায়, ওরা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে বাঁচার আগে তো বন্ধু হয়ে যাত্রা শুরু। ওর বেশ মনে আছে, একবার, একটা জন্মদিনে, রিলেশনের তৃতীয় বছরেই মনে হয়, ওরা সবকটা ওকে না জানিয়ে কেক, বেলুন, চকলেট নিয়ে ওর বাড়ি হাজির। পুরো সারপ্রাইজড। আর দেবাংশীর পরিচয় মা-কে দেওয়ার অনেক আগেই মা নিজেই কবে যেন সব বুঝেই গেছল, তাই সবার সামনে বলেছিল, “থাক আর কষ্ট করতে হবে না, তোর বলার অনেক আগেই আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।”- সেদিন সবার সামনে, দেবাংশীর সামনে, লজ্জায় লাল হয়ে গেছল সাগ্নিক। আর বিয়ের দিন? সব ভাইবোন বৌদিদের মশকরায় ও তো তাকাতেই পারলো না। ছবিতে দেবাংশী সাগ্নিকের দিকে চেয়ে, সাগ্নিকের মাথা নীচু, হাসিহাসি মুখ, কান লাল। ঐ ছবিটা খুব প্রিয় ছিল দেবাংশীর…মানে এখনো আছে। আর এই ছবিটা দেখলেই ক্ষেপে যেত সাগ্নিক, তাই ওকে লুকিয়েই ছবিটা বাঁধিয়ে নিয়েছিল ও। নিজের কাছেই রাখতো ওটা, আজও আছে। ভাবতে ভাবতেই ড্রয়ার-এর মধ্যে হাতড়িয়ে, কাগজের তলায় লুকিয়ে রাখা ফটোফ্রেম বের করল একবার, ল্যাম্প শেডের আলোয় ধরল একবার ফটোটা। ইতিউতি প্রাচীনতার ছাপ স্পষ্ট ফ্রেমটায়।

ঘড়ির টিকটিক আর দেবাংশীর শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই, রাত বারোটার পর মেসেজটা কী করবে? আজ এত বছর পর? নাহ, থাক, এত মানুষের শুভেচ্ছাবার্তার ভিড়ে এই একটা শুভেচ্ছাবার্তা না পেলেও কিছু যাবে আসবে না ওর, তার থেকে বরং প্রত্যেক বছরের মত ওর পছন্দের মটনটা বানিয়ে পাঠিয়ে দেবে ক্ষণ, মেয়ের হাত দিয়ে, ব্যস। মেয়ে ফিরলে তারপর গল্প শুনে নেবে, আগেরবার মার কথা শুনে ও বাড়ি গিয়ে বড় অপ্রস্তুতে পড়েছিল দেবাংশী, মা, মেয়ে আর সাগ্নিক ছাড়া আর কেউ তেমন ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখেনি। তাই এবার আর… মা আবার ফোন করে বলবে জানে ও, মানুষটাকে বারবার না বলতেও মন চায় না, কিন্তু এবারও “না” বলতে না পারলে আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তার থেকে বরং থাক।

ফোন নিয়ে বার কয়েক নাড়াচাড়া করে আবার রেখে দিল সেটা টেবিলে। নাহ, শরীর আর সায় দিচ্ছে না আজ, ঘড়িও জানান দিচ্ছে। উঠে পড়ল দেবাংশী। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ বুজল দেবাংশী, রাত প্রায় ১২:৩০টা।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with