ধূসর (পর্ব – ৫)

(কয়েকদিন পর)

-“কানাই, দিদি কোথায়?”

চৌকাঠ পেরিয়ে এই বাড়িতে ঢুকে প্রথম এই প্রশ্নটাই করলেন বেলাদেবী।

বেশ কিছুদিন পর এই বাড়ি এলেন, এই ভাবে,এই পরিস্থিতিতে আসতে হবে কখনো ভাবেননি।

কানাই হাতের কাজ থামিয়ে উপরের ঘরের দিকে ইশারা করল। বেলাদেবীও আর সময় নষ্ট না করে দোতলার দিকে পা বাড়ালেন।

***************

সারা আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, মহানগরীর ভিজে রাস্তা পেরিয়ে সাঁ সাঁ করে পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোর দু’দন্ড দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার সময় কোথায়?

ঘরের জানলাগুলো খোলা, হু হু করে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে ঘরের সবকিছু। ঝোড়ো হাওয়ায় সাদা পর্দাটা উড়ছে। এই ঘরটার সবকিছুই সাদা, বেডসীট থেকে শুরু করে ঘরের রং, টেবিল ল্যাম্প থেকে আসবাব, সবটুকুই সাদা।

ঘরে ঢুকে বেলাদেবীর চোখ যাকে প্রথম খুঁজছিল, সে খোলা জানলার পাশে বসে।

ঝোড়ো হাওয়ায় দেবাংশীর খোলা চুল উড়ছে, অবিন্যস্ত পরনের শাড়ি, সারা ঘরে এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে পুরোনো কিছু কাগজ, হাতে তুলে নিয়ে দেখলেন বেলাদেবী। বহু পুরোনো চিঠিগুলো একজায়গায় করে টেবিলের উপর রাখলেন চাপা দিয়ে। দেবাংশী এখনও বেলাদেবীর উপস্থিতি টেরও পায়নি। চোখ আকাশের দিকে, উদাসীন দৃষ্টি ঘোলাটে, আবছা, চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, চোখের কোণে কালি।

বেলাদেবী দেবাংশীর মাথায় হাত রাখলেন। মা-মা গন্ধটা পেয়েই দেবাংশী বুঝতে পেরেছে, মা এসছে কাছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল দেবাংশী, বাইরের দিকে তাকিয়ে।

-“বৃষ্টির ছাঁট আসছে তো, ভিজে যাচ্ছিস, কী আশ্চর্য। দাঁড়া জানলাটা লাগাই।”

-“না, না, থাক না, ভাল লাগছে। শিবুটা কোথায়?”

-“এই খেয়েছে। একটু পর বাবু টিউশনে নিয়ে যাবে।”

-“সাগ্নিক।।। আছে?”

সাগ্নিক যে এখনও আছে, তা দেবাংশীর আশাতীত, দেবাংশীর কথার সুরে সে ভাব স্পষ্ট।

বেলাদেবী বসলেন মেয়ের পাশটিতে। কোনদিন বৌমা বলেননি, ভাবেনওনি, মেয়েরই স্বীকৃতি দিয়ে এসছেন। কয়েকমুহূর্তের মৌনতা ভেঙে বললেন, “কোনদিনও জানতে চাইনি তোর কাছে, কেন? কি জন্য? ঘরের লক্ষী যখন ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল, তখনও না, আমি বিশ্বাস করি তোকে, জানি তোকে, কিন্তু, কেন? এত কিছুর পরও…”

-“মা, তোমার মনে পড়ে, আমাদের বিয়ের বছর খানেকের মাথায় আমায় অফিস থেকে ছয় মাসের জন্য ইউএস পাঠিয়েছিল, সাগ্নিক তখন অলরেডি একবছরের কনট্র্যাক্ট-এ ওখানেই। ওখানে গিয়ে আমরা আমাদের নতুন বিয়ের পরের মিষ্টি সংসারটা নিয়েই ভারী ব্যস্ত থাকতাম। সারাদিন দুজনের কাজ, বাড়ি ফিরে একসঙ্গে রান্না, তোমাদের খুব মিস করতাম, তাও কেটে যেত সময়টা। দু’জন মিলে সংসারটা সামলানোর মজাই অন্যরকম ছিল। সব খুব সুন্দর এগোচ্ছিল, তখনই দেখা ওখানে অয়নের সাথে। অয়ন ওখানে তখন পোস্ট-ডক্টরেট করছে। ঐভাবে এত বছর পর ওখানে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি আমি, কোনদিনই চাইনি অয়নদা, আর আমার জীবনে ফিরে আসুক। কলেজ জীবনের পর অয়নদা চলে গেছিল আমার জীবন থেকে, কোনদিনই আর ফিরে আসেনি, আমিও চাইনি। চাইনি আমার আর সাগ্নিকের সম্পর্কটার উপর ঐ পাগলপারা দৃষ্টির কোন আঁচ পড়ুক, কারণ অয়ন আবার ফিরে এলে আমি সত্যিই জানতাম না আমি কী করব। আর সেটাই হলো, অয়নকে এড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, ওর আমার প্রতি ঐ প্রবল ভালবাসা বারবার আমায় বাধ্য করেছে ওর জন্যও ভাবতে, ওর সাথে কথা বলতে, দেখা করতে। আমি কিছুতেই পারছিলাম না ওকে এড়িয়ে বেরিয়ে আসতে, ওকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে।

আমার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, নিজের মধ্যেই পুড়তে শুরু করেছিলাম। সাগ্নিকের কাছে গেলে অয়নের মুখটাই ভেসে উঠত, ভাবতাম ও কি ভাবছে, ওকে তো ঠকাচ্ছি, আর যখন সাগ্নিকের স্ত্রী তখন মনে হতো সাগ্নিককে তো অন্ধকারে রাখছি। অয়ন যেমন আমার জন্য পাগল, সাগ্নিকও তো আমার ভালবাসা, আমার স্বামী, ওকে আমি কীভাবে চিট করতে পারি? ওকে আমি কীভাবে কষ্ট দিতে পারি?

পারছিলাম না আমি আর নিজের সাথে যুদ্ধ করতে। অয়নের কাছে থাকলে মনে হতো সাগ্নিককে ঠকাচ্ছি, আর সাগ্নিকের কাছে থাকলে অয়নকে। আমি তো নিজেকেই ঠকাচ্ছি – দিনের পর দিন, সুখী হওয়ার, ভাল থাকার নাটক করে যাওয়াটা কী নিজেকে ঠকানো নয়?

আমি কাকে ভালবাসি? এর উত্তর আজও আমার কাছে নেই, সেদিনও ছিল না। কখনও এই মানুষটার পাল্লা ভারী তো কখনও ঐ মানুষটার প্রেম তীব্র হয়েছে আমার চিন্তায়, আমার মনে।

আমি তো পুরোপুরিভাবে কারোরই হতে পারছিলাম না, পারলামও না। না সাগ্নিকের সাথে সুখী থাকলাম অয়নকে ভুলে, না সাগ্নিককে ছেড়ে অয়নকে নিয়ে সংসার বাঁধতে পারলাম।

সাগ্নিকের চোখে চোখ রেখে মনে হত অয়নকে ঠকাচ্ছি যে, আর অয়নের হাতে হাত রাখতে গিয়ে সাগ্নিকের যন্ত্রণাটা মনে বিঁধত। এর থেকে তো ভাল নিজে শেষ হয়ে যাওয়া, শেষ করেই দিতাম, যদি না শিবু এসে যেত আমাদের জীবনে…”

এতটা বলে চুপ করল দেবাংশী, বাইরে তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি, দূরে কোথাও বাজ পড়ল, দেবাংশীর চোখ বন্ধ, মুখে বৃষ্টির জলের ছাঁট, বেলাদেবী আজ সবটুকু জেনে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ ।

কোনদিনই বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে ছেলে বৌ-এর থেকে নিজে থেকে জানতে চাননি কিছু, তারা যতটুকু বলেছে শুনেছিলেন শুধু। দু’পক্ষের সহমতিতেই যা হওয়ার হয়েছিল। কিন্তু তারপরও যার জন্য ঘর ছাড়া, তার সাথে ঘর না বাঁধার কারণ কী জানতে চাননি কোনদিন, আজ উত্তর পেলেন।

দুজন আলাদা হয়ে গেলেও একমাত্র মেয়ের উপর যাতে তার প্রভাব না পড়ে, তার খেয়াল সবদিন রেখেছে দেবাংশী সাগ্নিক, তাই শিবু সবদিনই সবটুকু পেয়েছে। আজও তাই, মেয়েকে নিয়ে ভাবার জন্য সাগ্নিক পাশে আছে, সব কিছুতে ঠিক আগের মতই যেমন পাশে ছিল।

বেলাদেবী কিছু বললেন না আর বেশী, উঠে পড়লেন পাশটি থেকে, পাশের ঘরে নাতনীর কাছে যেতে গিয়েই দেখলেন সাগ্নিক এদিকেই আসছে, উনি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। 

সাগ্নিক ঘরে ঢুকলেও দেবাংশী সেদিকে খেয়াল করেনি, সাগ্নিকও জানান দেয়নি নিজের উপস্থিতি। দেবাংশীকে ঘৃণা করা এ’জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও সম্ভব না, সেই আগের মতো মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সাগ্নিক। কারও মৃত্যু কখনো কাম্য হতে পারে না, এমন শিক্ষা সাগ্নিক পায়নি কখনো, কিন্তু তাও, আজ, কোথাও যেন ওর মন শান্তি পেয়েছে বহুদিন পর। অনেকদিন বাদে ওর আর ওর দেবাংশীর মাঝে তৃতীয় পুরুষ অয়ন, আর নেই, যে একদিন সাগ্নিককেই তৃতীয় পুরুষে পরিণত করেছিল।

বেশ খানিক্ষণ পর চোখ খুলতে দেবাংশী দেখল সাগ্নিক ঘরের দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

-“কখন এলে? বলোনি তো?”

-“এসছি খানিক্ষণ আগেই, ইচ্ছে করেই বলিনি, আগেও তো বলতাম না…”

-“মানে?”

-“কিছু না…ছাড়ো। বলছি, একটা কথা শুনবে কী? জানলাটা বন্ধ করতে দাও, এবার কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। সর, আমি বন্ধ করে দিচ্ছি।”

কিছু বলল না আর দেবাংশী, “হুম লাগিয়ে দাও” বলে, চুপচাপ উঠে এল জানলার কাছ থেকে। সাগ্নিক গিয়ে দুটো জানলায় বন্ধ করে দিল। দেবাংশী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আয়নাটার দিকে তাকিয়ে, মুখে বিন্দু বিন্দু জল, পরনের শাড়ী বেশ খানিকটা ভিজে গেছে, খোলা পিঠ চাপিয়ে নীচে নেমেছে চুল । আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়েই দেবাংশী জিগালো, “শিবুটা পড়তে বেরিয়েছে? ওকে তো একটু দেখতেও… “

-“আমি পৌঁছে দিয়ে এসছি টিউশন।”

-“ওহ আচ্ছা।”

কয়েকমুহূর্তের বিরতির পর দেবাংশীই আবার বলল, “আমায় খুব ঘেন্না লাগে তোমার তাই না?”

-“এ আবার কী ধরণের কথা?যতসব ভুলভাল, কিছু খেয়ে নাও তুমি।”

-“কথা ঘুরিয়ে না। আমি তো কাউকেই ভাল রাখতে পারলাম না, না তোমায় না অয়নকে। ও চলেও গেল। অস্বীকার তো করতে পারি না…”

গলাটা বুজে এল দেবাংশীর, ছলছলে চোখ, সাগ্নিক তাড়াতাড়ি হাতটা ধরল দেবাংশীর, “আমি… আমি জানি তুমি অয়নকে কতটা ভালবাসো, মিস করো। তুমি নিজে ভাল না থাকলে কাউকেই ভাল রাখতে পারবে না, তাই নিজে ভাল থাকার চেষ্টা তো করতেই হবে।” চুপ করল সাগ্নিক, না চাইতেও অনেক অপ্রিয় সত্য বলতে হয়, মেনে নিতে হয়। ফোনটা বাজতেই ঘরের থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল সাগ্নিক।

বিগত কয়েকরাত ঘুম হয় না দেবাংশীর, সমস্ত স্মৃতিগুলো আছড়ে বারবার চোখের সামনে এসে পড়ছে, এরকম চলতে থাকলে ও আর বেশিদিন সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে না। কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে।

একটা প্রবল শ্বাসকষ্ট অনুভূত হচ্ছিল, বুকের উপর যেন ভারী কিছু, নাহ পারছে না ও আর, অয়ন আর নেই। এই সত্যিটা…

-“দিদি, ঐ ভদ্রলোক এসে গেছেন।”

কানাইদার কথায় ফিরে তাকালো দেবাংশী। পল্লবকে ডেকে পাঠিয়েছিল ও, ও এই এলো। ওকে বসতে বলল, নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে কিছু পর নীচে নামলো ও।

-“এনেছ রিপোর্টগুলো, পল্লব?”

-“হ্যাঁ, সবই এনেছি, দেখতে পারো। কিন্তু দেখেই বা আর কী হবে।” বলেই পল্লব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

-“আমায় প্লিজ একটু বলবে? মানে তুমি তো সবসময় ওর সঙ্গেই থাকতে, এত সিভিয়ার এলার্জি হঠাৎ করে।মানে কীভাবে? কী হলো হঠাৎ।কি খেয়েছিল সেদিন? সেদিন কার কার সাথে মিট করেছিল? প্লিজ বল যা জানো |”

-“আমি জানি দেবাংশী, তোমার পক্ষে এরকমটাই স্বাভাবিক, আমি নিজেই শকড। অন্যদিনের মতই ছিল সেদিনও… সবই নরমাল, আলাদা কিছু তো মনে পড়ছে না সেদিন।”

-“কী খেয়েছিল ও সেদিন? এলার্জিটা তো খাবার খেয়েই হওয়ার কথা।”

-“সেম, রোজকার মতন, স্যার তো বাইরেই খেতে বেরোতেন, একাই, সেদিন ও বেরিয়েছিলেন, এবার অতো অসংখ্য দোকানের মধ্যে কোথায় খেয়েছিলেন, সাধারণ দোকান সব, জানবো কি ভাবে। অফিসের সিসিটিভি ফুটেজও তো তাই বলছে।আর আমি হাফ টাইম এ বেরিয়ে গেছিলাম সেদিন, তবে সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছিলেন |”

-“ওকে। আচ্ছা সেদিন কার কার সাথে মিট করেছিল ও?”

-“এই তো রেজিস্টারের কপি, যারা এসেছে সবার নামই তো লেখা এখানেই। জাস্ট চেক ইট।”

-“সিওর? নাম না লিখে আর কেউ যেতে পারে না ভিতরে?”

-“নো।”

-“ওকে, দেখি কপিটা।”

খানিক নাড়াচাড়া করে কপিটা ফেরত দিতে গিয়ে চোখ আটকাল। আরেকবার ভালভাবে দেখে ফেরত দিয়ে দিল কপিটা দেবাংশী। কিছু আর তেমন বললো না। পল্লবও বেরবে, বেশীক্ষণ আর বসলো না ও।

।।২।।

(তখন)

-“বারবার আমায় কেন ফোন করছো অয়ন? আমার পক্ষে দেখা করা সম্ভব না।” বলতে বলতেই ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দেবাংশী। আর কত যুদ্ধ করবে ও? কত মিথ্যে বলবে সাগ্নিককে? কত ঠকাবে ওকে? অয়ন এখানে আছে এটা যদি ও আগে জানতো। নাহ, ও কোনভাবেই আসতো না। এখন এখানে এসে বিদেশ বিভুঁই-এ।

****************

দেবাংশী আর সাগ্নিক এখানে এসেছে মাস খানেক হলো। নিজেদের ছোট্ট সংসারটা বেশ যত্নেই সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। ওদের দুজনেরই ছুটি একই দিনে, এটাই একটা সুবিধা। একসাথে সুপার-মার্কেটে বেরিয়ে পড়ল ওরা। একসাথে বাজারপত্র করে ঘুরে ফিরে রাত্রে ফিরবে খন।

সুপার-মার্কেটে হঠাৎ দেখা অয়নদার সাথে, বেশ কয়েকবছর পর। অয়নদাকে দেখে একটুও খুশী হয়নি দেবাংশী? নাহ, এটা বললে মিথ্যে বলা হবে। এখানে অয়নদাকে দেখবে এটাই আনএক্সপেক্টেড, তার ওপর ঐ হাসি হাসি মুখটা।নাহ, হঠাৎ এই পাওয়ায় ভাল লেগেছিল বইকী, কিন্তু ভাল লাগাটা ছিল কয়েকমুহূর্তের জন্য। অয়নদার মুখের হাসির কারণ কে তা তো ও জানে, সাগ্নিকের মুখের হাসির কারণ যে সেই, দুই পুরুষের হাসির কারণ একজন কী করে হতে পারে? তাই সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেছিল হাসিটা দেবাংশীর মুখ থেকে। অয়নদার চোখ অনুসরণ করে বেশ বুঝতে পেরেছিল, অয়নদার দৃষ্টি আটকে দেবাংশীর চওড়া সিঁথিভর্তি সিঁদুর-এ। একমুহূর্তের জন্য হলেও বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল দেবাংশীর, এ কেমন দৃষ্টি? সাগ্নিকের কোন ক্ষতি না হয়। ঐ নজর এড়িয়ে মাথাটা নামিয়ে নিয়েছিল দেবাংশী।

সেই শুরু। দেবাংশীর এই ব্যবহার অমূলক, অয়নদা আর ওরকম নেই, কাউকে ভালবাসতেই পারে কেউ কখনো, এখনকার যুগে ঐটা ধরে কেউ বসে থাকে নাকি? – এমনই অনেক কথা বারবার দেবাংশীকে বুঝিয়েছিল সাগ্নিক। দেবাংশীর কোন কথাই শুনতে চায়নি ও। স্বভাবতই ঐ বিদেশ বিভুঁই-এ একমাত্র পরিচিত অয়নদার সাথে আবার বহুবছর পর সম্পর্কটা জোরালো হয়েছিল। 

কিন্তু দেবাংশী খুব ভালভাবে বুঝতে পারছিল, অয়নদা ভোলেনি, ভুলতে পারে না, ওর দৃষ্টি দেবাংশী চেনে। আর আরও একবার, জোর করে সরিয়ে দেওয়া, মনের কোণে চাপা পড়া ভাল লাগাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। একটু একটু করে নিজের মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব পেরিয়ে অয়ন আর দেবাংশী একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকে, সাগ্নিকের চোখের আড়ালেই।

কাজের শেষে যেমন সাগ্নিককে দেখতে পাওয়া, তেমনই অয়নকেও একবার না দেখলে, একবার ওর সাথে কথা না হলে দিনটাই যেন সম্পূর্ণ হতো না দেবাংশীর।

কিছুতেই ঐ চক্রবূহ্য থেকে বেরতে পারছিল না দেবাংশী, হাজার চেষ্টা করেও অয়নদার থেকে দূরে সরে যেতে পারছিল না। একটু একটু করে সবকিছু যে কখন হাতের বাইরে যাচ্ছিল।কিন্তু, এসব তো কিছু হওয়ার নয়, ও তা চায়ওনি, কিন্তু ভালবাসায় কবে কার জোর খেটেছে?

সাগ্নিককে কোনদিনই অন্ধকারে রাখতে চায়নি ও, কিন্তু কিছুতেই সবটা খুলে, এই এতো কথা বলতে পারেনি দেবাংশী, বা হয়তো চায়ওনি, তাতে সমাজ ওকে নষ্টা, চরিত্রহীনা তকমা দিতেই পারে, দিয়েছেও। কিন্তু ও পারেনি, পারেনি নিজেকে আটকাতে, পারেনি অয়নদার মুখের হাসিটা দেখার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে, পারেনি দিনের শেষে ক্লান্ত মাথাটা সাগ্নিকের কাঁধে না রেখে থাকতে, পারেনি একজনকে ভালবেসে আর একজনকে ঘৃণা করতে। একদিকটা স্পষ্ট করতে গিয়ে অপরদিকে দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছে বারবার। কিন্তু ও তো এই দুই পুরুষকেই ভালবাসে। কে বেশী কে কম, তা জানা নেই ওর। 

নিজের ভিতর পুড়ছিল ও, শেষ হচ্ছিল। ঠকাচ্ছে তো ও, সকলকে ঠকাচ্ছে। এভাবে তো কিছু সমাধান সম্ভব না। একজনকে পেতে গেলে একজনকে তো ভুলতেই হবে, এটাই তো সমাজের নিয়ম, আর এটাই পারছে না ও কিছুতেই। নিজের চোখে চোখ রাখবে কী করে?

***************

দেবাংশীর বিয়ের পর দ্বিতীয় জন্মদিন, সাগ্নিকের পক্ষে ছুটি নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেবাংশী হাফ ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন, সেদিনও ছিল বৃষ্টি মুখর একটা দিন। আর সেদিন সাগ্নিকেরও আগে ওর বাড়ির দরজায় একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল অয়নদা।

সাদা শার্ট বৃষ্টির জলে আধ ভেজা, মাথার ব্যাকব্রাশ চুলও বৃষ্টির জলে এলোমেলো, মুখমণ্ডলে কিছু বিন্দু বিন্দু জল, চোখের চশমা নেই সেদিন। একহাতে গোলাপের তোড়া, আরেক হাতে ব্লেজারটা, বামহাতে ঘড়ি, বেশ বোঝা যাচ্ছে কাজের জায়গা থেকে বেরিয়ে সোজা দেবাংশীর বাড়িতেই এসেছে অয়ন।

***************

প্রবল বর্ষণে বাইরের চারপাশ আঁধার, ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, জানলার কাচ বেয়ে সর্পিল গতিতে বেয়ে চলেছে বারিধারা। প্রবল হাওয়ায় বারবার বাইরের গাছগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে জানলার কাচ।

ঘরের মধ্যেও আলো আঁধারির খেলা, দেবাংশীর খোলা চুল পিঠ চাপিয়ে নেমেছে কোমর অবধি, কপালের সিঁদুর যেন একটু ঘেঁটে গেছে, ক’দিন ধরেই বড় দুর্বল, শরীর কিছু ক্লান্ত। চোখের কোণে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, কপালের টিপ একটু যেন বেশীই জ্বলজ্বল করছে অয়ন এর চোখে, চোখ এড়াল না দেবাংশীর। 

সেই প্রথম অয়ন নিজের বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে পরম যত্নে, ভালবাসায় চেপে ধরেছিল দেবাংশীর নরম গালদুটো। তিরতির করে কাঁপছিল দেবাংশীর ঠোঁট, ভয়, উত্তেজনা, সবমিলিয়েই। ভীষণভাবে ইচ্ছে করছিলো ছিটকে বেরিয়ে যেতে অয়ন এর হাত সরিয়ে, কিন্তু তাও পারছিল না কিছুতেই, আবেশে যেন মুড়ে গেছিল চারপাশটা। এই ঘর, এই পরিবেশ, এই সবকিছু, ও নিজেও। একমুহূর্তের মধ্যে যেন কী একটা হয়ে গেল, অয়ন নিজের সমস্ত ভালবাসা, অপেক্ষা, না পাওয়ার যন্ত্রণা, আর্তি, সবকিছু যেন উজাড় করে দিল দেবাংশীর দুই ওষ্ঠে, দুই ওষ্ঠের মিলনে যেন সব অপেক্ষার সমাপ্তি, কিন্তু ঘটল কই সমাপ্তি?

যে তীব্র প্রেমের জোয়ারে ভাসছিল দেবাংশী, সেখানেই হাঁসফাঁস করতে লাগল হঠাৎ। যে মুহূর্তে মিলনের ছোঁয়ায় বিদ্যুৎ খেলে গেল শরীরে, সেই ছোঁয়াতেই বড্ড ঘেন্না হতে লাগল দেবাংশীর, কয়েকমুহূর্তের ব্যবধানে। কিন্তু কেন? ও-ও তো ভালবাসে অয়নকে, তাহলে?

গা গুলোচ্ছিল ভীষণ, অয়নের বলিষ্ঠ বাহুডোর থেকে, ওর উন্মত্ত চুম্বনের স্পর্শ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করছিল দেবাংশী। মাথায় অনেক কিছু ঘুরতে শুরু করেছিল হঠাৎ, সাগ্নিকের মুখটা বারবার মনে পড়ছিল। অপরাধবোধ কাজ করছিল ওর মনে। একজন প্রবঞ্চকের থেকে আলাদা কোন জায়গায় ও ?

অয়নের ঠোঁট দেবাংশীর ঠোঁট, গাল পেরিয়ে ছুটে চলেছে ওর ঘাড়ে, ওর চুলের সুগন্ধে, ওর শাড়ির আঁচলে, ওর বক্ষে। মিশে যাচ্ছিল অয়ন ওর সবটুকু ভালবাসা দিয়ে, দেবাংশীর শরীরের আরও গভীরে।

কিছুতেই বেরতে পারছে না দেবাংশী। এই ভালবাসা, ভাললাগার জাল পেরিয়ে পারছে না ও বেরিয়ে আসতে, মাথা কাজ করছে না। কিন্তু মনটাও পুরোপুরি সায় দিচ্ছে কই? বারবার সাগ্নিকের মুখটা… সামনের আয়নাটায় হঠাৎ চোখ গেল দেবাংশীর। আয়নাতে চোখ পড়তেই দেখল মাথায় জ্বলজ্বল করছে সিঁদুরটা, সাগ্নিকের দেওয়া, ওর সাগ্নিক। সাগ্নিকের জন্যই পরা লাল সিঁদুরের টিপ অয়নের স্পর্শে সম্পূর্ণ এলোমেলো, সাগ্নিকের জন্য পড়া শাড়ির আঁচল অয়নের জন্য লুটোচ্ছে মেঝেয়। এই দেওয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা দেবাংশী ঐ দেয়ালের বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখছিল একটু একটু করে ভেসে যেতে, শেষ হয়ে যেতে অয়নের কাছে।

নিজের চোখে চোখ পড়ল দেবাংশীর, পারছে না নিজের চোখে চোখ রাখতে। এতটা নীচে কবে নামল ও, যে আজ নিজের চোখে চোখ মেলাতে অবধি এত কুন্ঠা? অয়নের ঠোঁট তখন ছুটে বেড়াচ্ছে ওর দেবাংশীর সারা শরীরে। 

নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে অয়নকে নিজের শরীর থেকে টেনে সরিয়ে দিল দেবাংশী। এক লহমায় নিজের লুটিয়ে যাওয়া আঁচলটা তুলে নিয়ে নিজেকে ঢেকে নিল দেবাংশী। চোখ বন্ধ, ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে, মাথা নীচু। আর অয়ন, কিংকর্তব্যবিমূঢ। কী হয়ে গেল, কী হতে যাচ্ছিল, কেন হলো, কোন কিছুর উত্তর নেই ওর কাছে।

দেবাংশীর দিকে আর একবারও এগোয়নি অয়ন, আর একবারও নিজের সীমা লঙ্ঘন করার স্পর্ধাটুকুও দেখায়নি। নত মস্তকে একটি কথাই বলতে পেরেছিল ও, “আই অ্যাম রিয়েলি সরি। বাট, আই রিয়েলি রিয়েলি লাভ ইউ।”

কোন উত্তর দেয়নি দেবাংশী, অয়ন উত্তরের অপেক্ষাও করেনি, বেরিয়ে গেছল ঐ ঝড় বৃষ্টিতেই। আটকায়নি দেবাংশীও। নিজের শাড়িটা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে আবৃত করে নিয়েছিল নিজেকে। ভেঙে পড়েছিল সেদিন বাইরের আকাশটা, সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সেদিন দেবাংশীও। স্নানঘরের বারিধারায় সেই নোংরা দাগ মোছেনি, বরং জলের সাথে ধুয়ে গেছিল সিঁথির সিঁদুর, কপালের উজ্জ্বল লাল টিপ।

আর ‘নোংরা’ তকমাটাই বা কে দেয়? এই সমাজই তো। এই দ্বিচারিতা মানবে কে? সমাজ তো মানবে না। পরিবার পরিজন, মা বাবা, সাগ্নিক কেউ না, কেউ।

দেবাংশী যে শেষ হয়ে যাচ্ছে এই দোটানায়। ওর বুক ফাটা কান্না কে শুনবে? বুঝবেই বা কে? এই সমাজ কুলটা, দুশ্চরিত্রাই তো বলবে। যে যন্ত্রণার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে ও, কে বের করবে এখান থেকে? নিজের সাথে সাথে শেষ করছে অয়ন আর সাগ্নিক দুই জনকেই। কেউ সুখী হতে পারবে না, কেউ না। বড্ড ঘেন্না করছিল যে দেবাংশীর। ঘেন্নায়, লজ্জায়, অপমানে আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর, নিজের চোখে চোখ রাখার যোগ্যতাটুকুও নেই।

স্নানের শেষে ঘরের আয়নায় নিজের সুন্দর মুখশ্রী দেখে গা গুলিয়ে উঠছিল বারবার দেবাংশীর। হাতের কাছের ফুলদানিটা ছুঁড়ে ভেঙে দিয়েছিল প্রতিবিম্ব। সাগ্নিক আসছিলই, ঐ বিকট শব্দে দৌড়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসে খোলা দরজা, ছড়ানো গোলাপ, ভাঙা কাচের টুকরো, সবকিছু, ওর সাজানো সংসারের লন্ডভন্ড চেহারা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়েছিল দেবাংশীর দিকে।

নাহ, আর কিছু গোপন করেনি দেবাংশী, বরং সবটুকু, ওর সাথে ঘটা সমস্ত কিছু, মানসিক ও শারীরিক, সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বলেছিল ও ওর সাগ্নিককে।

ও, এই দোটানায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই একটা হাত খুব দরকার, যে ওকে সবকিছু থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনতে পারবে।

সব শুনেছিল সাগ্নিক। বলেনি কিছু। বরং, সবকিছু দেবাংশীর উপরই ছেড়ে দিয়েছিল।

কাচের টুকরোয় রক্তাক্ত পা দেবাংশীর, তার থেকেও রক্তাক্ত, আরও বেশী রক্তক্ষরণ হচ্ছে ওর মনে। ডাক্তার বাইরেটা সারিয়ে তুলবে, কিন্তু ক্ষতবিক্ষত মনটা?সেই ডাক্তারই জানিয়েছিল খবরটা, খুশীর না দুঃখের, জানা নেই, তবে শিবুর আসার খবরটা পেয়েছিল সেদিনই, সাগ্নিক আর দেবাংশীর ভালবাসার প্রথম সন্তান, দেবাংশীর জন্মদিনের পরের দিন।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with