প্রথম পর্ব
।।১।।
“উফফ, কী ভিড় বাবা রাস্তায়, মনে হচ্ছে কলকাতা পুরো রাস্তায় নেমে পড়েছে আজ, মানুষ পারে কী করে” – বাড়ি ফিরেই হাতের প্যাকেটগুলো টেবিলের উপর রাখতে রাখতে কথাগুলো বললেন মুখুজ্জ্যে গিন্নী, পরমাদেবী। আর কিছুদিন পর ছোটছেলে ঈশানের আশীর্বাদ – বিয়ে – তার উপর পুজোর বাজার, নিজেদের জন্য না কিনুন ছোট ছোট নাতি-নাতনীগুলোর জন্য তো কিনতেই হয়, তা সেই বাজার করা কী কম ঝক্কির, বিয়ে বলে কথা।
“এই কানাই, সদর দরজাটা লাগাস না যেন, ইমনদের আসতে রাত হবে বলল” – এই সেপ্টেম্বরেও আগুন গরম, ফ্যানের তলায় বসে মুখটা মুছছিলেন পরমাদেবী। কর্তার তো কোন মাথা ব্যথা নেই, সব দায় ওনার একার যেন।
পরমার্থবাবু আবার একটু শান্তি প্রিয় মানুষ। এসব ভিড় ভাট্টায় ওনাকে কেউ আজ অবধি বাড়ি থেকে বের করতে পারেনি।
দুই হাতে অন্তত গোটা দশেক ঝোলা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠল অদিতি। পরমা দেবীর ওষুধটা কিনে একটু পরে ঢুকল ও, এই বাড়ির বড় বৌ।
************
কানাই গ্লাসে জলটা গড়িয়ে প্যাকেটগুলো নিয়ে ভিতরে গেল, “মা অনেকটা রাত হলো তো, ইমন-দাদাবাবুরা খেয়েই ফিরবে ভোজ বাড়ি থেকে, তোমরা হাত মুখ ধুয়ে নাও, খেতে দিয়ে দি তাহলে।”
বাইরের ঘরটা বেশ ঠান্ডা, এ দিকটা বেশী রোদ পড়ে না তো। এক তলাটা তো আরও ঠান্ডা, তবে এই দিকটায় বেশ গাছপালা আছে, সামনে পরমাদেবীর নিজে হাতে তৈরী বাগানটায় ফুলগুলো সুবাস ছড়ায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল অদিতি, “মা চলো, অনেক রাত হলো, কাল আবার সব অফিস, বেশী রাত করে কাজ নেই। আমি যাচ্ছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে চলে এসো বাবাকে নিয়ে।”
উঠে পড়লেন পরমাদেবী, সাড়ে ন’টা বেজে গেছে, কর্তাটি একবার এদিকে এলোও না, নির্ঘাত বই-এর মধ্যে ঢুকে বসে আছে। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে ওদিকের বড় ঘরটা ওনাদের। বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময়ে লম্বা দালানের রেলিঙ-এ আঙ্গুলগুলো ছুঁইয়ে চলেন পরমাদেবী মাঝে মাঝেই, কত্ত বছর হয়ে গেল, এই বাড়ি এই পরিবার আগলে। সকলকে নিয়ে উনি সত্যিই খুশী, স্বামী, সন্তান, সংসার। শুধু…
-এই তুমি বইটা রেখে উঠবে, কখন এসে গেছি, খেয়ালও নেই না?”
ঘরে ঢুকেই স্বামীর সাথে চেঁচাতে লাগলেন।
“সবই খেয়াল করেছি, এই বাঁজখাই গলা কেউ খেয়াল না করে পারে?”
ব্যস, শুরু হলো আবার ঝগড়া, এই ঝগড়ার মধ্যেই ঠিক লুকোনো আছে প্রেমের সজীব চারাটা, আজ ৪৬ বছর ধরে এভাবেই।
।।২।।
“আজ অনেকদিন পর বড় বৌমাকে খুব খুশী দেখলাম জানো। আজ কতদিন পর বাড়িতে একটা এত বড় অনুষ্ঠান, পুজো, কেনাকাটা, সব মিলিয়ে আজ বেশ হাসিখুশী ছিল মেয়েটা, আমাদের তো আর কিছু বলার মুখও নেই।”, কথাগুলো বলতে বলতেই থেমে গেলেন পরমাদেবী, কোঁচকানো চামড়া, বলিরেখা বেয়ে খানিক নোনতা জল বেয়ে পড়ল গায়ে।
হাতে হাতটা রেখে পরমাদেবীর চোখের দিকে তাকালেন পরমার্থবাবু। মশারির মধ্যে দিয়ে চাঁদের আলো পড়েছে বিছানায়, ঘরটা বেশ আলো হয়ে রয়েছে, সারা ঘরের আঁধার ছাপিয়ে চাঁদের আলোটা প্রতিফলিত হচ্ছে সামনের আয়নায়। সেই দিকেই আনমনে তাকিয়ে বললেন, “কত বছর হয়ে গেল না, নীলটাকে দেখি না, কে ভেবেছিল বলতো ও এরকম করবে, এভাবে মতিভ্রম হবে? আমাদের শিক্ষায় কোথায় গলদ রয়ে গেছিল জানি না, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। ছি ছি ছিঃ।।।”
-“বৌমার মতো মেয়ে হয় না, ও বলেই এখানে আমাদের কাছে আছে, আর অন্য কোন মেয়ে হলে…আর অদিতি আমাদের বৌমা নয় গো, মেয়েই। এই পুজোর সময়টা ও বলেই হাসিমুখে সব সামলে কেমন কাটিয়ে দেয়, নয়তো…” কথাগুলো বলে মাথানত করলেন পরমার্থবাবু।
-“ঈশানের বিয়েতে তো নীল আসবে বলছে, খুব জেদাজেদি করছে, কী করবে কিছু ভেবেছ? বড় বৌমা জানতে পারলে কী করবে।।। সব তো তছনছ হয়ে যাবে গো।” পরমাদেবীর গলায় প্রবল ঝড়ের আশঙ্কা স্পষ্ট।
-“তুমি আমার উপর ছাড়, আমি দেখছি। এত ভেবো না তুমি, অনেক রাত হলো শুয়ে পড়।”
-“সেই ভালো, আর এত ভাবতে পারি না।”
শুয়ে পড়লেন পরমাদেবী, বাইরে বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ১২ টার ঘন্টা পড়ল, ঘরের লাগোয়া বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালেন পরমার্থবাবু। কী করবেন কাকে ছেড়ে কার কথা ভাববেন।।।। চশমাটা খুলে রেখে একটু খোলা আকাশের দিকে চেয়ে শ্বাস নিলেন। আর কদিন পরই পুজো শুরু।
।।৩।।
“তুমি বেশী বকো না, বুঝলে, বিয়ের সময় তোমার থেকে বেশী আমাকেই দেখবে লোক, জানা কথা। ঐ তো খেঁদি পেঁচি, আমি বলেই বিয়ে করছি” বলতে বলতেই নিজের মনে মিচকি মিচকি হাসছিল ঈশান, রাই টা এত জলদি রেগে যায় না, খুব মজা লাগে মেয়েটাকে খেচতে।
নিজের ঘরে বসে রাই-এর সাথে গল্প করছিল ঈশান, সদ্য সদ্য সাদা ফুলকো লুচি আর সাদা আলু চচ্চড়ি পেটে চালান করে খাটে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে কথাগুলো বললো ঈশান। সবই বড় বৌদির কৃপা, বড় বৌদির হাতের রান্নাটা না জাস্ট… উফফ।। আর এরকম লুচি মা আর বড় বৌদি ছাড়া কেউ পারে না, কেউ না। নয় লাল হয়ে যায় বেশী নয় ফোলে না, কিছু একটা ঘটেই। কিন্তু বড় বৌদির হাতের লুচি পারফেক্ট।
আজ ঈশানের অফ ডে, সুতরাং সারাদিন জমিয়ে ল্যাদ। সন্ধেবেলা সেই বেরোতে হবে, এই এদের কেনাকাটা যেন আর শেষই হয় না, এত সমস্যা না। খানিক ফোনে বকবক করে ফোনে গেম খেলতে লাগল ঈশান।
-“কীরে, আসবো, প্রেমপর্ব মিটলো?”
বড় বৌদির গলা পেয়ে ফোন থেকে চোখ সরাল ঈশান। এই বড় বৌদিটা না, এরকম বললে লজ্জা লাগবে না ঈশানের? যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ঈশান বলল, “আরে এস তো, তুমি আবার জিজ্ঞেস করছো আসবে কী না? তুমি না… সত্যিই বড় বৌদি।।।।”
-“না, হবু বড় বলে কথা, এবার তো সেটা মাথায় রাখতে হবে নাকি, রাই-এর সাথে কথা হলো? কখন বেরোবি আজ তাহলে?”
বড় বৌদির প্রতি ঈশানের শুধু ভালবাসাই নেই, অপার শ্রদ্ধাও রয়েছে। আজ এই দিনটা এসেছে শুধু এই মানুষটার জন্যই। নয়তো রাই-এর সাথে বিয়েটা এভাবে এত স্মুদলি কোনভাবেই সম্ভব ছিল না, যদি না বড় বৌদি ঢাল হয়ে দাঁড়াতো ঈশানের পাশে।
-“হ্যাঁ, বিকেল দিকে বেরোব, পাখিটাকেও নিয়ে যাব, আগেরদিন নিয়ে যাওনি বলে খুব অভিযোগ করেছে।
পুঁচকটাকে আর এই ভিড়ে নিয়ে যাব না, আরেকটু বড় হোক।”
-“ঠিক আছে, কানাইকে বলে রাখি সেই মতো, স্নানে যা আর দেরি করিস না”, বলতে বলতে আবার রান্নাঘরে কাজে চলে গেল অদিতি।
আজ অদিতি ছুটি নিয়েছে, কাল থেকে শরীরটা ঠিক লাগছিল না, কিন্তু সকাল থেকে ম্যাজম্যাজ করলেও এখন বেশ ফ্রেশই লাগছে, না নিলেই হতো ছুটিটা। ঈশানের ঘর থেকে রান্না ঘরের দিকে আসতে আসতেই পোড়া গন্ধটা এল নাকে। এইরে, শিবুটা আবার কিছু একটা পুড়িয়েছে।
।।৪।।
-“দিদি দ্যাখো না, খেয়াল রেখেছিলাম তাও ধরে গেলো, মা দেখলে।।।।”
-“তুই সর আমি দেখছি।।।।” বলতে বলতেই ফোনটা বাজল। এবাড়িতে সবার হাতে মোবাইল থাকলেও পুরোন কালের কালো টেলিফোনটা এখনও রয়েছে, সেইখানেই বাজল ফোনটা, “যা তুই দ্যাখ, আমি এদিকটা দেখছি।” শিবাঙ্গী মানে মেজো জা বড়দি ছাড়া এক পা ও চলতে পারে না, এই যেমন এখন মাংস টা ধরে যাচ্ছিলো বড়দি এসে গেছে মানে ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।
************
রান্নাগুলো নামিয়ে টেবিলে রাখতে যেতেই কথাগুলো কানে এলো অদিতির। সমস্ত কথার মধ্যে দিয়ে একটা নামই ধাক্কা দিল অদিতিকে “নীল” …