।।১।।
“এই দিকে একদম হুটোপাটি না, ওদিকে যা, এদিকে পুজোর বাসনে লাগবে, ওদিকে ওদিকে” চন্দন পিষতে পিষতে সরালো কচি কাঁচাগুলোকে অদিতি, আজ আর দম ফেলার সময় নেই, বাড়ি ভর্তি লোক আজ, সবাই চলে এসছে, হই-হই-এর মধ্যে সমস্ত কাজের ভার অদিতির ওপর, বড় বৌ বলে কথা, পরমাদেবী পাশে পাশে আছেন যদিও।।। আজ মা-এর বোধন বলে কথা।
বাবাই টুসকি তাতান পাখি সব কটা একসাথে জুটেছে আজ। গায়ত্রীদেবী এবাড়ির বড় মেয়ে। তারই দুই ছেলে মেয়ে বাবাই টুসকি। আর তাতান, কাবেরী মানে এ বাড়ির ছোট মেয়ের একমাত্র ছেলে।
-“তোকে বলছি না এভাবে হয় না খেলাটা।”
-“না, না, এভাবেই হয়, তুই বেশী জানিস আমার থেকে?”
-“আরে আমরা খেলি তো রোজ স্কুলে।”
-“ছাড়তো তোদের স্কুল, ওই তো তোদের সরকারী স্কুল, আমার স্কুলের সাথে তুলনা হয়?”
অদিতির কাজ করলেও টুকরো কথাগুলো ঠিকই কানে আসছিল, এই অবধি সোনার পর উঠল অদিতি।
-“ঋক, যে কথাগুলো বলি, আর যেন তোর মুখে এই কথাগুলো দ্বিতীয়বার না শুনি।”- অদিতি ভালোয় যতটা ভাল, রাগলে ততটাই ভয়ঙ্কর।
মামীর গম্ভীর মুখটা দেখে মাথা নীচু করে নিল ঋক।
অদিতির ছোট ননদ, ঋক-এর মা, বিয়ে হয়েছে বেশ বড়লোক বাড়িতে, বিয়ের পর থেকেই, ঐ যে প্রবাদটা আছে, “ধরাকে সরা জ্ঞান”, এটাকে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব নিয়ে প্রমান করে আসছে কাবেরী। ঐ ঘটনার পর থেকে একমাত্র কাবেরীই একটি মানুষ, যে অদিতিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
“এটা তো মানবে অদিতি, যে এখন ছোট থেকে ভাল নামী স্কুলে পড়াটা জরুরী। ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়লে এগোবে কী করে? ঋক তো ভুল কিছু বলেনি, ঋকের স্কুল আর ওদের স্কুলের কী কোন তুলনা হয় বৌদি? তুমি নিজেই দেখ না, আজ যদি বর্ধমানের মফস্বলের বৌ না হয়ে কলকাতার হতে, তাহলে হয়তো।।।।”, এতটা বলেই কাবেরী চুপ করে গেল।
অদিতি আগে চুপ থাকত কিংবা ঘরে চলে যেত মুখ লুকিয়ে, এখন বুঝেছে, প্রতিবাদ না করলে লোকে তোমায় পদপিষ্ট করে চলে যাবে, ওসব অহিংস বাণী আর এখনকার দিনে খাতে না।
-“দিদি তুমিও তো বাংলা মিডিয়ামে পড়তে, কই শৈবালদাকে নিয়ে তুমি কী খারাপ আছ? আর আমি বর্ধমানের মেয়ে হলেও আমার পড়াশোনা কোথায় তুমি যান। হ্যাঁ, মডার্ন ছিলাম না, ভীষণ বোকা ছিলাম, শহুরে আদবকায়দা, বিশ্বাস ঘাতকতা এগুলো রপ্ত করতে পারিনি, তবে এখন সব বুঝে নিয়েছি, তাই দেখ দিব্যি চাকরিও করছি লেখাপড়া শিখে। আসল শিক্ষাটা মা বাবা, বাড়ির পরিবেশ, পরিবার থেকে আসে, এই কথাগুলো তাই আর বোলো না কেমন? চলো ফুল গুলো সাজাতে হবে, এত গল্প করার সত্যি সময় নেই গো।
**************
“এবারে আলোটা মাধবদা দারুণ দিয়েছে বল বড়দি, একেবারে ঝলমল করছে বাড়িটা। তোমরা আসতে এত দেরী করলে কেন?”
ছেলেমেয়েকে আগে পাঠিয়ে দিলেও বড় মেয়ে জামাই গায়ত্রী আর অতুল বেশ দেরী করে পৌঁছাল, ঈশান গাড়ি থেকে মালপত্রগুলো নামাতে নামাতে প্রশ্নটা করল, “আর কী বলবো বল, তোদের অতুলদার কাজ জানিসই তো, যাকগে যা, বাকীরা সব কই?”
“সব ভেতরে, এস তোমরা,” বলতে বলতেই বাড়িতে ঢুকল ওরা।
অদিতি পুজোর জোগাড় সেরে তখন সবে উঠেছে, একটুপরেই মা-এর বোধন শুরু হবে, “আরে ঐ দ্যাখো বড়দিরা এসে গেছে” – বাড়ির সবার উপস্থিতিতে শুরু হলো মায়ের বোধন। জ্বল জ্বল করছিল মায়ের মুখ, ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর গন্ধ, ঠাকুর দালানের ঝাড়বাতির সোনালী আলো, একচালায় মা-এর মৃন্ময়ী রূপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা যায় যেন বহুক্ষণ।
।।২।।
“এই ছোটগুলোর খাওয়া হয়ে গেছে, এবার একে একে সব বসে পড় তোরা। বড় বৌমা, ওদের খেতে দাও, তুমি ভাজো লুচিটা, আমি ডাল তরকারিগুলো দিয়ে দিচ্ছি।”, লালপাড় সাদা শাড়ি, সাদা চুলের সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, হাতে শাখাপলা, গায়ে একটা মা মা গন্ধ, বড্ড, বড্ড ভাল লাগে অদিতির। পরমাদেবী খাবার তদারকি করছেন নিজে হাতে, অদিতি লুচিগুলো ভেজে দিয়েছে, ওখানেই দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছিল নিজের শাশুড়ি থুড়ি মাকে। এই মানুষটা আর ওদিকের বুড়ো লোকটা এরা যদি না থাকত, আজ কী করত অদিতি? এই লেখাপড়া, চাকরি, পাখিকে মানুষ করা কিছুই তো হতো না। ঐ ঘটনার পরপরই অদিতির মা বাবা মারা যান কয়েক মাসের ব্যবধানে। মেয়ের এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারেননি হয়তো। তখন এই মানুষদুটো বুকে না আগলে রাখলে কোথায় খড়কুটোর মত ভেসে যেত ও কে জানে। ঈশান, ইমন ওদের তো তখন অল্প বয়স, বড়দিও ছিল সবসময় পাশে। এরা সবাই না থাকলে।।।।
-“ও বৌমা, লুচি শেষ, আরও কটা ভাজো।”
-“হ্যাঁ মা, ভেজে দিচ্ছি,” ছলছলে চোখের জলটা কায়দা করে সরিয়ে দিয়ে কাজে মন দিল অদিতি।
***********
বারান্দা দিয়ে এই যে পুজোর পাঁচ-ছ’দিন লাল নীল আলোগুলো আসে, ভারী মিষ্টি লাগে দেখতে ঘরটা।
বারান্দা লাগোয়া বারান্দাটায় দাঁড়িয়েছিল অদিতি। কাজ শেষ করে ঘরে আসতে আসতে প্রায় ১টা। যদিও অদিতির এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকে প্রতিবছরই এই সমস্ত দায়িত্ব পরমাদেবী অদিতির উপরই ছাড়তে শুরু করেছিলেন, বলেছিলেন,”তুমি ছাড়া এই ভার কেউ বইতে পারবে না।”
অদিতি তাই মনে প্রাণে চায় ওর সবটুকু দিয়ে সংসারটা, বাড়ির পুজো, সবকিছু আগলে রাখতে, সাজিয়ে রাখতে।
ওর ঘরের সামনে বাগান পেরিয়ে বাড়ির মেনগেটটা দেখা যায়, গেটের ওপারে এখনও লোকজন ভর্তি, সব পুজোয় রাত জেগে ঠাকুর দেখছে।
পাখি ঘুমিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অদিতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, বিয়ের পর প্রথম বছরের পুজোটা যেন স্বপ্নের মতো কেটেছিল ওর। ব্যস, ঐটুকুই সুখ ছিল, দ্বিতীয় পুজোতেই, এই ষষ্ঠীর দিনই ডিভোর্স নোটিশ ধরিয়ে দিয়ে, সব দায়িত্ব কর্তব্য একলহমায় শেষ করে দিয়ে চলে গেছিল লোকটা। সপ্তমীর দিন, যখন মা হাউহাউ করে কাঁদছে, ঐ যে দালানের সিঁড়িতে বসে, মাকে যতটা সম্ভব সামলানোর চেষ্টা করছিল অদিতি, আর একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ওর চলে যাওয়ার দিকে। ঐ তো, ঐ মেনগেটের কাছেই তো ট্যাক্সিতে ব্যাগপত্র তুলছিল, একবারও পিছন ফিরে চাইল না, মায়ের কান্না শুনেও। বুড়ো বাবাটা, ঐ যে ডানদিকের আরামকেদারা, তার পাশে চুপ করে মাথানীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। ঈশান, ইমন সবাই খুব চেঁচাচ্ছিল, কান্নাকাটি, রাগ, আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা সবকিছু। একমাত্র অদিতির চোখে বিন্দুমাত্র জল ছিল না। সমস্ত আবেগ, চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছিল, গলার কাছে দমচাপা কান্নাটা আটকে গেছিল যেন। একদৃষ্টে ওর চলে যাওয়াটা শুকনো চোখেই দেখেছিল অদিতি। সেদিনকার গেঁয়ো, অশিক্ষিত, ওর জন্য বেমানান মেয়েটা আর ওর স্বপ্নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি, নিজে হাতের শাখা পলা সিঁদুর ঐ দেবীপক্ষেই তুলে দিয়েছিল অদিতি, ব্যস, শেষ। তারপর থেকে একবারও ঐ লোকটার সম্পর্কে একটা কথাও উচ্চারণ করার অনুমতি নেই কারো ওর সামনে।
মা-এর মুখ চেয়ে বিয়ের স্মৃতিগুলো, ছবিগুলোকে শেষ করেনি অদিতি। আজ লেখাপড়া শিখে, চাকরি করে, পাঁচটা মানুষের সাথে মিশে তাই জীবনের সার সত্যটা বুঝে গেছে অদিতি – দুর্বলের কোন স্থান নেই এই পৃথিবীতে।
কী যেন নাম মেয়েটার, জেসিকা, ঈশানই বলেছিল, ফেসবুকে কিছুদিন ছবিতে দেখছে, এখন আর দেখা যায় না, ঐ জেসিকার সাথে ও বরং ভাল থাকুক, এই মানুষগুলো তো সব রইলোই অদিতির।
পাখির গালে একটা হামি দিয়ে শুয়ে পড়ল অদিতি।
।।৩।।
ভোরের নরম আলো একটু একটু করে কেটে সূর্য তেজ ছড়াতে সবে শুরু করেছে আর কী, কলা বৌ স্নান করিয়ে ফিরেছে সব, আলো পড়েছে দাবার ছক উঠোনে। ঢাকের বাদ্যিতে ঘুম ভেঙে গেছে পাড়ার বাকী ঘরের। আর একটু পরেই পুজো শুরু হবে, তারপর অঞ্জলি। তার জোগাড়ে ব্যস্ত সব। কাজ সারতে সারতে একবার ঘরে এসছিল অদিতি, আয়নায় চোখ পড়ল, পুজোর কাজের জন্য পরনে লালপাড় গরদটা ,কপালে লাল টিপ, দুহাতে খালি সোনার চুড়ি, কানে পাশা, গলার চেন, নাকে নথ, খোলাচুল, ভিজে চুল থেকে জল পড়ে খানিক আদ্র পিঠ, এভাবে এরকম কতদিন সাজে না ও। আজ বড় ইচ্ছে করছে সাজতে। সবই তো পরেছে,তাও যেন কোথাও একটা কী নেই নেই।
-“ও বড় বৌদি।”
আবার ডাক পড়েছে নীচ থেকে। সাধারণ ভাবে পড়া শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে কাঁধে ফেলল অদিতি। কোমরে রুপোর চাবির গোছাটা লাগাল আজ বহুদিন পর, কাজলটা টানল চোখে, ঠোঁটে হালকা গোলাপী আভা – নিজেকে এক ঝলক দেখে নিয়ে ছুটল নীচে।
************
একটু পরেই রান্নার ঠাকুর চলে আসবে, বলতে বলতে বেলটা বাজল। ওদিকে ঢাকীরা শুরু করেছে কাজ, পুজো বসবে এবার। ঈশানটা এত পাজি, কানের কাছে এসে বলছে, “বৌদি তুমি কী এত সুন্দরী, নাকী আমি ভুল দেখছি?”
মিষ্টি হাসিটা হেসে দরজাটা খুলল অদিতি।
পিছনে তখন গমগমিয়ে ঢাক বাজছে। সবাই ঠাকুরের কাছে – আর অদিতির মুখে তখনও ঈশানের সাথে খুনসুটির হাসিটা লেগে আছে। কিন্তু।।। আবার কেন?
সামনে দাঁড়িয়ে, ইন্দ্রনীল মুখার্জী, বাড়ির বড় ছেলে। অদিতির নীল। আজ সাত বছর পর।।।