।।১।।
কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে এলো অদিতি, আর ক’দিন পর ষষ্ঠী, বাড়িতে প্রতি বছর পুজোর দরুণ ব্যস্ততা তুঙ্গে, তার উপর বড় বৌ বলে কথা। নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়ও নেই এখন, কিন্তু, এই পুজোর সময়ই তো ওর জীবনটা তছনছ হয়ে গেছিল, আর আবার সেই নামটাই বার বার।।।।।
মাথা নীচু করে চুপ করে বসেছিল অদিতি। ওরই তো ভুল, ও কীভাবে এক্সপেক্ট করে এই বাড়িতে ঐ নাম উচ্চারিত হবে না। আজ আর বেরবে না, এমনিই বাড়িতে অনেক কাজ, আর আজ মনটাও ভালো লাগছে না, তার বদলে ওই-ই থাক, নিজের সাথে সময় কাটাবে না হয় কিছুক্ষণ – নিজের জন্য সময় আর পায়ই বা কতটুকু |
***************
সন্ধ্যেটা দিয়ে ঘরে এল অদিতি, বাকীরা একটু আগে বেরল সব। ঈশান আর রাইমার বিয়ের জন্য, ওদের রিসেপশন-এর বেনারসী পাঞ্জাবী সব কেনা হবে আজ।
ঈশান বড় বৌদিকে ছাড়া যেতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। অদিতিই জোর করে পাঠাল।
আলমারিটা খুলে পুরোনো অ্যালবামটাই খুঁজছিল অদিতি। পুরোনো জোড়ের কাপড়, ভেলটা চোখে পড়ল ওপরের তাকে। তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে, সে কবেকার কথা – অত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই ছিল না, তখন চোখে কত স্বপ্ন, কিন্তু বাড়ির বড় মেয়ে, পরে আরও একটা মেয়ে, ভাই-এর পড়াশোনা। সুতরাং বোঝা বাড়িয়ে কী লাভ। তাই মা বাবার উপর বোঝা কমাতে নিজের বলিদান, যা হয় আর কী। সেদিন থেকেই ঐ মানুষটার চোখে কখনো নিজের জন্য ভালোবাসা, সম্মান দেখেনি অদিতি | বিয়ে হয়ে বড় বৌ হয়ে আসার পর থেকে সবার কাছে ভালোবাসা পেলেও একজনের কাছে দরজাটা বন্ধই ছিল সবদিন। আর তারপর ওর সাথে আর কী কী হয়েছে সেগুলো আর ভাবতে চায় না অদিতি।।।।।
ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল কখন যে শাশুড়িমা ঘরে এসছেন বুঝতেই পারেনি। বারান্দা দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল অদিতি, হাতে বিয়ের জোড়টা।
পরমাদেবী অদিতির পাশে গিয়ে বসতেই অদিতি তাড়াতাড়ি চোখের জলটা সামলে নিয়ে উঠে গেল, জোড়টা তাড়াতাড়ি আলমারিতে তুলে ফেলার জন্য। ওর দুর্বলতা প্রকাশ পাক, আর কেউ সেটা নিয়ে সান্ত্বনা দিক, তা কখনোই চায় না ও, তাই কারো সামনে কাঁদতেও পারে না ও।
-“বড় বৌমা।”
পরমাদেবীর ডাকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে তাকাল অদিতি। পরমাদেবীর চোখে চোখ রেখেই অদিতি বুঝিয়ে দিল, এই অবান্তর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। তার থেকে ঢের ভালো কিছু না বলা।
পরমাদেবী কিছুটা আঁচ করেই বললেন,”বৌমা, সামনেই ঈশানের বিয়ে, ইমন-এর বিয়ের সময় আসার কোনো উপায় বা অবস্থা ছিল না নীলের, কিন্তু এবারটা।।।।”
-“মা প্লিজ, আমি তোমাদের সাথে এই একই ছাদের তলায় আছি আজ এতগুলো বছর, এগুলোর অন্য কোন মানে করো না যেন, আমি এখানে আছি মানে এটা আমার দুর্বলতা নয়। সব জেনে শুনে আজ তুমি কীভাবে বলছো মা এগুলো? আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।”
পরমাদেবী চুপ করে মাথা নীচু করে শুনছিলেন।
-“হ্যাঁ তোমার ছেলের সাথে তোমার দেখায় আমি কখনোই বাধা হতে চাই না, কিন্তু আমায় এসব-এর মধ্যে টেনো না প্লিজ, যা করার আমার অনুপস্থিতিতে করো। কিন্তু আমি এসব-এর মধ্যে নেই, আমি তোমাদের মধ্যে কোন বাধাও নই। আমি আর এ’নিয়ে কোন কথা চাই না মা। আমার একটা আত্মসম্মান আছে তো, সব তো জলাঞ্জলি দিতে পারি না।”
-“কী বলে যাচ্ছো বলতো তুমি, তুমি আমাদের বৌমা নও,বড় মেয়ে। সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছো সংসারটা আমি কি সেটা দেখি না?শোনো বৌমা, তুমি যা চাও তাই ই হবে,আগে আমার মেয়ে,বুঝলে? ভুল টা আমারই, মা-এর ও আগে মানুষের মতো ভাবাটা উচিত। তুমি এসব নিয়ে আর ভেবো না মা, ছাড়ো। যাক গে, তুমি ঘরে বসে, শরীর টরীর খারাপ হলো নাকী দেখতে এলাম তাই। গেলে না কেন আজ ঈশানদের সাথে।”
-“শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল আসলে, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি এই যাচ্ছিলামই। কানাইদার এতক্ষণে হয়তো নিমকির ময়দা মাখাও হয়ে গেল।”, কোনক্রমে মিথ্যে কথাটুকু গুছিয়ে বলে চুলটায় হাত খোঁপা করতে করতে বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে গেল অদিতি। অদিতির এই দাপটের জন্য কোনদিনই কেউ খুব বেশী কিছু বলতে পারে না ওর মুখের উপর। তবে এই দাপট সহজে আসেনি।
পরমাদেবী চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলেন সেই দিনটার কথা, যেদিন এই মেয়েটা প্রথম এ’বাড়িতে পা রাখলো, লক্ষীমন্ত মেয়ে, ঘর আলো করে রেখেছে যবে থেকে এসেছে। মৃদুভাষী মিষ্টি মেয়েটাকে নিজে পছন্দ করে এনেছিলেন। তারপর কেটে গেল কতগুলো বছর। সেই ছোট্ট মেয়েটাই আজ এই বাড়ির সবকিছু।
কবে বাড়ির বড় বৌ থেকে নিজের মেয়ে হয়ে গেল বুঝতেই পারেননি।ওনার সময় মতো প্রেশারের ওষুধটা, কর্তার ইন্সুলিন, ঈশানের বিয়ের তোড়জোড়, বড় মেয়ে গায়ত্রীর সমস্ত বিপদে-আপদে পাশে থাকা, ছোট্ট পাখিকে একাই মা আর বাবা হয়ে বড় করার মধ্যে দিয়ে কবে যে সেদিনকার ছোট্ট মেয়েটা আজকের মিসেস অদিতি মুখার্জী, বাড়ির বড় বৌ, অফিসের ম্যাডাম এতগুলো পরিচয় ধারণ করে ফেলল কে জানে। সেইদিনটাও একটা এরকম ষষ্ঠী ছিল, মায়ের বোধন শুরু হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই, তখনই তো ঝড়টা আছড়ে পড়েছিল পরিবারে। নিজের পেটের ছেলেকেই চিনতে পারেননি। এই পোড়া দেশে থেকে কী হবে, বাইরে যেতে না পারলে ওর প্রতিভার কদর নাকী কোনদিন হবে না। হ্যাঁ, চাকরি করে কে-ই বা বড় হতে পেরেছে, ওর স্বপ্ন গানবাজনা নিয়ে,তা এগোতে চাস যখন এগোনা । কিন্তু না, এই বাড়ি, ওর মা বাবা, অদিতি সবাই মিলে নাকী ওকে এই সংসারে বেঁধে সব শেষ করে দিতে চাইছে। সেদিন নিজের পেটের ছেলের কাছে অপমানিত হতে হতে অদিতির মুখটার দিকে আর তাকাতে পারছিলেন না।
অদিতি যেন এই সবকিছুর সাথে মেলাতে পারছিল না ঠিক। ঐ জন্য যখন নীল বলল, “একটা ভাল অফার পেয়েছি, আমি এবার চলে যাব ঠিক করেছি”, তখন ও বেচারী ভেবে চলেছে “ওদের” কোথাও যাওয়ার কথা হচ্ছে। তাই বোকার মত প্রশ্ন করেছিল,”কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
তারপর যখন নীলের দিক থেকে উত্তর এল,”আমরা নয় আমি, শুধু আমি, আমি যাচ্ছি। তুমি কোথাও যাচ্ছো না।”
তখনও ওর নিরীহ চোখদুটো বিস্ময়ে ভরা,”আমি তাহলে কবে যাব?” তখনও ওর মনে দৃঢ় বিশ্বাস, নীল ওকে ফেলে নিশ্চয় কোথাও যাবে না। যাই মুখে বলুক, এভাবে নিজের স্ত্রীকে ফেলে কেউ কেন যাবে? আর গেলেও একেবারেই কি যাবে?
-“তোমার যাতে কোন অসুবিধা না হয়, আমি টেবিলে সই করে রেখে দিয়েছি পেপারটা, পড়ে নিয়ে সাইন করে দিও।”
কিছু বুঝতে পারছিল না অদিতি, পরমাদেবীরও সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, নিজের ছেলেকে চিনতে পারছিলেন না। ওনারই ছেলের এই রূপ কীভাবে হয়? মা বাবাকে, নিজের স্ত্রীকে কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে সবার সামনে ডিভোর্স নোটিস সার্ভ করেছিল সেদিন নীল।”মা” – অদিতির ডাকে অতীত থেকে ফিরলেন পরমাদেবী।