পাঁচ ঘন্টা পর (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।।

এই ট্রেনটার টুসিটিং, তবে খুব লেট করে এই টাই প্রব্লেম। ঠেলেঠুলে লাগেজ নিয়ে নিজের সিটে গিয়ে পৌঁছাল মৌ।

সিটে বরাবরের মতো এবারও অন্যলোকজন বসে, মানে আবার বচসায় জড়াতে হবে, একে এত ভিড়, রিজার্ভড না জেনারেল বোঝা দায়।

তবে ওর সিটটা বেশ ভাল। শুধু জানলার ধারেই নয়, মুখোমুখি যে সিটগুলো হয় সেটা। সামনে একটা টেবিলও আছে, এই সিটগুলো ওর খুব পছন্দ।

যাই হোক, খুব বেশী বাকবিতণ্ডায় আর জড়াতে হয়নি ওকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিজের সিট্ পেয়ে গুছিয়ে বসল, লাগেজ ওপরে তুলে দিয়েছে, কানে হেডফোন লাগিয়ে চুপচাপ বসল জানলার ধারে, এই সমস্ত কোলাহল থেকে অনেক দূরে, ট্রেন ততক্ষণে স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে।

***************

কানে অরিজিৎ সিং-এর গান জাঁকিয়ে বসায় পিছন দিকের কথা কাটাকাটি কানে আসেনি মৌ-এর। কয়েকজন লোকের মুখভঙ্গি দেখে খানিক সন্দেহ হওয়ায় পিছন ঘুরে তাকাল ও, একজন বয়স্ক মানুষ, মনে হয় তাড়াহুড়োয় অন্য কোচে উঠেছেন, অন্য কোচ থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন, ধাক্কাধাক্কি লেগেছে হয়তো, সেই নিয়ে বচসা।

মৌ কানের হেডফোনটা খুলে বয়স্ক ভদ্রলোকটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, খানিক গলাও চড়ল। ভদ্রলোকের সিট্ মৌ-এর সামনের সিটটাই – মুখোমুখি সিট। ওনার লাগেজ খুব বেশী না হলেও বয়স্ক বলেই হয়তো সামলে উঠতে পারছিলেন না। মৌ এতক্ষণে ভালভাবে দেখলো ভদ্রলোককে, বয়স হয়েছে ভালোই, তবে বেশ পরিপাটি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, ধোপদুরস্থ জামাপ্যান্ট, বাঁহাতে ঘড়ি, পায়ে চটি; দেখলেই কোন এক অজানা কারণে শ্রদ্ধা আসে।

মৌ-এর সাহায্যে ইশারায় ধন্যবাদ জানিয়ে গুছিয়ে বসলেন, মুখে তখনও হাসি লেগে আছে। বাঁধানো দাঁত, বয়স অন্তত ৭২ তো হবেই, তার বেশী বই কম নয়।

মৌ আর কিছু না বলে নিজের গানে ডুবে গেল আর একবার।

কতক্ষণ কাটল খেয়াল নেই, চোখ লেগে গেছিল, বেশ খানিকক্ষণের জন্য, ট্রেন জংশনে থামতে চোখ খুলল মৌ। দুপুর গড়িয়ে এখন সন্ধ্যে নামছে। কোচে চা-ওলার কাছে একটা চা চেয়ে ফোনে খুটখুট করছিল মৌ, সামনের ভদ্রলোক একটা শালপাতায় চপমুড়ি জাতীয় কিছু, আর আরেকটিতে জুঁইফুল নিয়ে উঠলেন। নিজের জায়গায় বসে গুছিয়ে ব্যাগে রাখতে রাখতেই চোখ পড়ল মৌ-এর। ফুল দেখে স্বভাবতই অবাক লাগলো। মৌ-এর দৃষ্টি অনুসরণ করেই বোধহয় ভদ্রলোক বললেন, “অবাক হচ্ছো তো মা? তোমার জ্যেঠিমার জন্য নিয়ে যাচ্ছি, গোঁসা হয়েছে ওনার। এই জুঁই ফুল হলো রাগ কমানোর অব্যর্থ ওষুধ। তাই কিনেই নিলাম।”

অদ্ভুত লাগল মৌ-এর, এখনকার যুগে এই ছোট ছোট আব্দার , ভালোলাগার মুহূর্তগুলো কেউ ভাবতেও পারে? এখন তো চকচকে রেস্তোরায় একটা পার্টি দেওয়া, কিংবা একটা দামী গিফট পাঠিয়ে দেওয়া, ব্যস। সময় কোথায় রাগ ভাঙানোর, কাছে এসে হাতটা ধরার?

আর এই মানুষগুলোকে দেখো, অল্পেতেই কত খুশী, অভাব আছে কিন্তু তাও কোনো নালিশ নেই, ‘দূরত্ব’ ছুঁতে পারেনি এদেরকে। ট্রেন ছাড়ল আবার। আজ অনেকদিন পর মৌ-এর চোখ ঝাপসা, মনে করতে না চাইলেও বারবার চোখের সামনে চলে আসছে ঐ ফর্সা, রোগা করে ছেলেটা, ওর হারিয়ে যাওয়া সায়ন।

*****************

-“মৌ, মা কে বল সায়নকে ডেটল ওষুধ দিতে, ব্লেডে হাতটা অনেকটা কেটে গেছে, রক্ত বেরোচ্ছে।।।”

-“হ্যাঁ বাবা, দেখছি আমি, মা তো বেরিয়েছে, ছবিদির দোকানে গেছে, তুমি আমার সঙ্গে এস।”

সায়নের হাতে ডেটল, ওষুধ লাগিয়ে দেয়ার সময় সায়নের হাতের ছোঁয়া পাওয়া মাত্রই বছর ১৫-এর মৌ-এর সারা শরীরে যেন কারেন্ট খেলে যাচ্ছিল বারবার, আর তার সাথে কী ভীষনরকম লজ্জা। এতো লাজুক ও মোটেও না, পড়ন্ত বিকেলে কালবৈশাকীর উত্তাল হাওয়া বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছিল ঘরটার সবকিছু। মৌ-এর খোলা চুল বারবার উপচে পড়ছিল ওর চোখে মুখে, আর বারবার সায়নের একটাই কথা, “আরে তেমন কিছু হয়নি, এইটুকুতে কিছুই হয় না।” — হঠাৎই বিরক্ত হয়ে প্রথম মৌ সায়নের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “তুমি একটু চুপ করবে? এত কথা কেন? আমি দেখছি তো।”

কী ছিল সেই শব্দগুচ্ছে জানা নেই, কিন্তু অলিখিত অব্যক্ত একটা অধিকার বোধের ছাপ ছিল যেন। সায়ন ভাবতেও পারেনি ওর একটা কথার পরিপ্রেক্ষিতে এমন ঝাঁঝাঁলো বাক্যবাণ ধেয়ে আসবে। কিছু না বলে চুপ করে গেছিল ও। আড়চোখে তাকিয়েছিল ষোড়শীর দিকে। সামনের ষোড়শী সেটা বুঝতে পেরে আর বেশী সময় আটকে রাখেনি। মাথা নীচু করে, “থ্যাঙ্ক ইউ”, বলে চলে গিয়েছিল সায়ন।

***************

মৌ-এর বাবাও ব্যাংকে রয়েছেন, তার পাশাপাশি সন্ধ্যেটা অঙ্কও করান বাড়িতে, তবে রোজ না। আজ যেমন পড়ানো নেই, বেশ খোশ মেজাজেই আজ বাড়ি ফিরলেন মৃণ্ময়বাবু। মৌ রেওয়াজ করছিল, সিঁড়ি দিয়ে বাবাকে উপরে যেতে দেখল, তখনই দেখল বাবার হাতে বেশ বড়সড় খাবারের বাক্স। মৌ এর জিভে জল ততক্ষণে, তাড়াতাড়ি রেওয়াজ শেষ করলে তবেই খাওয়া… রেওয়াজ-এর সময় শুধুই রেওয়াজ, মা-এর কড়া নির্দেশ, তাই আর বেশী না ভেবে বেহাগ রাগটা ধরল মৌ।

***************

জীবনে প্রথম প্রেমের আবির্ভাব কখন ঘটবে, বোঝা বড় দায়। সেটা আদৌ প্রেম কিনা সেই নিয়েই দ্বন্দ্বে থাকে মন, আর তার ওপর যদি সেটা স্কুলবেলার কৈশোরের প্রেম হয়।।। 

এখন একটা নতুন অভ্যাস তৈরী হয়েছে মৌ-এর, রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় একবার বল্লভদের বাড়ির দিকে তাকাবে। বাইরের ঘরের জানলাটা খোলাই থাকে, সেটা মৌ খুব ভাল করেই জানে, সেটা যে কার ঘর সেটাও জানে মৌ – জেনেছে খুড়তুতো ভাই বাবানের থেকে। বাবানের সাথে খুব বন্ধুত্ব ঐ মহাশয়ের। বাবানের ফুটবল প্রিয়, আঁকার শখ, ঐ মহাশয়েরও তাই, তাই মিলটা আরও ভাল হয়েছে আর কী। তাই খবরাখবর পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না মৌকে। আবার একবার তাকালো জানলার দিকে, কেউ যে জানলার থেকে ঝট করে সরে গেল, স্পষ্ট সেটা বুঝতে পারল মৌ, মৌ মাথা নামিয়ে চলে গেল। 

কারেন্ট চলে গেছে, বাবা হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে ‘কে সি নাগ’-এর প্রব্লেম সল্ভ করতে দিয়ে গেছে, মা গেছে রুটি করতে, কাকিমাও রান্না ঘরে, বাবান গেছে আঁকার স্কুলে। জ্যেঠিমা মেজদিকে নিয়ে স্যাঁকরার দোকানে গেল, দিন কয়েক আগেই বিয়ের দিন পাকা হয়ে গেছে মেজদির, সামনের অঘ্রানেই বিয়ে। ঠাম্মি রেডিও শুনছে। সামনে ত্রিকোণমিতির খাতা খোলা ছিল বটে, কিন্তু মৌ-এর মন ছিল অন্য কোথাও। হ্যারিকেনের আলোয় সামনের দেওয়ালে নিজের ছায়াটার সাথে খেলছিল মৌ, আর মনে চলছিল একটাই কথা, ওর সাথে যা হচ্ছে, কাকে বলবে ও? স্কুলে বন্ধুদের বলবে? পড়ায় মন বসছে না, গানের রেওয়াজে মন নেই, সব সময়ই ঐ একটা মানুষের অস্তিত্ব ওর সমস্ত ধ্যান জ্ঞান চিন্তাকে বারবার তছনছ করে দিচ্ছে। কেন, ও জানে না? ও অনেকবার চেষ্টা করেছে এসব না ভেবে পড়ায় মন দিতে, কিন্তু পারছে কই? কিন্তু।।। কিন্তু ভাবতে যে বেশ ভালোই লাগছে সেটাই বা অস্বীকার করে কী করে?

ওর হাসা, ওর আড়চোখে তাকানো, ওর কথা বলা, বারবার হাতটা সামনে রেখে নিজের কথা বলা কী আত্মবিশ্বাসের সাথে, খুব ভাল লাগে মৌ-এর। এই ক’দিনেই বাবার প্রিয় স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন হয়ে গেছে। নীলরঙের টিশার্টটায় মারাত্মক লাগে দেখতে, আর যখন বন্ধুদের সাথে প্রাণ খুলে হেসে কথা বলে।।। দেখতেই থাকে মৌ।  

আচ্ছা, মৌ যে ওকে নিয়ে এত ভাবে, ও কী আদৌ জানে? ও জানে মৌ-এর অঙ্কের খাতায়, বিজ্ঞানের খাতায় অবাধ বিচরণ কার?

মা আসছে আওয়াজ পেয়ে জোর করে আবার অঙ্কে মন দিল মৌ।

**************

মেজদিভাই-এর বিয়ের কেনাকাটা চলছে জোর কদমে। বাড়িতে বিয়ে লাগলে যে কী পরিমাণ আনন্দ লাগে, এবারেই প্রথমবার মৌ তার পুরো মজাটা নিতে পারবে। মেজদিভাই-এর বিয়েটা নিয়ে বাবা, জ্যেঠু সবাই-ই বেশ মেতে আছে, কেনাকাটা তো লেগেই আছে।

মৌ শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বিয়েতে কেমন সাজবে, কী কী করবে, তখনই বাবান উঠছিল উপরে।

-“এই শোন।”

বাবান-এর হাতে আঁকার খাতাতে চোখ পড়ল মৌ-এর। বাবানের হাত থেকে খাতাটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অনেকগুলো প্রশ্ন মৌ-এর মনে এলো বটে, কিন্তু সব শেষে একটা প্রশ্ন করতে পারল মৌ, “এইগুলোয় কী তোর সায়নদাও এঁকেছে নাকি তুইই পুরোটা?”

-“না, না, সায়নদা তো বেসটা…”

অনেক কথা বলতে লাগল বাবান, অনেককিছু বোঝাতে লাগল দিদিকে। মৌ-এর কানে তারপর থেকে আর একটা কথাও প্রবেশ করলো না। প্রতিটি আঁকায় সায়নের হাতের ছোঁয়া আছে, এটা জেনেই পরম যত্নে প্রতিটি ছবিতে, প্রতিটি তুলির আঁচড়ে যেন আকূলভাবে কিছু খুঁজছিল মৌ — সায়নের ছোঁয়া।

।।২।।

কোন স্টেশন এলো খেয়াল নেই, ফোন চার্জ আউট হয়ে কখন গান বন্ধ হয়ে গেছে আর কখন মৌ এত গভীর ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই, সামনের ভদ্রলোকের ডাকে টনক নড়ল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার ভদ্রলোকের দিকে আর একবার নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকাল মৌ। নাহ, খুব বেশীও ঘুমোয়নি, বাইরে একবার তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কতদূর এসেছে, বুঝলো এই অন্ধকারে বৃথা সে চেষ্টা। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ফোনটা সাইডে রেখে মৌ বলল, “কিছু বলছিলেন? সরি, ঘুমিয়ে গেছিলাম তো…”

মৌ-এর কথা আটকেই বেশ উদ্বিগ্ন স্বরে ভদ্রলোক বললেন, “ফোনটা একটু ধরে দিতে পারবে?”

মৌ বলল, “মানে? বুঝলাম না।।।” বলতে বলতেই খেয়াল করল, ভদ্রলোকের সেল ফোনটি থেকে টাওয়ার প্রব্লেমের জন্য ফোন যাচ্ছে না।

-“আমার ফোনে চার্জ শেষ, চার্জ একটু হলেই আমি ফোন ধরে দিচ্ছি, বা আপনি আর কারও…”

ভদ্রলোকের ব্যবহার দেখে অদ্ভুত লাগল বৈকি মৌ-এর। অপেক্ষা করতে যে রাজী নয় একমুহূর্তও তা ওনার মুখে দেখেই বোঝা গেল। মৌ-এর কথা পুরো না শুনেই ফোনটা হাতে নিয়ে চিন্তিত মুখে উঠে ঐদিকে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

মৌ নিজের ফোনটা চার্জে দিয়ে জানলার দিকে চোখ দিয়ে বসল। খানিক্ষণ পরেই ভদ্রলোক ফিরে এলেন সীটে, এবারে আর মুখে কোন চাঞ্চল্য নেই। মৌ তাকাতেই বললেন, “কথা হলো গিন্নীর সাথে, আর চিন্তা নেই। আসলে আমি কাছে থাকলে ওকে মনে করিয়ে দিতে পারি। এখন তাই ফোন করেই মনে করাতে হলো, নাহলে ওনার আর ওষুধ খেতে মনেই থাকে না। তারপর বেকার বেকার কষ্ট পাবে। ঐ জন্য ফোনটা করে এলাম। এখন তো বাপের বাড়িতে, এতো রাগ তার। কিন্তু এগুলো তো আমাকেই করতে হবে।” বলে টলে বেশ স্বস্তি ভরে সীটে বসলেন ভদ্রলোক।

মৌ-এর আর একবার অবাক হওয়ার পালা, ‘এত বছর পরও এখনও এত টান? এত চিন্তা? এত ভালবাসা?” মৌ আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, “আপনাদের নামই তো জানা হয়নি? এখনও এত মিল আপনাদের?”

ভদ্রলোক যেন একটু লজ্জিত হলেন, মুখে হাসির রেশ টেনেই বললেন, “আমি সমীর বাঁড়ুজ্জ্যে, আমার গিন্নী আলো বাঁড়ুজ্জ্যে। কমদিন তো হলো না, প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম সেই তখনকার যুগে।” কথায় লজ্জার সাথে সাথে যেন খানিক অহংকারও, জিতে যাওয়ার অহংকার।

মৌ বলল, “আলো? ভারী মিষ্টি, অন্যরকম নামটা তো।”

সমীরবাবু বললেন, “জানি, জানি, ঐ আমার জীবনের আলো”, চোখের কোণে যেন খুশির জলের ঝিলিক। 

-“আপনারা থাকেন কোথায়?”

-“থাকি ভুবনেশ্বরেই, এখন যাচ্ছি খড়্গপুরে, গিন্নীকে আনতেই যাওয়া। আপনি?”

-“আমি তো ভুবনেশ্বরে থাকি কর্মসূত্রে, যাচ্ছি কলকাতা। হাওড়ায় নামব।”

-“আসলে খড়্গপুরে আমার গিন্নীর বাপেরবাড়ি, ওখানেই আনতে যাচ্ছি, বেশ ক’দিন ধরেই আছে, এবার ভাবলাম আর না, অনেক হয়েছে। আজ বেরিয়ে পড়লাম টিকিটফিকিট কেটে। দাঁড়াও তোমায় একটা জিনিস দেখাই।” বলতে বলতেই নিজের আর একটা ব্যাগ থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বের করলেন, সাবধানে খুলে ধরলেন মৌ-এর সামনে। এত সুবাস সে খাবারের, আর এত মারাত্মক সুন্দর দেখতে। মৌকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলতো এটা?”

-“কী আবার, মাংস। বেড়ে রেঁধেছেন তো। দারুন সুবাস যে।” 

তখন আশপাশের লোকজনও সেই সুঘ্রাণে ফিরে ফিরে দেখছে।

-“আরে না না, মাংস টাংস আমরা খাই না, এ হলো এঁচোড়। বেড়ে রাঁধলে মাংস-এর থেকে কোন অংশে কম না। দেখো তুমিও ধরতে পারোনি।” বলে কৌটটা বন্ধ করতে উদ্যোগী হলেন।

-“অজানা অচেনা লোকের থেকে খেতে আমি বলব না, তাও ঘ্রাণে, রূপে তো বুঝলে।”

-“আপনি তো তাহলে অসাধারণ রাঁধেন।” মৌ বলল।

-“হ্যাঁ, শিখতে হয়েছে। কেন জানো? এ-ও আমার আলোর জন্য, ও-ও খুব ভাল রাঁধে। দু’জনে একসাথে এভাবেই তো কাটিয়ে দিলাম বছরের পর বছর। ভালোই তো কাটল। এবার একসাথে।।।” আর কিছু না বলে, টিফিন কৌটটা সামনের টেবিলে রেখে দিলেন।

মৌ-এর আবার একবার অবাক হওয়ার পালা। এই মানুষটাকে যত দেখছে, ততই যেন ওর বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, চিন্তাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে ধুলোয়, কেউ এভাবেও ভালবাসতে পারে? এতটুকু ছেদ নেই, এতটুকু ভাঁটা পড়েনি এতবছর পরও। এত বয়স্ক দুটো মানুষ এইভাবে ভালবেসে চলেছে দুজন দুজনকে নিরন্তর। এখনও মান অভিমান, রাগ ভাঙ্গানোর পালা চলে তাদের। এখন কতটা জীবন্ত মানুষদুটোর প্রেম, তাই আজও সত্যিকারের বেঁচে আছে, বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে নেই শুধু। আজ এই যুগে দাঁড়িয়েও ঠুনকো সম্পর্কের প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি আছে মানুষদুটো।

-“আপনি আলো দেবীকে যতটা… মানে… এত যে ভাবেন,তাহলে তো আলোদেবী খুব লাকি।।।”

মৌ-এর কথা শেষ না হতেই সমীরবাবু আবার বললেন, “ও না থাকলে তো আমিই থাকতাম না, বাড়ির অমতে প্রেম করে বিয়ে তখনকার দিনে, ভাবতে পারবে না অনেকেই। আর আসলে কী বলতো।।।” বেশ আমতা আমতা করেই বললেন আবার, “আমাদের কোন সন্তান নেই, কিন্তু দুজন দুজনকে আশ্রয় করে…পাশে থেকে,এখন তো দেখি, ছেলে মেয়ে দ্যাখে না, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়, অবশ্যই সবাই না, কিন্তু বোঝাবুঝি, ইগো, সব পেরিয়েও এই বেশ ভালোই আছি। ভদ্রলোকের জিতে যাওয়া হাসিমুখটার দিকে তাকিয়ে মৌ-এর একটা কথাই মনে হচ্ছিল, ওর মানুষকে চেনার জানার বোঝার পরিধিটা সত্যিই সীমিত। ও-ও তো পারতো।।।”

ওর ভাবনা থামিয়ে সমীরবাবু বললেন, “তোমার কথা তো কিছুই জানা হলো না মা। তোমার কলকাতায় বাড়ি কোথায়? বিয়ে, সংসার?

-“হ্যাঁ, বাড়িতে সকলেই আছেন। মা আমার সাথেই ভুবনেশ্বরে থাকেন। মা এত যাতায়াত করতে পারেন না তাই মা ওখানেই আছে।।। বাবা আগের বছরই মারা গেছেন, আর যৌথ পরিবার।।। সকলেই আছেন।”

-“বিয়ে টিয়ে?”

-“উমমম… হুম…আসলে ডিভোর্স কেস চলছে, ঐ জন্যই কলকাতা যাওয়া।”একটা ট্রেন ঝড়ের বেগে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with