ব্যস, সামনেই হাসপাতাল, এসেই গেছে, ফোন করেও তো কোন লাভ নেই, অর্ধেক সময় সায়ন বাড়ির ফোন ধরতো না, আর তাছাড়া এখন ফোনে কথা বলার থেকে সামনে সামনি দেখা হওয়াটা অনেক বেশী জরুরী। এই তো বাঁকটা ঘুরলেই…
একটা প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, চারপাশটায় যেন আঁধার ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে… সায়ন… ঐ তো সায়ন…ওর দিকেই আসছে যে ছুটে… সায়নের চোখে একটা তীব্র ভয় যেন– যেন কিছু হারিয়ে ফেলার একটা প্রচন্ড ভয়। মৌকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়। এটাই তো মৌ দেখতে চেয়েছিল সবদিন…কী ভীষণ যন্ত্রণা। চোখ বুজল মৌ।
*****************
পাল পাড়ার সামনের চায়ের দোকানটা উনুনে আঁচ দিতে শুরু করল, বিকেল হচ্ছে। চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ রেখে একটু বিশ্রাম নেয় কানাইদা, আবার বিকেল থেকেই বিক্রি বাটা শুরু।
অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছে সায়ন। স্যারের টিউশন আজ একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে, টিউশন বলতে আজ সবার সাথে দেখা, মিষ্টিমুখ, খাওয়াদাওয়া ছোট করে। এই সবই আর কী। স্যার সায়নকে আশীর্বাদ করে যখন বিদায় জানালেন শেষবারের মতন। চোখের কোণের জলটা ওর চোখ এড়ায়নি। হঠাৎ করেই সায়নের মনটাও তাই ভারাক্রান্ত। এতদিন নিজেকে শক্তই রেখেছিল, মা মাঝে মাঝেই কেমন করছে। সায়ন তখনও শক্ত হাতে সামলে নিয়েছে ব্যাপারটা,কিন্তু আজ ও নিজেই কেমন যেন ভেঙে পড়ছে। তাই আজ মৌকে বড্ড দরকার।
ডাক্তারীতে চান্স পাওয়ার সময় যে পরিমান আনন্দ পেয়েছিল ও আর ওর চারপাশের সবাই, আজও সেই একই আনন্দ। ওর স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এটা আরেকটা ধাপ, কিন্তু তার সাথে সাথেই একটা মনখারাপ আষ্টেপৃষ্টে সবকিছুর সাথে জড়িয়ে আছে — নিজের পাড়া, বাড়ি, মা-বাবা, বন্ধু সব ছেড়ে,মৌ কে ছেড়ে এত দূরে। জীবন বদলাতে চলেছে, আর তাই…
ঐ যে মৌ আসছে। একটা সাদা সালোয়ার আর রুপোলী কানের ঝুমকোয় বড্ড মিষ্টি লাগছিল সেদিন মৌকে। সায়নের চোখে চোখ পড়তেই ওর মুক্তো ঝরানো হাসিটা সায়নের সমস্ত ভীতি, দুশ্চিন্তা যেন এক নিমেষে উড়িয়ে দিল। এই জন্যই সারাদিনে সমস্ত চাপের শেষে এক ঝলক মুক্ত বাতাস মৌ, সায়নের মৌ। মৌ-এর হাতটা ধরে রাস্তায় হাঁটলেই যেন মন খারাপের মুহূর্ত ধুয়ে মুছে সাফ। সামনের গঙ্গার ঘাটটায় গিয়ে বসল সায়ন আর মৌ। বাড়িতে সবাই খুব খুশী। সায়ন আর কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবে। অন্য শহর, অন্য বন্ধু, অন্য পরিবেশ, সবকিছু মিলিয়ে সত্যিই সায়ন একটু টেন্সড। ও পারবে তো, সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে নিজের পড়াশোনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে? ওর সমস্ত ভয়, মনখারাপ, টেনশন, ‘পারবো কিনা’, সমস্ত রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব-এর একমাত্র ওষুধ মৌ।
মৌ ওর হাতটা ধরেছিল বেশ কিছুক্ষণ । গঙ্গার ঘাটে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে তখন, ওইদিকের ঘাটটায় সন্ধ্যারতির প্রস্তুতি। খুব বেশী কথা হয়নি সেদিন, কিন্তু তাও বহু কিছু বলা হয়ে গিয়েছিল যেন। মৌ-এর হাতটা শক্ত করে ধরেছিল সেদিন সায়ন। মৌ-ও সেদিন কোন কথা না বলেই বুঝিয়ে দিয়েছিল ওর স্থির অথচ গভীর দৃষ্টি দিয়ে – ‘সাথে আছি’।
ব্যস, এটাই বোধহয় অনেক শব্দগুচ্ছের থেকে অনেক বেশী দামী। তারপর পুরোটাই দূরত্বে, শারীরিকভাবে, কিন্তু মানসিকভাবে কোনদিনই নয়। তারপর একসাথে পথ চলার শুরু, কিন্তু তখন দূরত্ব কেন? এর উত্তর সায়নের কাছেও অজানা। যেদিন থেকে নিজেকে চেনা সেদিন থেকে এই মেয়েটাকেও চেনার শুরু।
কোথায় কখন এত বড় গলদ, এত ভুল বোঝাবুঝির জায়গা তৈরী হলো, বারবার ভেবেও তার সদুত্তর পায়নি সায়ন। মৌ-এর সাথে কথা বলতে চেয়েও কোন লাভ হয়নি। ওর মৌ ওর থেকেই বিচ্ছেদ চাইতে পারে, এরকম কথা স্বপ্নেও ভাবেনি সায়ন, কিন্তু এত বড় সত্যিটারই মুখোমুখি আজ ও।
সায়নের হসপিটালেই মৌ চিকিৎসাধীন, মৌ-এর বেডের পাশে বসেই পুরোনো কথাগুলো ভাবছিল সায়ন আজ। অগোছালো হয়ে যাওয়া জীবনটা গোছানোর কী কোনো চেষ্টাই করেনি ও ? সব দোষ, সব অপরাধ কী শুধুই ওর? তা’কী সম্ভব? বেডে রাখা মৌ-এর হাতটায় একবার আঙ্গুলটা ছোঁয়াল সায়ন। বহুদিন পর এই চেনা স্পর্শটা, একটা নিদারুণ ভালো লাগার অনুভূতি যেন…
মৌ-এর জ্ঞান আসতে দেরী আছে। মৌ-এর কপালে ওর অজান্তেই একটা চুমু এঁকে দিল সায়ন, ঠিক যেমনটা শহর ছাড়ার আগে পরম ভরসায় এঁকে দিয়ে গেছিল সেদিন।
*****************
(কয়েকদিন পর)
আগামী পরশু কোর্টের ডেট। মৌ এখন মোটামুটি সুস্থ। সেদিন তাড়াহুড়োয় বাঁকটা ঘুরতে গিয়ে মৌ দেখেইনি, উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা গাড়িটা। সেদিন ধাক্কার পর জ্ঞান হারানোর আগে পর্যন্ত শুধু একটি জিনিসই মনে আছে মৌ-এর, সায়নের ওকে দেখে ছুটে আসা। সায়ন ভাগ্যিস তখন ওখানে ছিল। আচ্ছা, সায়ন তো কই একবারও জানতে চাইলো না, ও ভুবনেশ্বর থেকে এখানে ওর হসপিটালের সামনে কেন?
উত্তর কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে বাবা মারা যাওয়ার পর খুব বেশী আসা হয় না আর, শেষ বাবার কাজে আসা। উৎসব অনুষ্ঠানে কাকা জ্যেঠা, ভাই বোনেরা মিলে একসাথে হৈহুল্লোড়টা সেই আগের মতোই আছে, দুর্গাপুজো, ভাইফোঁটা তো মাস্ট।
নিজের ঘরে বসে পুরোনো কথাগুলোই ভাবছিল মৌ। জানলার গরাদে আঙ্গুল ছুঁইয়ে, বারবার হারিয়ে যাচ্ছিল অতীতের স্মৃতির ভিড়ে। ওর ঘরের জানলা দিয়ে সোজা দেখা যায় সেই জানলা, একদিন যেখানে শুধুই আনন্দ আর সুখস্মৃতি জড়িয়ে ছিল, আজ সেখানেই এত খারাপ মুহূর্ত কেন? সবকিছুতে কী এতটাই ভুল ছিল? ওরা দুজনেই তো চেষ্টা করেছিল। মৌ কী যতটা চেষ্টা করার করেছিল? মৌ নিজের মনকে নিজে কোন দৃঢ় উত্তর কেন দিতে পারছে না তাহলে? ওই মানুষটার সাথে দেখা না হলে মৌ নিজেকে নিয়ে আদৌ ভাবত? আত্মবিশ্লেষণটা তো সব থেকে জরুরী, উল্টোদিকের মানুষটাকে কাটাছেঁড়া করার আগে নিজের দোষগুণ নিয়ে কটা কাটাছেঁড়া করেছে মৌ?
হাতের চোটটা বেশ ব্যথা দেবে মনে হচ্ছে। হাতটা সামলে জানলার ধার থেকে উঠে খাটে গিয়ে বসল মৌ। আজ ওর আলমারির তাকটা সুধার মাকে দিয়ে পরিষ্কার করাতে গিয়ে কটা জিনিস আচমকাই বেরিয়ে এসছে চোখের সামনে। খুব একটা প্রয়োজন নেই হয়তো আর। বিয়ের জোড়, গাছকৌটো এরকমই কিছু। এগুলো নিয়ে কী করবে, ভাবছিলই, ওর ভাবনার মাঝেই ঘরে ঢুকল সায়ন। ওকেই দেখতে এসছে ও আজ।
সায়নকে দেখেই জিনিসগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করলো মৌ। কেন তা জানে না, তবে কোথাও যেন মনে হলো সায়ন যেন ওর দুর্বলতা। সর্বোপরি ওর ভাবনার ব্যাপারে কিছু বুঝতে না পারে, সত্যি, এত দূরত্ব কবে চলে এল? কী এমন হলো যে আজ…
-“কেমন আছ?”
শেষ কবে সায়নের সাথে সামনাসামনি কথা বলেছিল মৌ, মনে পড়ে না। যেদিন নিজের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এলো তারপর সায়নের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আর দেখা করেনি মৌ।
নিজের মনের ভাব যতটা সম্ভব মনেই রেখে শুধু উত্তর দিল –
-“ঠিক আছি। তুমি?”
-“হ্যাঁ, ভালোই আছি।”
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা আবার, কথা আছে বলার অনেক, কিন্তু বলা আর হচ্ছে কোথায়, মান অভিমান, ইগোর পাহাড় ডিঙিয়ে…
-“তুমি হঠাৎ এবাড়িতে?”
-“এই দেখতেই এলাম তোমায় একবার, আর তুমি সেদিন আমার হসপিটালের কাছে কেন এসছিলে হঠাৎ, সেটাও তো আর বললে না।
এই প্রশ্নটারই তো অপেক্ষা করছিল মৌ, সায়ন কেন জানতে চাইলো না একবার, ওর কী কোন দায়, কোন ইচ্ছে নেই সম্পর্কটাকে বাঁচানোর?
মনে মনে অনেকগুলো কথাই আনাগোনা করছিল, শুধু মুখ ফুটে সেটা বলা হচ্ছে না।
মৌ-এর থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সায়নই বলল আবার –
-“ডিভোর্স সংক্রান্ত কোনো কথা কি?”
বাইরে বেশ হাওয়া দিচ্ছে হঠাৎ, হয়তো ঝড় উঠবে, দমকা হাওয়াতেই বাইরের দিকের জানলার পাল্লাটা ধড়াস করে পড়ল, চমকে উঠল মৌ।
কেন ও বলতে পারছে না একবার, “সরি”? কেন সায়ন একবার সরি বলে কাছে টেনে নিতে পারছে না মৌকে। কেন মান-অপমানের পাল্লাটা সুখের মুহূর্তগুলোর থেকে এত ভারী হয় আমাদের জীবনে?
-“তুমি তার মানে সত্যিই চাও এটাই হোক? না, মানে, আমি গেছলাম আসলে…”
অনেক কিছু ভেবে শেষে মৌ এইটুকুই বলতে পারলো।
-“এক মিনিট, এক মিনিট। আমি চাই, মানে? তুমি জানতে চেয়েছ কখনো আমি কী চাই? ডিভোর্সের আইডিয়াটাও তো তোমারই ছিল। আমায় কিছু না জানিয়ে না বলে ডিভোর্স নোটিশ সার্ভ করে এখন এই কথাগুলোর মানে কী?”
-“আমি নোটিশ কেন দিলাম? দিতে বাধ্য হয়েছি। তুমি জানতে চেয়েছ কেন দিয়েছি?”
-“জানতে চাইনি? বারবার তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি, কটা উত্তর পেয়েছি? ঠিক আছে, আজ তো সামনেই আছি, বলো কীসের জন্য এই ডিভোর্স? কী এমন হলো?”
-“বোঝো কিছু তুমি?”
-“না বুঝিনি, আমি জানি তো আমি নির্বোধ, ওই জন্যই তো এতকিছু হলো। তো যাওয়ার আগে বলে দিয়ে যাও কী ভুল করেছিলাম, যাতে পরেরবার এই ভুল আর না করি।”
-“পরেরবার মানে?তুমি আমারই সামনে দাঁড়িয়ে আবার বিয়ে করার কথা বলছ?”
-“হ্যাঁ, বলছি। তুমি না থাকলে আমি আমার লাইফে কী করব, সেটা আমার ব্যাপার, তাই না?”
-“তোমার সাথে কথা বলতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে।”
-“করো ঘেন্না। এমনিও ঘেন্নাই করো, ভালোবাসা থাকলে আর এই ডিভোর্সের মামলায় যেতে হতো না কাজ ফেলে।”
-“তুমি এতটাই অমানুষ, ডিভোর্সের থেকেও তোমার কাছে বড় কথা, কাজ ফেলে আসতে হচ্ছে?”
-“আমার কাজটা তোমাদের কাজের থেকে অনেকটা আলাদা মৌ। এটা তো প্রথম থেকেই জানো তুমি, তোমাদের কাজে দশ মিনিট দেরী করে গেলে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। আর আমার ক্ষেত্রে তার জন্য একটা মানুষ মারাও যেতে পারে। যখন কোন পেশেন্টকে বাঁচাতে পারি না, এখনও সেই রাতটা দু’চোখের পাতা শান্ত হয় না আমার, যদি কিছু করতে পারতাম আর, এটাই মনে হয়। ছাড়ো, তুমি কখনো বোঝার চেষ্টাই করোনি বিয়ের পর সেটা, বিয়ের আগে আর পরে সম্পূর্ণ আলাদা দুজন মানুষ যেন।”
-“মানে তুমি স্বীকার করে নিলে কাজটাই তোমার কাছে আগে? তোমার সংসার, সন্তান সব চুলোয় যাক?”
-“চুলোয় যাক তা তো বলিনি। তুমি তো এই দিকটা সামলে নেবে বলেছিলে, এরকমই তো কথা ছিল, তাহলে? যখন দরকার আমার তখন তো আমি ছিলামই।”
-“না, তুমি ছিলে না, আমার মিস ক্যারেজের পর কোথায় ছিলে তুমি?”
-“সেদিন আমি না গেলে ঐ পেশেন্টটা বাঁচতো না আর মৌ। কী করে ইনসেনসিবেল-এর মতো কথা বলছো তুমি?”
-“আর আমাদের বাচ্চাটা? সেটা নিয়ে কতবার ভেবেছ তুমি?”
-“আমি এই নিয়ে একটা কথাও বলতে চাই না আর, আমার আসাটাই ভুল হয়েছে।”
-“না, না, বলো।”
-“বাচ্চাটা আমারও ছিল মৌ। তোমার সাথে সাথে আমাকেও এটা মানতে হয়েছিল আমিও আর কোনদিন… থাক গে। আমি অ্যাডপ্ট করার কথাও বলেছিলাম, তাতে তোমার মনে হলো আমি করুণা করছি। ভালবাসায় করুণা কথা থেকে আসে মৌ? আর যা হওয়ার নয়, তা নিয়ে বসে থাকলে যন্ত্রণা কী কমবে? নাকি তোমার সেটা ভালো লাগতো? আমার দিকটা একবারও ভেবেছ তুমি?”
-“তুমি তো আর চেষ্টাই করলে…”
-“সেটা তোমার মনে হয় মৌ, তোমার ধারণা সেটা। ডাক্তারটা তো আমি। সব জানা বোঝার পরই আমি অ্যাডপ্ট করার কথাটা বলেছিলাম, তার আগে নয়। আমায় বোঝা, আমায় বিশ্বাস করা, এর কোনোটাই তো করোনি তুমি। যতটা ডিসট্যান্স মেনটেন করা যায় করেছো। বারবার চেষ্টা করেও যখন কোন উত্তর পাইনি, আমি নিজেকে নিজের কাজে ডুবিয়ে দিলাম, তুমি সেটাকেও কীভাবে নিলে? তার জন্য ডিভোর্স? কী বলব আর, সত্যিই…”
চুপ ছিল মৌ। চুপ করল সায়নও। বাইরে অকাল বর্ষণ, বজ্রপাত। মৌ-এর মাথা নীচু, চোখে জল।
মৌকে কাঁদাতে চায়নি সায়ন, দূর থেকেই বলল, “প্লিজ, আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। তুমি নিজে যখন ডিভোর্স চাও, তখন আমি আর এরপর কী বলব? আর তো আমার কিছু বলার মুখও নেই। তুমি যাতে ভাল থাকো, তাই-ই করো। আমি চাই…”
-“সরি।”
-“মানে? কী?”
মৌ-এর চোখ জলে ভর্তি, মৌ আর কিছু বলল না। সায়নই আবার বলল, “কী বললে তুমি?”
-“আমি তো তাও বললাম, তুমি বললে? সব দোষ আমার একার না? তোমার কোনো…”
-“সরি, সরি, সরি,” বলেই সহসা মৌকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল সায়ন। বহুদিন পর পরম আদরে চিরপরিচিত মানুষটাকে এত কাছে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মৌ।
-“তাও, এমন জাজমেন্টাল পাগলী একটা ‘সরি’ বলল, ভাবতেই পারছি না। কী ব্যাপার বলতো?”
কোন উত্তর দিল না মৌ, চোখ বুজে রইল। নাহ, আর এই আলিঙ্গন উপেক্ষা করার সাধ্য বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। ভাগ্যিস ঐ মানুষটার সাথে দেখা হয়েছিল। ঐ পাঁচটা ঘন্টা ওর জীবনে, ওর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনাকে অনেকটা বদলে দিয়ে গেছে। যে মৌ কোনদিন ‘সরি’ বলতে, নত হতে, নিজের ইগোকে দূরে রাখতে জানত না, যে নিজের দিকটা ঠিক মানে উল্টোদিকেরটা ঠিক হতেই পারে না মনে করতো, সেই আজ নিজের ভুলটা নিয়েও ভাবতে পারে।
মৌ নিজের দিক থেকে ঠিক, সায়ন তার দিক থেকে, এই ঠিক ভুল-এর হিসাব করতে গিয়েই আজ এতদিনের সম্পর্কটাকে নিলামে তুলতে বসেছিল। নাহ, কাউকে জাজ করার আগে, কারো সম্পর্কে কিছু ভাবার আগে এবার অন্তত মৌ নিজের দিকটাও পরখ করবে, ভুল ওর দিক থেকেও হতে পারে। শুধুমাত্র নিজেকে ঠিক প্রমান করার তাগিদে এই ইগোর লড়াই মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বৃষ্টিটা বাইরে ধরেছে একটু। সায়ন মৌ-এর কপালে সেই চিরপরিচিত প্রেমের চিহ্নটা আরও একবার এঁকে দিল সযত্নে। দেরীতে হোক, পাগলীটা যে নিজেকে বুঝেছে এই অনেক।
-“ডিভোর্স তাহলে আপাতত ক্যানসেল তো?”
-“ধ্যুত।”
*****************
ট্রেনে করে ফিরছে মৌ, তবে এবারে একা নয়, সায়নও আছে সঙ্গে। চাকরির ট্রান্সফার করিয়ে ভুবনেশ্বর চলে এসেছিল মৌ, সায়নকে ছেড়ে চলে আসার পর।
এবার আর সায়ন কোনো রিস্ক নিতে রাজী নয়, নিজের পোস্টিং তাই ভুবনেশ্বরে করিয়ে নিয়েছে। আর কোনো সমস্যা, কোন দূরত্ব ওদের সম্পর্কে আসুক ওরা দুজনই আর চায় না।
তবে, মৌ-এর হঠাৎ এই পাল্টে যাওয়া, অন্যভাবে ভাবতে চেষ্টা করা, এসবে রীতিমত অবাক সায়ন, শুধু অবাকও না, খুশীও ভীষণ রকম।
জানলা দিয়ে মৌ বাইরের দিকে তাকিয়েছিল, সায়ন তাকিয়েছিল মৌ-এর হাসি মুখ টার দিকে। মৌ-এর থেকেই শুনেছে ও, কীভাবে এই ট্রেনেই আসার সময় দেখা হয়েছিল ঐ ভদ্রলোকের সাথে… ভাগ্যিস হয়েছিল দেখাটা, নাহলে মৌকে…
-“এই শোন।” সায়নের ভাবনার মাঝেই ডাকল মৌ।
-“হুম, কী?”
নিজের ভাবনা টা জানালো মৌ,
-“মানে? কার সাথে? ঐ – ঐ ভদ্রলোক? তাকে গোটা ভুবনেশ্বরে কোথায় খুঁজবে?”
-“আমাকে কী তোমার গাধা মনে হয়? যেদিন পরিচয় হয়, সেদিনই সব জিজ্ঞেস করেছিলাম, একবার ওনার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে, ওনাকেও বলতে ইচ্ছে করছে, ভুল করতে করতে মারাত্মক ভুলটা আর করিনি। জানো, আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদও করে গেছলেন নামার আগে। যাইহোক, যাবে কী না বলো?”
-“বেশ, চলো তবে।”
*****************
সায়ন মৌ-এর ভাঙতে বসা সংসারটা, ওদের দুজনের ইচ্ছায় আর চেষ্টায় আবার গুছিয়ে নিয়েছে ওরা দুজনে মিলেই। দুজনেই কাজে ব্যস্ত, তাও এখন আর দুজনের জন্য দুজনের সময় বের করতে কোনো অসুবিধা হয় না, সামনেই দোল উপলক্ষ্যে ছুটি, উইকেন্ড আসছে, ঐদিনই না হয় পায়ে আবির দিয়ে একটু প্রণাম করে আসবে বুড়ো বুড়িকে। ওদের ফ্ল্যাট থেকে বেশ খানিকটা দূরের পথ, সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ল। মৌ আজ ভীষণ একসাইটেড, অকারণেই আজ ওর ভীষণ আনন্দ মনে, কোথাও যেন জিতে যাওয়ার আনন্দ। আর যার জন্য এর সূচনা তাকে জানাতে যেন আর তর সইছে না। মানুষটা যখন অত ভাল, তার জীবনসঙ্গীটাই বা কেমন? কেমন মানায় বুড়োবুড়িকে? এরকমই বহু চিন্তা করতে করতে পৌঁছে গেল ওরা।
সায়ন বলল, “তুমি তো দেখছি সুপার একসাইটেড।”
মৌ বলল, “একদম। গিয়ে একদম তাক লাগিয়ে দেব।”
লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি খুঁজে পেতে খুব বেশী অসুবিধা হলো না।
যখন ওরা পৌঁছল তখন দুপুর। এই ভরদুপুরে কারও বাড়ী এভাবে আসা ঠিক না, তাও কী আর করা যাবে। মৌ আবার মানুষ দুটোর জন্য এঁচোড়ের তরকারিও বানিয়ে এনেছে, এতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হলো কিনা ভাবছে এখন, আসলে সেদিন ঐভাবে খাবারটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর কে জানে কী করেছিল তারপর মানুষটা। ওর ভাবনা অমূলক জানে ও, তাও পারল না আটকাতে, কৌটোয় করে সব নিয়ে হাজির।
কিন্তু বাড়ি পৌঁছে সদর দরজা বন্ধ দেখে খানিক থমকাতেই হলো ওদের। পাশের এক দোকানে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, রোজই এই সময় বেরোন, দোকানে যান, এসে পড়বেন। তাদের সাথে কথা বলতে বলতেই মৌ মিনিট খানেকের মধ্যেই দেখলো আসছেন অবশেষে সমীরবাবু। হাতে একটা ব্যাগ, এই ভরদুপুরে দোকানে গেছেন, তাই ঘেমে টেমে বেশ কষ্ট করেই আসছেন বটে।
মিনিট খানেকের মধ্যেই ভদ্রলোক এসে হাজির। পাওয়ার চশমার ফাঁক দিকে একবার তাকালেন মৌ-এর দিকে আর একবার সায়ন এর দিকে। নাহ, মৌকে আর কোন ভূমিকা করতে হয়নি, মৌকে দেখে ঠিকই চিনেছেন, তবে এভাবে এখানে একেবারেই আশা করেননি তাই একটু অপ্রস্তুতও হয়ে পড়লেন। সেটা চোখ এড়ায়নি মৌ-এর। সায়নের সাথে আলাপ করিয়ে দিতেই সাদর আমন্ত্রণ জানালেন সমীরবাবু।
ছিমছাম সাজানো এক তলা বাড়ি, বাড়ির সাথে লাগোয়া ছোট্ট বাগান। দরজা খুলে ওদের বসতে দিয়ে ব্যাগ রাখতে ভিতরে গেলেন। ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বাইরে আসতে বললেন। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সরবত নিয়ে বাইরে এলেন।
-“বসো, বসো, ও আসছে।”
-“আপনি তালা দিয়ে বাইরে গেছিলেন, আন্টি বাড়িতেই??”
-“হ্যাঁ, আমি তালা দিয়েই বেরিয়ে যাই। কাছেই দোকান, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসি। ও তো দুপুরে বেরোয় না, তাই কোনো অসুবিধাও হয় না। আরে সায়ন, নাও সরবতটা।”
মানুষটা বেশ। সায়নও বেশ মিশে গেল মিনিট কয়েকের মধ্যে। মৌ ব্যাগ থেকে প্যাকেটগুলো বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, “আগের দিন কী করলেন আঙ্কেল? সব তো নষ্ট হয়ে গেছল। আমি কিন্তু আজ আন্টির জন্য নিজে হাতে বানিয়ে এনেছি।”
শুনে ভীষণ আনন্দ পেলেন বোঝাই গেল, আশাতীত আনন্দ, বললেন,
-“নিজে হাতে বানিয়েছ যখন, তখন নিজে হাতেই দাও। এসো, এসো, ভিতরে এসো।”
-“আঙ্কেল, দোল তো কালই, তাই একটু আবিরও এনেছি।।।”
মৌ-এর মাথায় আবার একবার আশীর্বাদ স্বরূপ হাত রাখলেন সমীরবাবু। ট্রেনের ক্ষনিকের দেখা এরকম মোড় নিতে পারে, উনি নিজেও ভাবতে পারেননি। মৌ-ও কী ভেবেছিল ওই কয়েক ঘন্টা ওর জীবনদর্শনে, ওর চরিত্রে এতটা পরিবর্তন আনতে পারে? একরোখা জেদী মেয়েটাও আজ কতটা সংযত, দেখে অবাক সায়নও।
মৌকে আর সায়নকে নিয়ে সমীরবাবু ভিতরে গেলেন।
*****************
মৌ কী বলবে, খুঁজে পাচ্ছে না। ও তো এরকম কিছু এক্সপেক্ট করা তো দূর, ভাবতেও পারেনি।
হাতে সব প্যাকেটগুলো নিয়ে হতভম্বের মতন দাঁড়িয়েছিল মৌ। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। সায়নও নির্বাক।
সমীরবাবুই আবার বললেন, “দ্যাখো, সেদিন যে মেয়েটার গল্প বলেছিলাম না তোমায়, সে-ই। তোমায় চেনেও না, তাও তোমার জন্য কত কী এনেছে দ্যাখো।” হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন ছবিটির দিকে তাকিয়ে।
এরকম পরিস্থিতিতে কী বলা উচিত, কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিল না ওরা। চলে যাবে? মানুষটা কী মানসিক ভারসাম্যহীন? নাকি অন্যকিছু? হতভম্বের মতো কতক্ষণই বা দাঁড়িয়ে থাকবে? কী বলবে ও?
সমীরবাবুর বারবার বলার পর হাত থেকে আবিরটুকু নিয়ে ছবিতে ছোঁয়াল মৌ। ছবিতে হাসি মুখে একজন প্রৌঢ়া, সধবা, কপালে লাল টিপ, মাথায় ঘোমটা, মানানসই গয়না, লালপাড় গরদে আলো দেবী, সমীর বাবুর অর্ধাঙ্গিনী। ছবিতে জন্ম-মৃত্যুর তারিখটা দেখতে পেলো মৌ, ভদ্রমহিলা মারা গেছেন দশ বছর প্রায়। তার মানে ট্রেনে সেদিন সমীরবাবু যা কিছু বলছিলেন…
-“আমি পাগল, মানসিক ভারসাম্যহীন, এগুলোর কোনটাই নই।”
মৌ আর সায়নকে চমকে দিয়ে সমীরবাবু পিছন থেকে বললেন, “আলো আজও বেঁচে আছে, আমার সাথেই আছে। এই বাড়িতে আমরা একসাথে সংসার শুরু করেছিলাম। এই সংসার, বাড়ি, আমায় ফেলে কোথায় যাবে ও? ও আমায় ছেড়ে থাকতেই পারে না, যার আমায় ছাড়া একমুহূর্ত চলে না, সে আমায় ছাড়া থাকতে পারে? তুমিই বলো।”
মৌ চেয়ে রইল ওনার দিকে, উনিই আবার বললেন, “হ্যাঁ, ওর শরীরটা পুড়ে গেছে, সমাজের নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধ-শান্তিও করেছি। কিন্তু ওর আত্মাটা তো আমার সাথে আছে। ও-ই তো আমার আলো। চেহারা থাকুক না থাকুক, কী যায় আসে? কেউ বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু আমি তো বুঝতে পারি, ও আমার সাথেই আছে সবসময়, রান্নাঘরে যাচ্ছে তো এই ছাদে, এক মুহূর্ত চুপটি করে বসবে না। কিছুই বদলায়নি আগের থেকে, বাইরের লোকের কাছে হয়তো বদলেছে, কিন্তু আমার কাছে সব আগের মতোই আছে। না আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারি, না ও আমায় ছেড়ে। সামান্য মৃত্যু আমাদের আলাদা করতে পারেনি, পারবেও না। — এখন সব ছেলেমেয়েগুলোকে দেখি, কিছু হলো কী হলো না, ছাড়াছাড়ি, সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে। এইট তো আজ সকালেই আলো বলছিল, হ্যাঁ, আলো বলছিল, ‘এদের প্রেম কী আদৌ প্রেম? এত ঠুনকো যে কিছু একটা হলেই ভেঙে দিতে হবে? এত ইগো, কমবেশী ভেদাভেদে ভালোবাসতে ভুলে গেল নাকি সবাই?’ থাক গে, তোমাদের একসাথে দেখে খুব খুশী আমরা। ভাঙ্গন বড় বেদনার, বুঝলে মা! ভাঙন পেরিয়ে তোমরা আবার একসাথে এটাই বিশাল ব্যাপার, খুব ভাল লাগল। আচ্ছা, খেয়ে যেতে হবে কিন্তু। বাড়ির ভিতর কিন্তু আলোর হুকুমই চলে, আমিও তাই-ই মানি, তাই না খেয়ে যেতে পারবে না। হাতমুখ ধুয়ে এস, তারপর একসঙ্গে খেতে বসব সবাই।
*****************
সমীরবাবুর বাড়ির নাম ‘আলো’। বাড়ি থেকে বেরলো যখন সায়ন আর মৌ তখন বিকেল গড়িয়েছে। ওরা গাড়িতে ওঠার আগে অবধিও সমীরবাবু হাত নেড়ে বিদায় জানালেন।
গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে সারাটা রাস্তা মৌ আর সায়ন আর একটি কথাও বলতে পারেনি।
সম্পূর্ণ আলাদা, নিজের তৈরী জগতে দিব্যি আছেন একজন মানুষ তার স্ত্রীর সাথে, রীতিমত সুখী দম্পতি হিসাবে।যাকে সমাজ পাগল ছাড়া কিছু বলতে পারে না… আশেপাশের মানুষ কীভাবে, কী বলে সে সবের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে নিজের জীবনটা, মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। একে পাগলই বা বলবে কী করে? সম্পূর্ণ স্বভাবিক চালচলন, কথাবার্তা। বাকী সবার মতোই সবকিছু – তাহলে? আর পাঁচজনের কাছে যে নেই, তাকে আঁকড়েই ভালবাসায় দিব্যি কাটিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। এরকম ভালবাসাকে কী নাম দেওয়া যায়? মৌ-এর জীবনটাই বদলে দিয়ে গেল এই কয়েক ঘন্টার সাক্ষাৎকার। কোন শব্দ নেই আর ওদের মুখে আজ, গাড়ি এগিয়ে চলেছে, পূর্ণিমার চাঁদ আলো ছড়াতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
। । সমাপ্ত । ।