প্রথম পর্ব
।।১।।
“টিকলি তোর হলে চলে আয় এবার, খেতে দিয়ে দিয়েছি।”
রেওয়াজ শেষে চোখ দুটো এতক্ষণে খুলল টিকলি, ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। প্রণাম করে তানপুরাটা সরিয়ে উঠতে না উঠতেই বেজে উঠল ফোনটা।
সকাল বেলার কাঁচা রোদ এসে পড়েছে লাগোয়া বারান্দাটায়, খানিকটা উঠোন পেরিয়ে টিকলির ঘরের সাদা মেঝেতেও দিব্যি নিজের মত ছড়িয়ে পড়েছে, সকালবেলা এদিকের বারান্দাটা দিয়ে দারুণ সুন্দর হাওয়া দেয়। বারান্দাটার সামনের খোলা জায়গাটা তাই টিকলির খুব প্রিয়। প্রাণ ভোরে রেওয়াজটা করা যায়। ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করতে করতে কাকীমাকে সাড়া দিল ও। ছোট কাকী ভীষণ পাংচুয়াল, খাবার টেবিলে খাবার পড়ে থাকলে ভীষণ রাগারাগি করে। টেলিকম কোম্পানির ফোন, বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কেটে তাড়াতাড়ি নীচের দিকে পা বাড়াল টিকলি।
*****
টিকলিদের একান্নবর্তী এই পরিবারের বাস ভবানীপুরে, ‘মঞ্জরী’। গোটা বাড়ির সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫-১৬। জ্যেঠু, কাকু, ঠাম্মি নিয়ে জমজমাট এই রায়বর্ধন পরিবার। গোটা কোলকাতাতে এই রায়বর্ধন পরিবারকে কিংবা এই ‘মঞ্জরী’কে চেনে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিলই। বরং এই বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেই একবার হলেও ফিরে তাকায় মানুষ। আর তাকাবে নাই বা কেন? এতগুলো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যখন একসাথে একই বাড়িতে, তখন সেই ‘চাঁদের হাট’কে অবহেলা করে এগোয় কার সাধ্যি। সে রায়বর্ধন গ্রূপ অফ কোম্পানিজের বর্তমান কর্ণধার আদিত্যনাথই হোক, কিংবা বিখ্যাত ডিরেক্টর সূর্যনাথ রায়বর্ধন, বা সাধারণ মানুষের মনে ঝড় তোলা খ্যাতনামা সুরকার বিশ্বনাথ রায়বর্ধন। একটিবার এদের দেখতে পেলেই যে চক্ষু সার্থক, আর কি চাই? টিকলির দাদুর পর এতগুলো কোম্পানী, এত বড় বিজনেসের সমস্ত দায়িত্ব টিকলির বাবার উপরেই, এখন অবশ্য খানিকটা টিকলির জ্যেঠতুতো দাদা অনির্বাণ সামলায়।
এই কাজের চাপে টিকলির বাবা আদিত্যনাথ কতটুকু সময় যে বাড়িতে থাকতে পারে, তা হাতে গোনা যায়। ছোট থেকেই বাবার এই চূড়ান্ত ব্যস্ততা দেখতে দেখতে অবশ্য অভ্যস্ত টিকলি। আর মা তো…
*****
“গুডমর্নিং কাকীমণি, গুডমর্নিং বড়মা, গুডমর্নিং ঠাম্মি, গুডমর্নিং দাদু।” বলতে বলতে চেয়ারটা টেনে বসল টিকলি। আজ আবার বৃহস্পতিবার, ব্রেড অমলেটের বদলে লুচি তরকারি, টিকলির প্রিয় জলখাবার। তরকারি সমেত লুচির গ্রাসটা মুখে পুরতে পুরতেই টিকলির দাদু গলাটা একবার ঝেড়ে কথা শুরু করলেন।
বড়মা টিকলির থালায় মিষ্টিটা তুলে দিতে দিতেই চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন টিকলিকে, দাদু বেশ গুরুত্বপূর্ণই কিছু বলতে চলেছেন, সুতরাং খাওয়ায় একটু কম মনোযোগ দিলেই ভাল হয়। টিকলি ছোট থেকেই দাদু ঠাম্মির সবথেকে আদরের, তবে ভালবাসা শ্রদ্ধার সাথে সাথে ভয়টাও ভালই পায়। তাই দাদুর গুরুগম্ভীর মুখটার দিকে একবার তাকিয়েই আবার নিজের প্লেটের দিকে তাকাল ও। দাদু আবার কি বলবে কে জানে!
“পড়াশোনা কেমন চলছে এখন?” মুখের গ্রাস শেষ করে টিকলির দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন আলোকনাথ রায়বর্ধন, টিকলির দাদু।
“ভাল দাদু। এই তো আগের মাসেই পরীক্ষা হল, রেজাল্ট বেরোয়নি এখনও।” টিকলি একটু আমতা আমতা করেই উত্তর দিল। ততক্ষণে অনির্বার খেতে নেমে পড়েছে। দাদাকে দেখে যেন একটু ধড়ে প্রাণ পেল ও। পুরো ডাইনিং হলেই এখন পিনড্রপ সাইলেন্স। আসলে দাদু কথা বললে আর কারও কোনদিনও কথা বলার অনুমতি নেই এই বাড়িতে। দাদা ওর উল্টোদিকের চেয়ারটাতে বসে, চেয়ার টেনে বসতে বসতেই টিকলিকে একবার ইশারায় জিজ্ঞাসা করল হঠাৎ এই গুরুগম্ভীর পরিবেশের কি কারণ। টিকলি কিছু বলার আগেই আলোকনাথই আবার বললেন, “হুম। রেওয়াজটাও রোজ মন দিয়ে করবে, পড়ার সাথেই। যাক গে, আদিত্যর তো আর আজ ফেরা সম্ভব না। ও কাল ফিরছে, ও এলে ওরই বলার কথা ছিল, যাই হোক। এই বাকীরা কোথায়, কটা বাজে এখনও সবাই টেবিলে নেই কেন?” কথা থামিয়ে একবার ঘড়িটা দেখে পরমাদেবীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আলোকনাথ। খাবার টেবিলে ঘড়ি ধরে বাড়ির প্রতিটা সদস্যের উপস্থিতি বাড়ির আর বাকি বাঁধা নিয়মের মতই একটা নিয়ম, যার এদিক-ওদিক খুব একটা করে না কেউ সচরাচর। ভোরবেলা বাড়ির প্রত্যেকের চোখ খোলা থেকে রাত্রে চোখ বোজা অবধি বাড়ির প্রতিটি কাজ চলে ঘড়ি ধরে, প্রতিদিন। আলোকনাথের কথা শেষ হতে না হতেই পুপু, রিমঝিম, বাবাই, জ্যেঠু, কাকু, একে একে চলেই এল খাবার টেবিলে। লোকনাথ একবার তাকালেন মাত্র। সেই হাড়হিম করা দৃষ্টি নিক্ষেপের পর আর কারও মুখে কোন শব্দ থাকে না কার্যত। যে যার জায়গায় বসতে শুরু করলে আবার কথা শুরু করলেন আলোকনাথ।
“হ্যাঁ, তো যেটা বলছিলাম, প্রবালের সাথে কথা হচ্ছিল পরশু দিনই, যদিও আদিত্যরই বয়সী, তাও বয়সের তুলনায় একটু বেশীই যেন ভেঙে গেছে এখন ওর শরীরটা। সুগার, প্রেশার সবরকম রোগই তো বাঁধিয়ে বসে আছে, আর কি। একা তো আর টানতে পারছে না এই শরীরে, তাই এবার একটু একটু করে রাজদীপ ঢুকছে বিজনেসে।
দাদুর কথার মাঝেই ফুট কাটল টিকলির কাকাই, “রাজদীপ ফিরেছে দেশে? ওর তো আরও কয়েকমাস পর ফেরার কথা ছিল না?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে আবার বললেন আলোকনাথ, “এই জন্যই একটু আগেই ও ফিরল, একটু একটু করে ব্যবসাটাও বুঝছে। ভাল ছেলে, কাজের, যাই হোক, এবার শুভ কাজে দেরী করার তো বেকার কোন মানে হয় না। আর সব যখন ঠিক হয়েই আছে। টিকলি মা…”
“হ্যাঁ দাদু, বল।”
“রাজদীপের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে নাও এবার নিজের মত করে। তোমাদের দেখাটা হয়ে গেলে আমরাও তাহলে এবার কথাবার্তা শুরু করতে পারব।”
দাদু যে এতক্ষণ ধরে এই কথাটাই টিকলিকে বলার চেষ্টা করছিল, টিকলি দূরদূরান্তেও ভাবেনি সেটা। এই মুহূর্তটা সেই কারণে একেবারেই আনএক্সপেক্টেড। ও কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নীচু করে চুপচাপ লুচিগুলো গলাধঃকরণ করতে লাগল। বৌদি ওর পাশের চেয়ারটাতেই বসে। ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “এখনই এত লজ্জা পাওয়ার কিছুই হয়নি টিকলি রানি, এখনও অনেক কিছু বাকী। এর মধ্যেই গাল কান লাল!”
বৌদির দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকাল শুধু, দ্বিগুণ হারে যেন ওর ফর্সা মুখটা লাল হতে লাগল।
সামনে জ্যেঠু, কাকু, দাদাই, সকলেই যেন এবার একটা দুর্দান্ত টপিক পেয়ে গেছে, টিকলির লেগপুল করার জন্য। আর এই সবকিছু টিকলিকে শুনতেও হচ্ছে, উঠতেও পারছে না ও, দাদু না ওঠা অবধি। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে কথাগুলো হজম করছিল টিকলি।
“তাহলে তো এবার একদিন প্রবালদা, বৌদি এদেরকে আসতে বলতে হয়। নাকি আমরাই একদিন যাব? মেয়ের বাড়ি তো আমরা।”
“হ্যাঁ, আর কথাবার্তা না হলে তো কিছু শুরু করাও যাবে না। এটা কি মাস? আষাঢ় তাই না মা? কখন ডেট ফেলবে কিছু ভেবেছ?”
“এই প্লিজ গরমকালে না। এই অনিদের বিয়েটা গরমকালে ফেলে কি সমস্যা যে হয়েছিল, ঐ ভ্যাপসা পচা গরমে আর যাই করা যাক, বিয়েবাড়ি এনজয় করা যায় না।”
“হ্যাঁ, প্লিজ শীতকালে। বড়দা-এর সময়ও আমি কতবার বলেছিলাম, কেউ কথা শোনেনি, মেজদিরটা শীতকালেই হোক। উফফ! অ্যাম সো একসাইটেড!”
টিকলির মনে হচ্ছিল এক্ষুণি উঠে ঘরে চলে যেতে, কান মাথা যেন ভোঁ ভোঁ করছে। এরকম হঠাৎ করে কোন একদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে নিজেরই বিয়ের প্ল্যান নিজেকেই নির্লিপ্ত মুখে শুনতে হচ্ছে। এ তো মহা সমস্যা! দাদুর প্লেটের দিকে তাকাল একবার, উফফ! শান্তি, হয়ে এসেছে এবার। আলোকনাথ চেয়ার ঠেলে উঠতে না উঠতেই খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল টিকলি। না, আর নেওয়া যাচ্ছে না। লজ্জা? অস্বস্তি? হঠাৎ আসা এরকম একটা সংবাদ, সেটা ভাল না খারাপ আলোচ্য বিষয় যদিও। এই সবকটা অনুভূতি একসাথে মিলেমিশে পেটের ভিতর কেমন গুড়গুড় করছিল টিকলির, কানে যেন কেউ তালা মেরে দিয়ে গেছে, কোনক্রমে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগাতে পারলে শান্তি। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে এদিক ওদিক, সামনে পিছনে আর না তাকিয়ে, না শোনার ভান করে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বারান্দার সামনে নিজের বিছানায় বসে শ্বাস নিল ও।
।।২।।
টিকলিদের বাড়িটা বানিয়েছিলেন আলোকনাথবাবুর বাবা, বাবার তৈরী এই ‘মঞ্জরী’কে মনপ্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন আলোকনাথ, একদম আগের মতই। টিকলি শুনেছে দাদুর বাবা যখন এই প্রাসাদপম বাড়িটা তৈরী করেছিলেন, একেকটা ঘরের নামকরণও করেছিলেন নাকি সাধ করে। সময়ের সাথে সাথে সেই নাম হয়তো বিস্মৃত, কিন্তু কিছু কিছু শব্দ এখনও রয়েই গেছে, সঙ্গে সেই পুরানো আমেজটাও। আলোকনাথবাবু সেই সময়কার জিনিসগুলোকে যথাসম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। সব জায়গায় যে সফল হয়েছেন তা নয়। তবে বাড়ির বেশীর ভাগটাই যেন অত বছর আগেকার কত স্মৃতি রোমন্থন করে চলে নিজের মতন করে। খাবার ঘর, চওড়া খাড়া সিঁড়ি, প্রতিটা ঘরের খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলো, বাড়ির মেঝে থেকে শুরু করে আগেকার দিনের খাবার জন্য ব্যবহৃত কাঁসার বাসন, এমনকী সেই বাসনে খোদাই করা বাড়ির প্রতিটা সদস্যের নাম, আজও সযত্নে রান্নাঘরের আলমারিতে পরমাদেবীর তত্ত্বাবধানে। টিকলির ঘরটার নাম ছিল নাকি হাওয়ামহল। সামনে দক্ষিণ খোলা বারান্দা থাকায় এই ঘরটায় মুক্ত বাতাসের অবাধ বিচরণ, তাই হয়তো এরকম নামকরণ। বাকী ঘরগুলোর মত এই ঘর, ঘরের দরজা জানলা, আসবাব, সামনের লাগোয়া বারান্দা এই সবটুকু জুড়ে যেন সময়টাকে বন্দী করা হয়েছে সযত্নে। এই ঘরের কোণে দেওয়ালের আনাচে কানাচে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে আজ থেকে ১০০বছর কি তারও খানিক আগের কোন এক সময়ে।
টিকলি ওর ঘরের ছোট্ট আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে হঠাৎ করে রোদ ছাপিয়ে মেঘের আনাগোনা। সকালের কাঁচা রোদ ঢাকা পড়েছে তাই মেঘলা আড়ালে, ঝোড়ো হাওয়া বারান্দা পেরিয়ে ঘরের ইতিউতি ছড়িয়ে পড়েছে নিজের মত। টিকলির একঢাল কোঁকড়া খোলা চুলকেও কোন রেয়াত করার প্রশ্নই নেই।
ঘন মেঘের মত কুঁচকানো চুলগুলো হাওয়ার সাথে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে টিকলির কপাল, চোখ, গালের তিল, ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে রাখা স্মিত হাসিটাকে।
নিজের বিয়ে নিয়ে কথাটা শোনার পর থেকেই যেন একটা ঘোরের মত লাগছে টিকলির। একটা অদ্ভুত অনুভূতি, ভালো না খারাপ তা জানে না ও। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ও তো রাজদীপকে সেই ছোট থেকে চেনে, আর ছোট থেকেই জানেও, তাহলে? হয়তো এত তাড়াতাড়ি, আচমকা এই খবরটার জন্য প্রস্তুত ছিল না ও। তাই হয়তো… রাজদীপের সাথে প্রায় পাঁচ-ছয় বছর দেখা সাক্ষাৎ নেই। এখন কতটা বদলে গেছে কে জানে। টিকলিও তো কত বদলে গেছে, সবাই-ই বদলায়। আচ্ছা যদি এই শীতেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়? তার মানে তো আর কয়েক মাস? এখনও যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর। ও তো…
টিকলি আর বেশী কিছু ভাবার আগেই দরজায় টোকা পড়ল। ব্যস, খুব ভাল করে জানে ও কারা এসেছে।
“যাচ্ছি, দাঁড়া”। চুলটা গুটিয়ে বেঁধে দরজা খুলল ও।
*****
দরজাটা খুলতেই একঝাঁক পঙ্গপালের মতন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল দাদা, বৌদি, পুপু, বাবাই সব ।
“কিরে, দরজা খুলতে এত দেরী করলি কেন? কি করছিলি দিনে দুপুরে দরজা লাগিয়ে?” বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে সটান খাটে উঠে পড়ল দাদা। টিকলিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বৌদি ফোনটা ওর চোখের সামনে দোলাতে দোলাতে বলল, “এই যে আমার ননদিনী, একবার দেখুন কি এনেছি আপনার জন্য।” বলেই টিকলির হাতে ফোনটা ধরিয়ে বসল সোফাটায়। বাবাই আর পুপু ততক্ষণে টিকলির ঘাড়ের উপর উঠে বকরবকর শুরু করে দিয়েছে।
“উফফ, কতদিন পর আবার একটা জম্পেশ বিয়েবাড়ি! আমার সক্কাল সক্কাল খবরটা পেয়েই কি যে আনন্দ হচ্ছে।”
“আমি তো কবে কি পরব ঠিক করে ফেলেছি এখনই। বৌদির সাথে শপিং-এ যাব, সর্টেড।”
চারপাশে সবার কথাগুলো একটু একটু করে আবছা হচ্ছিল টিকলির কানে। সামনে ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছিল ছবিটা। আর কোন কথা খুব একটা কানে ঢুকছিল না ওর। সবাই নিজের মত কথা বলেই যাচ্ছিল একের পর এক, টিকলি সেই দিকে কান না দিয়ে ছবিটাই দেখছিল একদৃষ্টে। এটা যে প্রথমবার রাজদীপকে দেখছে তা তো নয়, কিন্তু এত ভালভাবে খুঁটিয়ে এই প্রথম। চোখে রিমলেস চশমা, পরনে শার্ট প্যান্ট ব্লেজার্স – আদ্যোপান্ত ফর্ম্যাল, ধোপদুরস্ত, মাথার চুল থেকে হাতঘড়ি কিংবা পায়ের জুতো সবটুকু যেন ভীষনরকম সাজানো গোছানো। এত সাজানো গোছানো পরিপাটি দেখলেই টিকলির বরাবরই যেন বড় বেশী মেকী মনে হয়ে সবটা। তার থেকে খানিক অগোছালোই যেন ভাল। রাজদীপের চোখদুটোর দিকে তাকাল টিকলি, তখনই ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিল পুপু।
“কি? খুব তো? খুব দেখা হচ্ছে। কেড়ে নিলাম বলে রাগ হচ্ছে? এখন কাল কোথায় মিট করবে, কি খাবে, কি বলবে, কি পরবে সেগুলো একটু ভাবুন, বুঝলেন?”
“উফফ! তোরা সকাল থেকে এমন করছিস যেন আমি কোনদিন ছেলেটাকে দেখিনি, ওর ব্যাপারে কিচ্ছু জানতাম না, সবই নতুন। সবই তো ঠিকই ছিল, এত্ত এক্সাইটমেন্ট তোদের কথা থেকে আসছে বাবা কে জানে?”
স্মিত হেসে নিজের বুকের ভিতরের ধড়ফড়ানিটাকে যথা সম্ভব লুকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বারান্দাটা থেকে বড় রাস্তা থেকে শুরু করে তিলোত্তমার সাত সকালের ব্যস্ততা, বেশ উপভোগ করে ও। একটা জোরে শ্বাস নিল, একটু যেন নার্ভাস লাগছে। এভাবে কখনও কারও সাথে দেখা করতে যায়নি ও। রেস্টলেস লাগছে খুব। মা-র কাছে না গেলে মনটা শান্ত হবে না কিছুতেই, জানে ও।
।।৩।।
(পরদিন)
আর মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরোবে টিকলি। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে নিচ্ছিল একবার। কোঁকড়া চুলটাকে অতিকষ্টে বেঁধে একটা খোঁপার আকার দিয়েছে ও, মন্দ লাগছে না কিন্তু, চোখের কোণে ঘন কালো কাজল, কপালের টিপ, হালকা গয়না আর মায়ের সাদা ঢাকাই জামদানী শাড়ীটা একদম পারফেক্ট। লিপস্টিকটা আরেকবার ঠিক করে নিয়ে উঠে পড়ল ও। আর বেশী ভেবে লাভ নেই, বেশী ভাবলেই টেনশন বাড়বে। বাবার তো আজই ফেরার কথা, কখন আসবে কে জানে? আচ্ছা এইভাবে আজকেই ডেটে যাওয়ার কি খুব দরকার ছিল? বাবার সাথে তো সরাসরি ওর কোন কথাই হলো না। নেহাত দাদু বলল তাই, নয়তো আজকেই এত তাড়াহুড়ো করে…
নিজেকে যতই প্রবোধ দিক না কেন, অস্বস্তি যে ওর হচ্ছিল সেটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। রতনদা নীচে গাড়ি রেডি করে অপেক্ষা করছে। ঠাম্মা দাদুকে চট করে বলে নীচে নেমে এল টিকলি। কোন এক্সাইটমেন্ট তো নেই উল্টে একটা অসম্ভব অস্বস্তি কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। গাড়িটা ছাড়লে ফোনটা নিয়ে কয়েকমুহূর্ত ভেবে ডায়াল করল ও – ‘রাজদীপ’।
“হ্যাঁ কোথায়?” ওপাশ থেকে গলাটা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠল টিকলির। রাজদীপের সাথে যতটুকু কথা হয়েছে টেক্সটেই। এতগুলো বছর পর গলাটা শুনল ও। বদলে গেছে, ইনফ্যাক্ট বেশ বদলে গেছে, একটা ছেলের গলা এক্সপেক্ট করেই ফোনটা ধরেছিল, আগের মতন, কিন্তু এই ক’বছরে ছেলেটা বদলে আজ আদ্যোপান্ত সুপুরুষ! টিকলির বুকের ধুকপুকুনিটা আরেকটু যেন বেড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে গলাটা ঝেড়ে বলল, “এই তো গাড়িতে, এখন ময়দান ক্রস করছি, তু… তুমি কোথায়?
“ইস, তুমি তাহলে আগেই পৌঁছে যাবে, তুমি পৌঁছে ওয়েট কর তাহলে একটু, আমার একটু দেরী হবে।”
“ওহ, ওকে, হ্যালো, হ্যালো।” বার কয়েক হ্যালো বলেও ওপাশ থেকে কোন শব্দ না পেয়ে ফোনটার দিকে তাকাল টিকলি, “ধ্যুর! আবার ফোনটা অফ হল কেন? চার্জ তো ছিলই।”
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর কোন পরিবর্তন না দেখে ফোনটা রেখে দিয়ে জানলা দিয়ে শহরটার দিকে তাকাল এবার। কাঁচ বন্ধ থাকায় আর ফোনটা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খেয়ালই করেনি শহরের ভিজে রাস্তাটাকে। ঝোড়ো হাওয়ায় বড়বড় গাছগুলো কেমন নুইয়ে পড়েও আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, চায়ের দোকানের সামনে বেশ ভিড় জমিয়েছে অফিস ফেরত যাত্রীরা, একজন মা বাচ্চার হাত ধরে তাকে নিয়ে ফিরছে, সে বেচারার রেনকোট পরে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, মা নিজে প্রবল বৃষ্টির তোড়ে ভিজলেও ছোট্ট ছেলেটাকে যতটা সম্ভব বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলছে।
টিকলির গাড়িটা সিগন্যালে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। হাঁ করে মা ছেলের কীর্তিকলাপ দেখছিল ও। স্কুল ফেরত ভারী ব্যাগ ওয়াটার বটল তার উপর রেনকোটে গলদ ঘর্ম ক্ষুদে মানুষটার সম্ভবত রোল চাউমিন খাওয়ার খুব ইচ্ছে। দোকানের সামনেটায় দাঁড়িয়ে মায়ের হাত পা ধরে বেজায় কাকুতি মিনতি ক্ষুদের, মার ততই দোকান থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। হেসে ফেলল টিকলি। খুব ভালো লাগে মানুষের এই ছোট ছোট সুন্দর মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করতে, ঐ দ্যাখো সিনেমাহলে ঢোকার আগে সম্ভবত বয়স্ক ভদ্রমহিলার ইচ্ছেপূরণ করতে তার ফটো ফোনে ক্যামেরাবন্দী করছেন ভদ্রলোক, কিন্তু বার দুই তিনেক পরও ম্যাডামের পছন্দ হচ্ছে না। প্রচেষ্টা জারি রইল, টিকলির গাড়ি ততক্ষণে ছেড়ে দিল। ব্যস্ত শহর ধীরে ধীরে আলোর মালায় সাজতে শুরু করেছে একটু একটু করে। হু হু করে এগোচ্ছে গাড়ি, হাতঘড়িতে সময়টা একবার দেখে নিল টিকলি। রাস্তার ধারের ফুটপাথে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ফুচকা খেতে ব্যস্ত। দুজনেই অগোছালো হয়েও বেশ পরিপাটি। কে কত তাড়াতাড়ি খেতে পারে, তার কম্পিটিশন চলছে। মেয়েটার পরনে একটা সাদা আর ছাই রঙা কুর্তি, কানে রুপোলী ঝুমকো, অগোছালো করে বাঁধা চুল, ছেলেটার পরনে গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবী, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল মেয়েটাই খানিক অগোছালো করে দিল হেসে। হাসতে গিয়ে বিষম খেল ছেলেটা। ছেলেটার গালে হালকা দাড়ি, এতক্ষণে খেয়াল করল ছেলেটার হাসিটা বড্ড মিষ্টি, ছেলেটার কাশি শুরু হতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েটা। ছেলেটা কেশে মুখ চোখ লাল করে ফেলেছে ততক্ষণে, এবার হেসে ফেলল। আসলে কিছুই হয়নি, ইচ্ছে করে মজা করছিল একটু, মেয়েটা চোখ পাকিয়ে মারতে যেতেই ছেড়ে দিল টিকলির গাড়িটা আবার। এরকমই টুকরো টুকরো অসম্পূর্ণ গল্পগুলোকে সঙ্গী করে পৌঁছে গেল টিকলি গন্তব্যে। গাড়ির কাঁচের উপর দিয়ে শেষ বেলার সোনালী আলোটা গেলে পড়েছে টিকলির মুখের উপর, এলোমেলো কোঁকড়া চুলগুলো টিকলির চোখের উপর গালের উপর খেলে বেড়াচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলোকে কানের ঝুমকোর পাশে সরিয়ে, শাড়ীটা সামলে গাড়ী থেকে নামল ও। এই দিকটায় বৃষ্টি আগে হয়ে গেছে, মাটির সোঁদা গন্ধ, ভিজে রাস্তা আর এদিক ওদিক গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া বিন্দু বিন্দু জল, সব মিলিয়ে ভারী সুন্দর পরিবেশটা।
“রতনদা তুমি গাড়ী নিয়ে চলে যাও তাহলে, আমি তো রাজদীপের সাথেই ফিরব।”
“ঠিক আছে টিকলি দিদি, আমি এলাম তবে। কোন অসুবিধা হলে ফোন করে নিও।”
বেরিয়ে গেল রতনদা। এই ‘স্কাইলাইট ইন্টারন্যাশনাল’-এ টিকলি আগেও এসেছে, তাই সেদিন থেকে কোন অসুবিধা নেই। ফোনটা ও করার চেষ্টা করল আবার, লাভ হল না কোন। টেবিল নম্বর জানাই ছিল, কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল টিকলি।
*****
টেবিলের পাশের কাঁচের জানলাটা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে টিকলি। বাইরে সন্ধ্যে নেমে যাওয়ায় আর সেভাবে অত ভালো কিছু দেখা যাচ্ছে না আর। ও তো রাজদীপের গাড়িটাও চেনে না। আবার দেখল ঘড়িটা, এইভাবে কাউকে অপেক্ষা করানোর কোন মানে হয়? বিরক্ত লাগছিল এবার ওর। মনে মনে বাবা আর দাদুর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। সবেতেই বাড়াবাড়ি! কিন্তু সেভাবে দেখতে গেলে ও-ও যে খুব আপত্তি করেছিল তাও তো নয়। এটাই তো ওর প্রব্লেম, ওর যেটা মনে, সেটা কখনও খোলাখুলি কেন নিজের লোককে বলতে পারে না কে জানে। ও তো কমফর্টেবল ছিল না, অস্বস্তি হচ্ছিলই, কেন তখন বলল না কিছু? এই জন্যই মা-র কাছে বকা খায়। কেন যে মায়ের মত কথা বলতে পারে না ও কে জানে। মা কি সুন্দর করে কথা বলে, স্পষ্টবাদী নির্ভীক একজন মানুষ যখন ওর মা, সেখানে ও নিজের কথা বলতে কেন যে এত কিন্তু কিন্তু করে? অনেকবার ভেবেছে, আয়নার সামনে অনেকবার প্র্যাকটিসও করেছে, কিন্তু আসল সময় কিছুই বলতে পারে না। এই তো আগের মাসে এম.এ ফার্স্ট ইয়ার এক্সাম শেষ হয়েছে, এক্ষুণি দেখা সাক্ষাৎ, বিয়ের ডেট ফাইনাল এই সব কিছুর জন্য যে ও রেডি ছিল তা তো নয়। একটু গুছিয়ে নেওয়ার, নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য সময় তো ওরও দরকার। কিন্তু ও তো কিছুই বলেনি। ওর আপত্তি আছে কি নেই, সেই নিয়ে নিজের জন্য একটি শব্দও খরচ করেনি ও। এখন আর বাবা দাদুর উপর রাগ করে কি হবে? এমনিও ও বাড়ি ফিরে আবারও যে কাউকে কিছু বলতে পারবে খুব ভাল করে জানে ও। এর মধ্যেই দু’বার ওয়েটার জিজ্ঞাসা করে চলে গেছে, কি এম্ব্যারেসিং! মাথাটা অসহ্য ব্যথা শুরু হলো এবার, ফোনটাও অন হল না। রতনদাকেও বাড়ি পাঠিয়ে দিল, এবার ফিরবেই বা কি করে ও? ছোট থেকেই ভিতর ভিতর রাগ হলে কাউকে কিছু বলতে তো পারত না, কাঁচা লঙ্কা কামড়ে খেয়ে নিজের রাগ মেটাত। ছোট থেকেই এই অদ্ভুত অভ্যাসটা আছে টিকলির। এদিকে ওদিকে আর না তাকিয়ে লঙ্কার বাটিটা টেনে নিল ও।
*****
“এক্সকিউজ মি! আপনার আই থিঙ্ক কোন সমস্যা হয়েছে, অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আসলে…”
হোটেল থেকে বেরিয়ে বন্ধ ফোনটা নিয়ে কয়েক মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে টিকলি, একেবারেই ব্ল্যাঙ্ক। কি করবে বুঝতে পারছে না, ক্যাব বুক করতেও পারবে না, বাড়িতে যোগাযোগটাও করতে পারছে না, কাছে শুধু কার্ড আছে ক্যাশও নেই, রতনদাকেও বারণ করে দিল, আর গাড়িতে সর্বক্ষণ যাতায়াত করার কারণে বাসরুট বা রাস্তাঘাট এসবের সম্যক ধারণা একেবারেই…
মুখটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সন্দিগ্দ্ধ চোখে তাকাল টিকলি। একগাল দাড়ি, এলোমেলো চুল, চোখে চশমা, পরনে জিন্স পাঞ্জাবী পরা একটা ছেলে ওর পাশটায় দাঁড়িয়ে। তার মানে এতক্ষণ ধরে ছেলেটা ওকে লক্ষ্য করছিল। এখন একেবারে উপযাজক হয়ে…কোন উত্তর না দিয়ে ও মুখটা ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। এই সমস্ত ছেলেগুলোকে একদম সুবিধের মনে হয় না ওর। একবার আকাশটার দিকে চাইল, এই যদি এবার বৃষ্টিটা নামে, সোনায় সোহাগা। কি করে যে কি করবে? এবার সত্যিই চাপ লাগছে টিকলির।
ওর উত্তর না পেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা ওর মনের কথা বুঝে নিয়েই যেন বলল, “আরে আমি আপনাকে ফলো টলো করছি ভাববেন না আবার, আপনার পিছনের টেবিলটাতেই ছিলাম, আপনি ওরকমভাবে একলা বসে বসে লঙ্কা চিবোচ্ছেন তারপর… না মানে চিবোতেই পারেন, অ্যাবসোলিউটলি ইওর চয়েস, এখানে এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে তখন থেকে তাই ভাবলাম…”
ছেলেটার মুখটায় কেমন যেন একটা মায়া মায়া ভাব। টিকলি রাগ বা বিরক্তি প্রকাশের চেষ্টা করেও পারল না। খানিক চুপ থেকে বলল, “আপনি খেতে এসেছিলেন, খাওয়া হয়ে গেছে তো? এখনও এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমি অনেক লঙ্কা খেয়ে নিয়েছি তো, তাই ঠান্ডা হাওয়া খাচ্ছি।” বলে একটু দেঁতো হেসে মুখটা ঘুরিয়ে নিল আবার। একেই মাথা যন্ত্রনা তার মধ্যে এই উৎপাত। খোঁপাটা ইচ্ছে করছে এক্ষুণি খুলে ফেলতে, “উফফ! কি অসহ্য!”
“না, না, নিজের টাকায় এতবড় হোটেলে খাবার ক্ষমতা নেই ম্যাডাম। আসলে আমাদের স্যারের আজ জন্মদিন, তাই বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে আর কি। আর আপনাকে ফলো টলো করিনি, চলে যাচ্ছি, আপনি বরং হাওয়াই খান। ফোনটা তো চলছে না আপনার দেখতেই পাচ্ছি, তাই… যাক গে। এখন যেচে পড়ে সাহায্য করতে গেলেও মানুষ ভুল ভাবে। চলি ম্যাডাম।”
আর না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ছেলেটা। টিকলি ফোনটা বার তিনেক ঠুকে হাল ছেড়ে দিল এবার, মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে টেনশনে। ঘড়িটা দেখল একবার, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গেছে কোথায়, এবার তো যেভাবেই হোক বাড়িতে একটা ফোন করতেই হবে। আশেপাশে তেমন লোকও নেই, ছেলেটাও চলে গেল।
আচ্ছা ছেলেটার থেকে ফোনটা নিয়ে একবার বাড়িতে ফোন করলেই তো হয়। ছেলেটা তো ফোন দিতেই চেয়েছিল, ফোনটা একবার নিলে কি আর এমন ক্ষতি হবে? কিন্তু ছেলেটা গেল কোথায়? এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল বাসস্টপের দিকে খানিকটা এগিয়ে গেছে ছেলেটা। ওর সঙ্গে যে দু একজন ছিল, তারা উল্টো দিকের ফুটপাত ধরে এগিয়ে গেল। না আর দেরী করা ঠিক হবে না, কোন একটা ফোন থেকে বাড়িতে ফোনটা এবার করতেই হবে। আর দেরী না করে শাড়ীটা সামলে এগোল টিকলি।
“এক্সকিউজ মি! শুনছেন?”
“একি! এতে তাড়াতাড়ি হাওয়া খাওয়া হয়ে গেল? ঝাল লেগেছিল তো খুব আপনার! বলুন।”
টিকলি এতক্ষণ ছেলেটার দিকে ভালভাবে সোজাসুজি তাকাল। এলোমেলো চুল, একগাল দাড়ির মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল দুটো চোখ, আর ততোধিক উজ্জ্বল হাসিটা। টিকলি কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেসে বলল, “কিছু মনে করবেন না, আসলে এমন বিশ্রীভাবে ফেঁসে গেছি, কি করব মাথা কাজ করছিল না আসলে। ব্যাগে বিন্দুমাত্র ক্যাশ নেই, আর ফোনটাও…”
“এই নিন, করুন ফোনটা। অসুবিধা নেই।” টিকলির কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা টিকলির হাতে দিল অজানা অচেনা ছেলেটা। হাসল, বেশ আকর্ষণীয় লাগল হাসিটা টিকলির। এরকম অগোছালো ও এলোমেলো হয়েও হাসিটা এত মিষ্টি হতে পারে, ভাবতেই পারেনি ও।
টিকলি একটু হেসে ফোনটা নিয়ে ডায়াল করল অবশেষে বাড়িতে।
ফোনে কথা বলতে বলতেই লক্ষ্য করছিল ছেলেটাকে, বেশ একটু দূরে সরেই দাঁড়াল ছেলেটি। লম্বা, একটু রোগাটে গড়ন, ছেলে হিসেবে বেশ ফর্সা, এত ফর্সা বলেই হয়ত চুল দাড়িটা হালকা বাদামী রঙের। আর এত ফর্সা বলে হাসলে নাক কান গালে লালচে আভা, আর হাসিটা বড্ড সুন্দর, চোখের চশমাটার জন্য উজ্জ্বল চোখদুটো যেন চাপা পড়ে যায় খানিকটা, এলোমেলো চুলগুলো সামনে পড়ে কপালটা ঢাকা। চেহারাটা লম্বার দিকে হওয়ায় পাঞ্জাবীতে ভারী সুন্দর মানিয়েছে। হাঁ করে তাকিয়ে ছিল টিকলি, কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল হয়তো। পাশ দিয়ে হুশ করে একটা গাড়ি পেরতে টনক নড়ল ওর, নিজেকে সামলে নিল তৎক্ষণাৎ। ফোনটা রেখে স্মিত হেসে বলল, “এই যে আপনার ফোন। খুব উপকার হল আমার। থ্যাঙ্ক ইউ মি…”
“অভিমন্যু, অভিমন্যু ব্যানার্জী। এইটুকুর জন্য আর থ্যাংকস বলতে হবে না ম্যাডাম।” চশমাটা ঠিক করে নিয়ে অল্প হেসে ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করল অভিমন্যু। কিন্তু ট্রুকলারে এটা কার নাম দেখাচ্ছে। হাঁ করে কিছুক্ষণ হতভম্বের মতন চেয়ে রইল ও টিকলির দিকে। টিকলি আশাই করছিল এরকম কিছু একটা হতে পারে। এইরকম অভিজ্ঞতা এর আগেও ওর হয়েছে।
ফোনটা হাতে ধরে কয়েক সেকেন্ড পর অভিমন্যু বলল, “আদিত্যনাথ রায়বর্ধন, আই মিন দ্য আদিত্যনাথ, আপনার… মানে, সরি কিছু মনে করবেন না, কিন্তু…”
“আমার বাবা। আমি অনন্যা রায়বর্ধন।” অস্বস্তি সরিয়ে জোর করে একটু হাসি টেনে বলল টিকলি।
অভিমন্যু ভুত দেখার মত তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ, তারপর মাথাটা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো আরও খানিক এলোমেলো করে বলল, “আমি স্বপ্ন দেখছি না তো! না, মানে আপনাদের কথা তো শুধু নিউজ, পেপারেই দেখি, এভাবে চোখের সামনে, বিশ্বাস হচ্ছে না আসলে।”
হেসে ফেলল টিকলি। অভিমন্যু যখন কথাগুলো বলছিল ওর বুদ্ধিদীপ্ত হাসি আর উজ্জ্বল চোখে স্পষ্ট ধরা দিচ্ছিল শিশুসুলভ আচরণ। চোখ মুখে ছেলেমানুষির ছাপ। টিকলি মুখে হাসিটা টেনে তাকিয়েই ছিল অভিমন্যুর দিকে। মানুষটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল ততটাও নয় বোধ হয়। টিকলির ভাবনা থামিয়ে অভিমন্যে বলল আবার, “শুধু তো লঙ্কা আর কফি খেয়েই পেট ভরিয়েছেন, ক্যাশও তো নেই বললেন, আপনি চাইলে… না মানে আমার যা সামর্থ্য তাতে সামনের দোকানে রোল চাউমিনটা হবে, আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, আপনি বললে আমি খাওয়াতে পারি, ইনফ্যাক্ট আমার পরম সৌভাগ্য।” এই অব্দি বলে থামল অভিমন্যু।
টিকলি অভিমন্যুর হাত আর চোখ অনুসরণ করে তাকাল সামনেটায়, একটা ছোট্ট ফাস্ট ফুডের দোকান। এইরকম কোন দোকানে কখনোই যায়নি টিকলি বলাই বাহুল্য। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওর এখন আর ‘না’ টা বলতে ইচ্ছে হল না। দোকান থেকে ভেসে আসা খাবারের সুগন্ধে পেটে মোটামুটি ছুঁচো ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করে দিয়েছে। আর কখনো যখন খায়নি, একবার খেয়ে দেখলে ক্ষতি কি? ক্ষিদেয় তো আর থাকা যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে শুধু কফি খেয়ে আর লঙ্কা চিবিয়ে হাল আরও খারাপ। বেশী আর কিছু না ভেবে উল্টো দিকের দোকানটায় এগোল ওরা।
“চিকেন রোল বলি? হ্যাঁ, দাদা দুটো চিকেন রোল, বেশী করে লেবু লঙ্কা দিয়ে বেশ ঝাল ঝাল। আপনি ঝাল খান তো? ওহ সরি সরি, কাকে কি জিজ্ঞাসা করছি আমি।” হাসতে হাসতে টিকলির দিকে তাকাল অভিমন্যু। টিকলি এতক্ষণে খেয়াল করল অভিমন্যু হাসলে গালে একটা খাঁজ পরে, না টোল নয়, কোন কাটা দাগ, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কাটা দাগটা যেন সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ডান দিকের ভ্রু আর ডান গালের কাটা দাগটার জন্য বড্ড অন্যরকম সুন্দর লাগছে অভিমন্যুর হাসি মুখটা। টিকলি অভিমন্যুর চোখের দিকে তাকিয়েই বলল, “তা কি করা হয়? স্টুডেন্ট? না মানে, স্যারের সাথে এসেছিলেন বললেন।”
“হ্যাঁ, এম.এসসি ফাইনাল ইয়ার। ঐ আমাদের এইচ.ও.ডি আজ ট্রিট দিলেন তাই এখানে ঢোকার সৌভাগ্য হল আর কি।”
“থাকা হয় কোথায়?”
“থাকি বলতে পুরোপুরি নর্থ কলকাতায়। ঐ ধরুন সরু গলি, পুরোনোকালের বাড়ি, একদম ঐরকমই , আমাদের শরিকি বাড়ি, শোভাবাজারে। এটা এক্সট্রিম সাউথ ওটা এক্সট্রিম নর্থ।”
“দাদা, আপনারটা হয়ে গেছে।”
“ও হ্যাঁ, দিন।”
টাকাটা মিটিয়ে রোল দুটো নিয়ে একটা এগিয়ে দিল টিকলির দিকে। এর আগে কোনদিনই টিকলি এসব দোকান থেকে কিছু কিনে খায়নি, বাড়ির লোকের মতে চূড়ান্ত আনহাইজিনিক, আর সাবস্ট্যান্ডার্ড, কিন্তু এখন আর কিছু ভাবার মত অবস্থা নেই ওর। রোলটা নিয়ে কামড় বসাতে আর বেশি সময় নিল না ও।
“উমম, দারুণ খেতে তো! লাভলি।”
“চিকেন রোল, লেবু লঙ্কা সস, না ভাল হয়ে উপায় আছে? স্বর্গীয় অনুভূতি পুরো।”
“একদম, আমি এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছি জীবনে এই প্রথম, কিন্তু বেশ লাগছে কিন্তু।”
“বলেন কি? তবে সেটাই স্বাভাবিক। আমার নিজেরই কেমন একটা লাগছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে অনন্যা রায়বর্ধন, বাপরে! আচ্ছা আপনি কোন দিকে ইন্টারেস্টেড? ডিরেক্টর, মিউজিক কম্পোজার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, চাঁদের হাট তো একদম। আপনি কোন দিকে?
“আমি কোনদিকেই না এখনও। মিউজিক নিয়ে পড়ছি, তারপর দেখা যাক বাকীটা,ফ্রন্ট পেজে, পেপারে আসার মত এখনও কিছু করিই তো নি। যাই হোক, আপনার সাবজেক্ট কি?”
“ফিজিক্স। এই রোলটা কিন্তু বেশ ঝাল, আপনি তো ঝাল খান, আমি অতটাও পারি না, বেশ ঝাল লাগছে, এই দোকানটা হেব্বি বানায়। আমার তো ইউনিভার্সিটি এদিকেই, সেই সুবাদে সাউথে প্রায়ই আসা হয়।”
অভিমন্যু প্রচুর বকবক করতে পারে। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় ওর নাক মুখটা চকচক করছিল, ঝালের চোটে বেচারার নাক মুখ ঘেমে লাল। টিকলি তাকিয়েই ছিল অভিমন্যুর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই, নামিয়ে নিল মুখটা।
“আপনার গাড়ি কখন আসবে?”
ঘড়িটা দেখার জন্য হাতটা ঘোরাতেই সামনের দিকটা থেকে গাড়িটার হেডলাইটের আলো পড়ল চোখে।