“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?”
“সত্যি মিথ্যের অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছে ব্যাপারটা, তুমি জানো তুমি কি বলছ? আর আমায় বললে ব্যস! আর কাউকে ভুলেও বলতে যেও না। আরে তুমি কোন বাড়িতে বসে কথা গুলো বলছ খেয়াল আছে তোমার?”
“খুব ভালো ভাবে খেয়াল আছে আর আমি সবটা জেনেও যদি মুখ বন্ধ করে থাকি নিজের চোখে আর চোখ রাখতে পারবো না। তুমি কি করবে একান্তই তোমার ব্যাপার, কিন্তু আমি চুপ থাকতে পারবো না আদি, ব্যস!”
“তুমি পাগল হয়ে গেছ অমৃতা, তাই নিজেরই বাড়ির এগেইনস্টে কেস করবে বলছ, তাও যে কেসের কোন মাথা মুন্ডু নেই সেই নিয়ে তুমি রায় বর্ধনদের বিরুদ্ধে কেস ঠুকলে কি হবে ভাবতে পারছ?”
“হ্যাঁ পারছি ভাবতে, তোমার ভাই…”
“চুপ, প্লিজ চুপ করো অমৃতা, কোন প্রমাণ ছাড়া এভাবে দোষারোপ করা বন্ধ করো এবার, অশান্তি বাড়বে তাতে শুধু, বাবার কানে গেলে কি হবে জানো তুমি?”
“তোমার এটা বলতে লজ্জা করছে না আদি? তোমার ভাই যা করেছে তাতে এমনিতেও আর মুখ দেখানো যাবে না বাইরে, আমায় চুপ করিয়ে কি হবে?মেয়েটার যা সর্বনাশ হল তার খেসারত কে দেবে বলতে পারো? নাকি গরীব বলে যা খুশি করা যায়? টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে দেবে? তাহলে তো তোমাদের সবারই একই চরিত্র, গোছা গোছা টাকার নীচে মান, হুঁশ, মেরুদন্ড, সততা সবটুকু চাপা পড়ে গেছে। আর এই যে বাইরের জগতের কাছে একটা আদর্শ চরিত্র সাজিয়ে রাখো তোমরা, সেই মুখোশটা এবারে টেনে খুলে দেওয়ার খুব প্রয়োজন। নয়তো আরো কত মানুষের জীবন বরবাদ হবে।”
“শাট আপ অমৃতা, জাস্ট শাট আপ!”
দরজা খোলার আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়ল আদিত্যর।
“কিরে ঘুমোসনি এখনও?এত রাত্রে তো তোর ঘরে আলো জ্বলে না তাই দেখতে এলাম। ঠিক আছে তো সব?”
“এসো দাদা, বসো এখানে একটু।”
আদিত্য যে ভিতরে ভিতরে কতটা বিচলিত সেটা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হল না এই মানুষটার। ছোট্ট থেকেই সমস্ত ভাইয়ের মধ্যে এই ভাইটার সাথেই যে সম্পর্ক ছিল আত্মিক, শব্দ না থাকলেও যে সম্পর্কে একে অপরের মনের কথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি কোনদিন। ভাইয়ের চোখের দিকে তাকালো সূর্যনাথ। চোখের ইশারাতেই জিজ্ঞেস করল, “কিসের এত অস্থিরতা? এত কেন উচাটন?”
দাদার হাত দুটো ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আদিত্য, অনেকগুলো অব্যক্ত কথা যেন বলে যাচ্ছে এই নৈঃশব্দ, এই দীর্ঘশ্বাস।
“কিছু বুঝতে পারছি না আসলে দাদা, কিছুই তো পারলাম না জীবনে। না সংসারটা বাঁচাতে পারলাম, না মেয়েটার দায়িত্ব পালন করলাম। আজ মেয়েটা কবে এত বড় হয়ে গেল সেই ভাবতে বসে অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে আসলে। নিজের মেয়ের বিয়েতে তার মা থাকবে না? আর কত বঞ্চিত করব বলতো অমৃতা কে? আর কত অন্যায় কে প্রশ্রয় দেওয়া যায়? অনেক তো হল। কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না।”
এই ভাইটাকে চিরকাল ঠান্ডা মাথার, শান্ত, ধীর স্বভাবেরই জেনে এসেছেন, এত সহজে ধৈর্য্য হারায় না তো আদিত্য, না তো এত সহজে ওকে বিচলিত করা সম্ভব, সেই জন্যই আজ এত বড় বিজনেস দক্ষ হাতে একাই সামলেও চলেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ কি হল?
ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে সূর্যনাথ বললেন, “দেখ তুই তো কোনো অন্যায় করিসনি, তাহলে এভাবে নিজেকে দোষারোপ করছিস কেন? তুই তো চেষ্টা করিসনি তা নয় …”
“না দাদা অন্যায় যে করিনি এটা কি ভাবে বলবো? যে প্রতিবাদটা আমার দিক থেকে আসা উচিত ছিল সেটা কি আদৌ করেছিলাম? নাহ! এখন যে অমৃতার সামনে গিয়ে দাঁড়াব, মেয়ের বিয়ে সেটুকু নিয়েই আলোচনায় বসবো সেই মুখটুকুও আমার নেই। এত কিছুর পরেও ও তো ওর অধিকার নিয়ে কোনোদিন …”
দরজার বাইরের শব্দটায় কথা থামিয়ে তাকালো আদিত্যনাথ। চারিদিক চুপচাপ, রাত প্রায় একটা বাজছে, বাড়িতে তো সব ১০টার মধ্যে খেয়ে দেয়ে যে যার ঘরে। এতটুকু এদিকওদিক হওয়ার জো নেই, এখন তাহলে…
“বাপি আসব একটু?” ঘরের বাইরে থেকেই বলল টিকলি।
“কিরে কি ব্যাপার? এত রাত্রে? কি হয়েছে?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন সূর্যনাথ।
“কিছু না জ্যেঠু, আসলে বাপির ফোনটা নিয়েছিলাম একটু, ফেরত দেওয়া হয়নি আর। এই নাও বাপি।”
প্রতিবারের মতো এই বারেও আদিত্যনাথ চুপই ছিলেন, শুধু মেয়ের চোখ দুটো পড়তে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। সেই ছোট্টবেলাতেই যদি এই অদৃশ্য দূরত্বটা তৈরী না হতো তাহলে হয়তো বুঝতে পারতেন কি নিপুণ দক্ষতার সাথে টিকলি ওর চোখের কোণে উৎকণ্ঠাকে লুকিয়ে রেখেছে সযত্নে। ফোনটা টেবিল এ রেখে আর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে গেল টিকলি, বাবা জেঠুর কথোপকথন নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা হলেও শুনে ফেলেছে ও। আর তাই কাল সবার আগে মায়ের কাছে ওকে একবার যেতেই হবে।
*****
” ডান দিকে ঘুরতে হবে না রতনদা, সোজা চল।আগে মায়ের কাছে যাব, সেকেন্ড হাফে ইউনিভার্সিটি যাব।”
“ঠিক আছে দিদি।”
না আজ বাড়িতে জানিয়ে আসেনি টিকলি কিছু, বিন্তিপিসিকে কোনোক্রমে ফোনে পেয়ে শুধু জেনে নিয়েছে মা এখন কদিন ছুটি নিয়েছে, উইকনেসটা এখনও রয়েছে বলে।আজ মায়ের কাছে অনেক গুলো কথা ক্লিয়ার করা খুব দরকার। কি এমন হয়েছিল যে দাদু মাকে তারই মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে দিতে পারবে না।পুরোটা না জেনে ও তো কাউকে কিছু বলতেও পারবে না। ছোট থেকেই দেখে এসেছে মায়ের ব্যাপারে কোন কথা বললেই ঠাম্মা বড়মা ওকে কেমন চুপ করিয়ে দিতো দাদুর সামনে, কিছুতেই বুঝতে পারতো না ও কেন এরকম অস্বাভাবিক সম্পর্ক গুলো। সেই ছোট্ট বেলার দিনটা মনে আছে ওর, বুঝতে পারেনি তেমন কিছু কিন্তু দিনটা ভুলতে পারেনি ও। দিনটা ছিল শুক্রবার, কারণ ওর স্কুল থেকে ফিরে মা বাবার সাথে জ্যেঠুর সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল সেদিন। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো না হলেও সেদিনকেই মুক্তি পেয়েছিল জ্যেঠুর সাড়াজাগানো বিখ্যাত ছবি ‘খোয়াই’।
কিন্তু বাড়ি ফিরেই দেখেছিল অদ্ভুত এক পরিবেশ, কারো মুখে কোন শব্দ নেই, ওর হাসি খুশি মা একেবারে চুপচাপ, মাথায় একটা ব্যান্ডেজ, ও সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছিল কি হয়েছে কিন্তু কেউ কোন উত্তর দেয়নি সেদিন। তারপরেই নেমেছিল অঝোর ধারায় বৃষ্টিটা। খুব দুঃখ হয়েছিল ওর সেদিন, সব প্ল্যান ক্যানসেল হয়ে গেছিল বলে। আর তারপর থেকেই কি যেন একটা হয়ে গেলো, ওদের বহুদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার কানাইকাকা আর ওর মেয়ে রেণুদি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।তারপর মা ও হসপিটালে এডমিট ছিল বেশ কিছুদিন। কিছু জানতে চাইলে ঠাম্মি খালি বলতো এইবার চলে আসবে কিছু হয়নি। কিন্তু ফেরার পর মা কে আর চিনতে পারতো না ও। কেমন যেন হয়ে গেছিল ওর মা। তারপর আবার কি যে হল, সেজো কাকাই সেই যে বাড়ি ছেড়ে গেল আর কখনো এলো না। খালি দাদার বিয়েতে এসেছিলো একবার একদিনের জন্য, তারপরেই আবার চলেও গেছিল, মা হসপিটাল থেকেই ফিরে আর বেশিদিন থাকল না এই বাড়িতে। দাদু নিয়ে চলে গেছিল ওকে আর মা কে। তারপর ও এই ‘মঞ্জরী’ তে এলেও মা আসেনি। মাঝে মাঝে ও যখন ছোট ছিল আসতো মা, কিন্তু ও বুঝতো এটা ও সবাই ভালো ভাবে নেয় না। ও একটু বড় হতেই মা আর কখনো আসেনি এই বাড়িতে। ও বহুবার বহুজনকে জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর পায়নি। কিন্তু এবারে ওর জানাটা দরকার, ওর বিয়েতে ওর মা না থাকলে ও কিছুতেই করবে না বিয়ে, আর এটা এবারে ও দাদুকে বলবেই।
লম্বা শ্বাসটা নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো ও, তখনই ফোনে একসাথে অনেকগুলো নোটিফিকেশন ঢুকল। ফোনের স্ক্রিনটা অন করে নোটিফিকেশন গুলো চেক করতেই যেন ওর শরীরে রক্ত চলাচল বেড়ে গেল বহুগুণ। সারা শরীর জুড়ে উত্তেজনাটা ছড়িয়ে পড়ল যেন, বুকের ভিতর ধড়ফড়ানিটা বেড়ে গেছে ভীষণ ভাবে। এই মেয়েটাই…এই মেয়েটাকেই সেদিন ও দেখেছিল অভিমন্যুর সাথে। না ওর কোন ভুল হচ্ছে না, ওর সেইদিনই সন্দেহ হয়েছিল, আজ এই মেয়েটার এই অবস্থা! জাস্টিস চাইছে, প্রার্থনা করছে সবাই মেয়েটার জন্য! আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে খবরটা এখন সারা শহরে, ওই-ই দেখেনি। পুরোটা না জানা অবধি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না ও, একবার পিসেমশাই কে ফোনে করবে? পিসে এখন জার্নালিজম এর যে পজিশনে সব খবরই থাকবে। না থাক, বাড়িতে এই নিয়ে কিছু না বলাই ভালো, আবার খবর গুলো পড়তে লাগল টিকলি, ঘটনাটা কদিন আগেই ঘটেছে, খবরের প্রতিটা লাইন এ নৃশংসতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পড়ে শিউরে উঠছিল টিকলি। একি এখানে তো অভিমন্যুর নাম ও রয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে! মেয়েটার অবস্থা এখন স্থিতিশীল। ফোনটা বন্ধ করে হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে বসল কিছুক্ষণ টিকলি। খানিক পর বলে উঠল, “রতনদা সেদিন যেখানে জটলায় আটকেছিল গাড়িটা, আজ ওখানেই চলো।”
“মানে? এই যে বললে ম্যাডামের কাছে যাবে আগে। আর সে তো নর্থে।”
“হ্যাঁ নর্থেই চলো। আর দেরি করো না ঝটপট চলো। আর বাড়িতে কিছু বলার দরকার নেই। বুঝলে? চলো।”
গাড়ি অবশেষে ইউটার্ন নিয়ে এগোল অন্য গন্তব্যে।
*****
একটা চায়ের দোকানের কাছে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করল রতনদা। এই জায়গাতেই আগেরদিন জ্যামে আটকেছিল টিকলি। কিন্তু এখানে কোথায় খুঁজবে ও? ঠিকানাপত্র কিছুই তো জানে না। ফোনটা হাতে নিয়ে একবার কন্টাক্টটা খুললো ও। কাল মাকে ফোন করতে গিয়ে অভিমন্যুর নম্বরটা বাবার ফোন থেকে নিয়ে নিয়েছিল ও, একবার কি ফোন করবে? নাকি এখানে আশেপাশের দোকানে কাউকে জিজ্ঞাসা করবে? গাড়ি থেকে নামল ও, ফোনটা ব্যাগে ভরে সামনের চায়ের দোকানে দিকে এগোল ও। আচ্ছা ও কি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে? কি দরকার ছিল আসার?চেনে না জানে না, কি বোকা বোকা। ধ্যুর ফিরে যাবে ? নিজেরই এবার বোকা বোকা লাগছে। কোথাকার কে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, কয়েক ঘন্টার আলাপ আর কয়েকমুহূর্তের ঘটনার সাক্ষী, এবার মনে হচ্ছে ও বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। বেকার ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে মাঝখান থেকে, একেই এখন ঘটনাটা নিয়ে আগুন জ্বলছে, বাড়িতে যদি একবার কেউ জানতে পারে তাহলে আর রক্ষে নেই। কিন্তু মায়ের কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না ও, মায়ের চোখে যেন নিজেকে খুব ছোট লাগছিল সেদিন, মা ঐভাবে কেন বললো? এটা তো সত্যি যেখানে যা দরকার ও কি আদৌ বলতে পারে করতে পারে? না তো? তাহলে? কিন্তু ওর কি এখন ফিরেই যাওয়া উচিত হবে? আচ্ছা এই চায়ের দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে একবার দেখবে ঠিক কি ঘটেছে? এই এলাকারই লোক নিশ্চয়, তাছাড়া চায়ের দোকানিদের কাছে সবসময় সব খবর থাকে। কিন্তু এরা কিভাবে রিয়াক্ট করবে কে জানে, সেদিন যা অবস্থা ছিল এখানকার, ও আবার ফেঁসে না যায়। ধ্যুর বাড়িই চলে যাক। দোনামোনা করে কয়েক পা এগিয়েও আবার পিছিয়ে এলো টিকলি, ও ঐভাবে জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকায় বাকি লোকের অসুবিধাই হচ্ছে। ধীরে ধীরে সরেই এলো ও। পাশ থেকে এগিয়ে লোকজন চা বিসকুট কিনে খেতে ব্যস্ত, “এই একটু আদা চা দাও তো। মাথাটা হেভভি ধরেছে গো হেমন্তদা। দাও, আর হ্যাঁ কত হলো মাস শেষ হওয়ার আগেই বোলো, এই মাসেই দিয়ে দেব।” গলাটা কানে আসতেই মুখটা ফিরে তাকাতেই দেখল হালকা দাড়ি, এলোমেলো চুল, চোখের চশমাটা পাঞ্জাবির বুকে, আর একটা পেস্তা রঙের পাঞ্জাবিতে ওরই পাশে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে অভিমন্যু। যাকে খোঁজার জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছিলো ও, সে ওর পাশেই! ওকে বোধহয় এখনো খেয়াল করেনি, না হলে নিশ্চয় তাকাতো। হেমন্তদার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে ওর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের মতো করে ছড়িয়ে বসল অভিমন্যু। তাকিয়ে দেখছিল টিকলি, ভারী অদ্ভুত তো। আশেপাশে কে আছে কে ওকে দেখছে কোনো পাত্তাই নেই, নিজের জগতে নিজেই মত্ত! নিজের মতোই একটা সুর গুনগুন করছিল যেন। টিকলি আর কিছু না বলে চুপ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে, কিসের অপেক্ষা করছিলো কে জানে। ওর কপালের উপর পড়া এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করলো একবার, অগোছালোই রইলো, তাও কি যে করলো কে জানে, গলার কাছ থেকে চশমাটা বের করে পাঞ্জাবির কাপড় দিয়ে মুছে চোখে লাগলো প্রায় কিছু সেকেন্ড ধরে, পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন টা বের করতে গিয়ে এপাশে তাকাতেই টিকলি চোখে চোখ পড়ল অভিমন্যুর। টিকলি একভাবে তাকিয়েই ছিল, কখন যে নিজের অজান্তেই ওর ঠোঁটে হাসি ফুটেছে কে জানে। অভিমন্যু তাকাতেই না চাইতেও সেই হাসিটা আরো যেন একটু প্রকট হলো, কয়েক সেকেন্ডের জন্য যদিও, তারপরেই চোখ দুটো নামিয়ে নিল ও তৎক্ষণাৎ।
ও কি অপেক্ষাই করছিল কখন অভিমন্যু তাকাবে ওর দিকে? কে জানে, কি করতে ও এসেছিল আর এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও কি করছে তখন থেকে? ওর আজগুবি ভাবনার মাঝেই অভিমন্যু অবাক চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে সোজা ওর সামনে এসে বললো, “আমি ভুত দেখছি না তো? আপনি? মানে আপনি এভাবে এখানে চায়ের দোকানে? এদিকে কি মনে করে? সব ঠিক আছে তো আজ? ওটা তো আপনারই গাড়ি?” পরপর বেশ কটা প্রশ্ন করে থামল অভিমন্যু। ওর চোখ মুখে শিশুসুলভ ঔজ্জ্বল্য স্পষ্ট, সেদিনকার রুদ্রমূর্তির ছিটেফোঁটাও নেই আজ এই মানুষটার মধ্যে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এই সবকটা প্রশ্নের একটারও উত্তর দিতে পারল না টিকলি। সবকটা উত্তর যেন মুখের কাছে এসে উবে হচ্ছে বারবার, কিছু বলার চেষ্টা করেও পারছে না ও, কানের কাছে একটা অদ্ভুত সুর, কি অদ্ভুত অনুভূতি। এরকম কখনো হয়নি তো আগে, ও কি নার্ভাস? কিন্তু তা কেন? ও তো ওই মেয়েটার ব্যাপারে জেনেই… এরকম হচ্ছে কেন ওর? অনেক কিছু বলছে অভিমন্যু, মাথাটা ঝাকিয়ে, ওর চুলগুলো চশমার উপর দিয়ে যখন পড়ছে ওর চোখের উপর কপাল ঢেকে, কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে টিকলির মধ্যে! এই সময়টা, এই যা কিছু হচ্ছে, এই অভিমন্যু এইসব কিছু যেন আগে ঘটে গেছে, অনেক কাছের, অনেক চেনা যেন এই সবকিছু। ওর মুখের হাসিটা ওর চোখ অব্দি পৌঁছায়, মা বলে খুব কম জনেরই এটা হয়, বাকি বেশিরভাগ মানুষই তো মেকি হাসিতে অভ্যস্ত, ওর চোখ দুটো ওর এই হাসিতে বড় উজ্জ্বল। কিন্তু কিছুতেই কানের কাছে সুরটা থামছে না কেন টিকলির? এবার তো অভিমন্যু ওকে পাগল ভাববে! নিজেকে জোর করে সংযত করল টিকলি। এবার ওকে কিছু একটা বলতেই হবে।
“আমি সেদিন এখান দিয়ে যাওয়ার সময় আপনাকে আর শিউলি বলে মেয়েটিকে ঝামেলার সময়ে দেখেছিলাম আসলে, আজ নিউস এ সবটা পড়ে আর আপনার নামটা দেখে আর না এসে থাকতে পারলাম না। এরকম কিছু যে টিকলি বলবে বিন্দুমাত্র যে আশা করেনি অভিমন্যু সেটা ওর মুখের ভাবভঙ্গিতেই স্পষ্ট। ওর মুখে বিস্ময়ের সাথে সাথে যেন এক ঝিলিক হাসি খেলে গেল, টিকলির চোখে সোজাসুজি তাকিয়ে বললো, “হেমন্তদার দোকানের চা আর বিসকুট চলবে?”
“মানে?”
“কিছু না, এক মিনিট। “
টিকলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুইহাতে চা আর বিসকুটটা কোনোক্রমে নিয়ে আবার ফিরে এল অভিমন্যু। “আপাতত পকেটে কিছুই নেই তাই সাত সকালে চা বিসকুট ছাড়া কিছুই খাওয়াতে পারছি না ম্যাডাম, নিন নিন তাড়াতাড়ি চা টা ধরুন, উফফ কি গরম!”
“ওহ সরি সরি, হ্যাঁ হ্যাঁ দিন। “অভিমন্যুর হাত থেকে তাড়াতাড়ি চায়ের ভাঁড়টা নিতে নিতেই অভিমন্যু বলল, “হাঁটতে পারবেন আগের দিনের মতো? সামনেই গঙ্গা আছে।” এটুকু বলেই তাকাল ও টিকলির দিকে।
ভাবার যেন কিছুই ছিল না, টিকলির শুধু সম্মতির দৃষ্টিতে তাকানোই বাকি ছিল। রতনদাকে ইশারা করে চা খেতে খেতে সোজাসুজি হাঁটতে লাগল টিকলি আর অভিমন্যু।
“আসলে সব জায়গায় সব তো বলা যায় না, গঙ্গার ঘাটে সেই প্রব্লেমটা নেই। আর রোদটা মাঝে মাঝেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে দেখুন। খুব একটা অসুবিধা হবে না আপনার।”
“আমার অসুবিধে হবে এরকম কেন মনে হলো আপনার? আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই, ইনফ্যাক্ট কখনো এভাবে গঙ্গার ধারে বসা হয়নি তাই অফারটা লুফে নিলাম।”
“বলেন কি? গঙ্গার ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখেননি? এই আপনাদের সেলেব্রিটিদের কিন্তু হাজারটা পাওয়ার মধ্যে লাখখানেক না পাওয়া থাকে। মানুন আর নাই মানুন।” আপনাকে রীতিমতো মানুষ করে ফেলতাম, যদি আমার বন্ধু হতেন। সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন।”
“এখনো করতেই পারেন, আমার মা তাহলে খুব খুশি হবেন অন্তত।”
“মানে?”
“আপনার কথা গুলো আমার মায়ের মতোই, মা ও এইরকমটাই বলে, আচ্ছা আমরা কি তাহলে পৌঁছে গেছি?”
অভিমন্যু টিকলির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতেই হাঁটছিল, টিকলির কথায় সামনের দিকে তাকাল ও।
“ইয়েস ম্যাডাম, একদম, আমরা পৌঁছে গেছি। আসুন এদিক দিয়ে।”
“এই শুনুন,আমাকে না আপনি ম্যাডাম বলবেন না, না তো আমি কোনো সেলিব্রিটি, প্লিজ।”
“কিন্তু আমাদের কাছে তো আপনিও একইরকম সেলিব্রিটি, আমাদের দেশের এটাই নিয়ম ম্যাডাম,আমার তো কিছু করার নেই।এখানটায় বসতে পারেন, পরিষ্কার আছে। “
চায়ের ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে বসল ওরা দুজন। এভাবে কখনো গঙ্গার পারে বসতে পারবে স্বপ্নেও আশা করেনি টিকলি, মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনের দিকেই তাকিয়ে ছিল ও, একদম চুপচাপ, কখনো কখনো এই নিস্তব্ধতাটাই বড্ড ভালো লাগে, এটাই যেন খুব জরুরি, আজ হয়তো জোয়ার, আকাশ ও মেঘলা, রোদ প্রায়ই লুকোচ্ছে মেঘের আড়ালে, বেশ হাওয়া দিচ্ছে। চোখ দুটো বুজে এই মুহূর্তটাকে আষ্টেপৃষ্টে উপভোগ করছিলো টিকলি। আশ্চর্যজনক ভাবে ওর এতটুকু অস্বস্তি হচ্ছিল না আর, ইনফ্যাক্ট বেশ শান্তিতেই নিশ্চিন্তে বসেছিল ও অভিমন্যুর পাশে। যেন ওর মনের সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত বুক ধড়ফড়ানি ধীরে ধীরে হাওয়া, অজানা কারণেই মনটা আগের থেকে অনেক অনেক শান্ত।
“আপনি শিউলির খবরটা পড়ে যে আসবেন, বিশ্বাস করুন আমি দূর দুরান্তেও এটা ভাবিনি। সেদিন যখন আপনি দেখেছিলেন তার কিছু আগেই ঘটনাটা ঘটে,আমি যদি না পৌঁছতাম তাহলে কি হতো জানি না। এখনো চোখে ভাসছে,উফফ!”
অভিমন্যুর কথায় চোখ খুললো টিকলি, তাকাল ফিরে ওর দিকে।
বেশির ভাগ জিনিসই ওর কাছে এখন ধোঁয়াশা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে টিকলি বললো, “শিউলি আপনার ঠিক কে হয়? মানে… “
“কেন কিছু করতে গেলে কি কোন সম্পর্ক থাকা খুব জরুরি , মনুষ্যত্বটা শুধু থাকলে হবে না? না সে নিরিখে দেখতে গেলে শিউলির সাথে আমার দূর দুরান্তেও কোনো সম্পর্ক নেই। ওর ঠাম্মার আমল থেকে ওরা আমাদের বাড়ির হাউস হেল্প। ওর ঠাকুমা তারপর ওর মা , সেই সুবাদে ও প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে, এই হলো সম্পর্ক। ওকে অনেক পড়িয়েওছি , স্কুলে ওকে ভর্তি করার সময় যখন যেমন দরকার পড়েছিল আমি দিদি মা সবসময়ই…যাক গে ,ওদের মধ্যে যা হয় ,একটু বড় হতে না হতেই কাজে ও লাগিয়ে দেয়। আমার খুব ভালো লাগতো একটা জিনিস , ও ওর কাজের জন্য পড়াশোনাটাকে স্যাক্রিফাইস করেনি , পরিবারের জন্য টাকা রোজগার করতে গিয়েও নিজের স্বপ্ন কে বিসর্জন দেয়নি। উল্টে সবদিন বইপত্র যা লেগেছে চেয়ে নিয়ে গেছে। সেইদিন ও আমার ওদিকে যাওয়ার কথা ছিল না , টিউশন পড়িয়ে ভাবলাম বইটা একেবারে ফেরার পথে ওকে দিয়েই যাই , আমায় খালপাড় দিয়েই ফিরতে হয় , শর্টকাট হয়। ভাগ্যিস সেদিন পৌঁছেছিলাম!”
-“তারপর?”
“তারপর? ওর নিজেরই কাকার কাছে ও নিজের সম্মানটা হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে, ঘরে আর কেউ না থাকার সুযোগে, জীবনটা খোয়ানোর আগেই ওকে ওখান থেকে উদ্ধার করি। ওর কাকার সাথে পেরে উঠতে বেগ পেতে হয়নি খুব একটা, মাতাল অবস্থায় ছিল খানিকটা। কিন্তু শিউলিকে ওখানে কি ভাবে ফেলে আসতাম? লোকচক্ষুর ভয়, মানুষের কথার ধার কোনোদিনই ধারি না। আমার তখন এটাই মনে হয়েছিল শিউলিকে যেভাবে হোক আমায় বাঁচাতে হবে। কিভাবে কি হবে তখন ভাবার মতো সময় ছিল না আমার, ওকে আমাদের পাড়ায় নিয়ে চলে আসি কোনোক্রমে, ও মানসিক ও শারীরিক ভাবে কতটা বিধ্বস্ত এটুকু অনুভব করতে পারছিলাম একটা ছেলে হয়েও, এরপরও কিন্তু ও গুঁড়িয়ে যায়নি এতটুকু। বার বার বলছিল দাদা আমায় এখান থেকে নিয়ে চল, নয়তো আমায় মেরে ফেলবে। এরপর আর কারো কথা ভাবার বা শোনার প্রয়োজন বোধ করিনি।
তারপর অবশ্য অনেক কিছু শুনতে হয়েছে, শোনাতে ও হয়েছে, ওকে নিয়ে পাড়ায় ঢুকতে গিয়ে অনেক কাঠখড় ও পোড়াতে হয়েছে, ওকে একা নিয়ে গিয়ে হসপিটালে ভর্তি করতে গিয়ে ও কাউকে পাশে পাইনি গুটিকয়েক বন্ধু ছাড়া, আপনি যখন দেখেছেন তখন সম্ভবত পাড়ার লোকের সাথে ওই ওর পাড়ায় ঢোকা নিয়ে ঝামেলাটাই চলছিল, এই ভাবে গিরগিটির মতো মানুষের রং বদল দেখে সেদিন কিছুতেই আর নিজেকে ঠিক শান্ত রাখতে পারিনি। আর এই কদিনে এইটুকু বুঝলাম সব জায়গায় এই শান্ত হয়ে থাকাটাও খুব ভুল, লোকে এটা আপনার দুর্বলতা ভেবে নেয়। কখনো কারো সাথে এভাবে ঝামেলায় জড়িয়েছি বলে মনে পড়ে না, সবার সাথেই সদ্ভাব ছিল, কিন্তু সেদিনকার পর থেকেই গল্পটা বদলে গেল, এখনো অব্দি মাথায় ঢুকল না শিউলির দোষটা কোথায়, কিংবা আমি ভুলটা কোথায় করলাম। বিচিত্র এই সমাজ! বুঝলেন ম্যাডাম?
টিকলি চুপচাপ বসে শুনছিল কথাগুলো, কোথাও যেন এইসবের মাঝে নিজের মুখটাও ভেসে উঠছিল ওর চোখে। সেদিন তো ও নিজেও অজানা অচেনা একজনের জন্য বেকার ঝামেলায় জড়িয়ে কি লাভ ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে গেছিল, তাহলে ওই বা আলাদা কিসে?মা যদি সেদিন ঐভাবে রিএক্ট না করতো, তাহলে ও ও তো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতো, আজ ও বুঝতে পারছে সেদিন মা কেন এত কষ্ট পেয়েছিল। এতটা স্বার্থপর ও কবে থেকে হয়ে গেল কে জানে।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল টিকলি, “শিউলি তো আপনার কেউ হয় না, তাও ওর জন্য আপনি করছেন, সেদিন ওর জন্যই আপনি প্রতিবাদ করছিলেন, কজন করে এটা? বড্ড ভালো লাগলো জেনে, আমার মা বলেন, মনুষ্যত্ব এখনো হারিয়ে যায়নি। আপনিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।”
“সেরকম কোনো ব্যাপার না, আর আপনিও তো খবরটা পড়ে ছুটে এলেন, কজন আসে? আপনি ও তো একজন অপরিচিত মানুষই, আর আপনারা আমাদের মতন তো নন, সে আপনি মানুন আর নাই মানুন, শিউলি কে গিয়ে বলব, ওর ও ভালো লাগবে, আপনি যেতে পারবেন কিনা জানি না তাই আর হসপিটালে দেখা করতে যেতে বলে বিড়ম্বনায় ফেলবো না। আর আপনার মায়ের সাথে আলাপ করার ইচ্ছে রইল, কোনোদিন সম্ভব হলে প্লিজ দেখা করবেন।” ফোনটা বাজছিল টিকলির, কিন্তু ও অভিমন্যুর কথায় এতটাই বিভোর অভিমন্যু নিজে থেকে ডেকে না দেয়া অবধি আর টনক নড়েনি ওর, ফোনটা বাজছে, রতনদাই ফোন করছে, সময়ের কাঁটা ঝুপ করে পেরিয়ে গেছে অনেকটাই, তাই যাওয়ার সময় উপস্থিত, মেঘ কেটে আবার সূয্যিমামা রোদ ছড়াচ্ছে আপন খেয়ালে, কিন্তু মন বলছে এত দ্রুত পেরিয়ে গেল সময়টা? আরেকটু থাকলে ক্ষতি কি?
“চলুন আজ ওঠা যাক, আমায় আবার একটা টিউশন পড়িয়ে ইউনিভার্সিটি যেতে হবে, আপনাকে এই সাত সকালে চা বিসকুট ছাড়া তো কিছু খাওয়াতেও পারলাম না, আমার মা জানতে পারলে খুব ঝাড় খাব আপনাকে বাড়ি না নিয়ে আসার জন্য, একদিন প্লিজ আসুন না, খুব ভালো লাগবে, অবশ্য আপনি যদি কম্ফোর্টেবল হন তবেই… “
কথা বলতে বলতেই গঙ্গার পার থেকে উঠে পড়লো দুজন, অভিমন্যুর কথা শেষ হওয়ার আগেই টিকলি বললো, “কাল কি একবার দেখা করা যাবে? মানে যদি ফাঁকা থাকেন আর কি?” কিছু না ভেবেই ফস করে কথাটা বলে তাকাল অভিমন্যুর দিকে, অস্বস্তিটা আর হচ্ছে না, বরং চারপাশটা যেন বেশ শান্ত ওর, কোনো টেনশন, রেস্টলেস ভাব, নার্ভাসনেস কিছু নেই আর, অভিমন্যুর কথায় কি জাদু আছে? ওর কথা গুলো শুনলে, ওর সাথে থাকলে মনটা নিজের অজান্তেই খুব ভালো হয়ে যায়, মনটা যেন আগের থেকে অনেক বেশি শান্তি খুঁজে পায়, কেন এমন হচ্ছে কে জানে? কই এর আগে আর হয়নি তো কখনো। অভিমন্যু ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হেসে তাকালো টিকলির দিকে, “একদম ম্যাডাম।”
“কাল তাহলে শিউলির সাথে যাব দেখা করতে, আর আমার তরফ থেকে আপনার একটা ট্রিট পাওনা রইল, সেটা কালই দেব কিন্তু।”
“বেশ, যথা আজ্ঞা।”
“যাই তাহলে?”
“যাই নয়,বলুন আসি।”
“আসছি।”
নিজের গাড়িতে উঠে পড়ল টিকলি, অভিমন্যু দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ওর চলে যাওয়াটা দেখছিলো, ঠিক আগের দিনের মতো।”
*****
প্রায় ৫ – ৭ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে বেলটা বাজিয়ে টিকলি, কি কাজ করে বিন্তি পিসি কে জানে। একে তো মা ফোন টা ধরে না, তার মধ্যে এইরকম করলে টেনশনটা তো হয় নাকি। আরেকবার বেলটা বাজাতে যেতেই দরজাটা খুলল বিন্তি পিসি।
“এতক্ষন লাগে দরজা খুলতে? কি করো বলতো? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। মা কোথায়?”
“সে তো শুয়ে আছে, ওই জন্যই তো আমার উপর থেকে নামতে দেরি হলো, উপরেই তো ছিলাম।”
“সেকি! মার আবার কি হলো? আমায় বলোনি কেন? আমি যাওয়া অব্দি ফোন করে গেছি আমার তখনি সন্দেহ হচ্ছিলো। ধ্যুত!” ব্যাগটা দরজার কাছে নামিয়েই সোজা উপরে ছুটল টিকলি, মায়ের দরজার সামনে গিয়ে মুখ চোখ লাল করে দাঁড়ালো গিয়ে।
যতটা বকাবকি করবে ভেবে এসেছিল তার বিন্দুমাত্র ও পারল না
মাকে ওই ভাবে পড়ে থাকতে দেখে। মায়ের মুখ চোখটাও বেশ শুকনো, চোখ ফেটে জল আসছিল টিকলির। এখনো বোধহয় বুঝতে পারেনি যে টিকলি এসেছে। বিন্তিপিসি পিছন থেকে এসে বললো, “প্রেসারটা আবার মারাত্মক বেড়েছে, এই তো কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার এসে দেখে গেলো, মাথাই তুলতে পারছে না।”
“আর আমায় একবার জানালেও না?”
“দিদিই বারণ করেছিল, মাথা ঘুরে পড়েও গেছিল কদিন আগে, আমি তখনই জানাতে গেছিলাম,আমায় ফোন করতেও দিলো না, তুমি ফোন করলে ও বলতে বারণ করল, আর আমি ছাই মোবাইল ফোন ধরতে পারি নাকি। তুমি করছিলে আমি ধরতেও পারছিলাম না, আর দিদি তো উঠতেই পারছে না। তুমি চিন্তা করবে বলেই দিদি বলতে যায়নি, এখন একেই তোমার বিয়ের কথা চলছে, তার মধ্যে আবার…তাই আর বলতে যায়নি। তুমি রাগ করো না কেমন? যাও মার কাছে গিয়ে বসো।”
বিন্তিপিসি চলে যেতে গুটি গুটি পায়ে মায়ের ঘরে ঢুকে বসল টিকলি। চোখ দুটো বুজে সবে একটু ঘুমিয়েছে মনে হয়, টিকলি গিয়ে বসল মায়ের পায়ের কাছে। মাকে এভাবে শুয়ে থাকতে খুব কমই দেখেছে টিকলি। কিছুতেই মাকে এভাবে ফেলে যাবে না ও, ওবাড়িতে যা বলে বলুক। আচ্ছা মা কে কি বলবে ও গেছিলো অভিমন্যুর সাথে দেখা করতে? মা নিশ্চয় খুশি হবে, একটু হলেও ও মা এর মতো করে ভাবতে পারছে, নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্যের জন্য ভেবে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে, ওই রায়বর্ধন পদবীটা এখানে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এবার। ছোট্ট থেকেই টিকলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের মতন করে সেজেগুজে কথা বলতে চেষ্টা করত, আর ভাবত বড় হলে ঠিক মত করেই হাঁটবে চলবে কথা বলবে, একদম মায়ের মতনই হবে। আজ কি একটু হলেও মায়ের মতন করে ভেবে কাজ করতে পেরেছে ও? কে জানে।
“এ কি রে! তুই কখন এলি? হঠাৎ কি হলো? সব ঠিক আছে তো? কি হয়েছে?মুখ চোখ এরকম কেন? কি রে?” একনাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে কোনোক্রমে উঠে বসলেন অমৃতা। মায়ের চোখের দিকে রাগ আর অভিমান ভরা চোখে তাকিয়েছিল টিকলি। তখনি বাজল ফোন টা। ঠাম্মির ফোন। রোজ এসময়টায় ইউনিভার্সিটিতে ফোন করে ঠাম্মি টিফিন টাইম এ। উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো ও, “হ্যাঁ ঠাম্মি বলো।”
“–“
“না আমি আজ ইউনিভার্সিটি আসিনি, মায়ের কাছে এসেছি, আর আমি এখন বাড়ি ফিরবো না ঠাম্মি, মা পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি এখানেই থাকবো, মাকে এই অবস্থায় একা ফেলে আমি যেতে পারবো না, তুমি দাদুকে জানিয়ে দিও।” ফোনটা রেখে অবশেষে একটা লম্বা শ্বাস নিল টিকলি।