“আরেকটু ভাত নিবি অভি? এতটুকু খাচ্ছিস কেন? আজ তো খারাপ কিছু হয়নি যে তোর খেতে সমস্যা। উচ্ছে ও হয়নি পটল ও হয়নি। তাও মুখে রুচছে না ?”
“আরে তার জন্য না, তাড়া আছে, এখন তাড়াহুড়ো করে মাছটা শান্তিতে খাওয়াও হবে না, কাঁটা বাছতে গিয়ে সময়ও লাগবে, তার চেয়ে মাছটা বরং তুলে রাখো রাত্রে শান্তি করে খাবো। তুমি তার চেয়ে আরো কটা মাছের ডিমের বড়া দাও দেখি।” অমলেটের শেষ অংশটা মুখে পুরতে পুরতে মাকে বলল অভিমন্যু।
“কিসের যে এত তাড়া বুঝি না বাপু। কি শুরু করলি তুই বলতো? এই তো আজকেই তোর বাবা বাজার করে ফিরছিল। চ্যাটার্জী বাড়ির জামাইদা ধরেছিল বাবাকে। তুই যা কিছু করেছিস বা করছিস সে নিয়ে সত্যি আমি বা তোর বাবা গর্বিত, সে নিয়ে বলছি না। কিন্তু এবার একটু কম জড়ালি না হয়। তুই যতই চেষ্টা কর আমাদের এই সমাজ এখনো সেই তিমিরেই রয়েছে, আঙ্গুলটা তোর আর শিউলির দিকেই উঠবে। “
“সবাই এরকম ভাবলে তো আর এই পৃথিবীটা বসবাসযোগ্যই থাকবে না মা। আর কালপ্রিট তো এখন পুলিশ কাস্টডিতে, এটুকু তো অন্তত ভালো খবর। আর শিউলিও সুস্থ হচ্ছে। তাহলে? এখন মাঝপথে ছেড়ে দেব ওদের?”
“আর আমাদের কথাটা একবার ভাববি না তুই। লোকজন তো আমাদেরকেই কথা শোনাচ্ছে। “
“ওরকম লোকজনকে ইগনোর করাই ভালো মা। শান্তি পাবে। “
খাওয়া সেরে উঠে পড়ল অভিমন্যু। আর বসলে এবার বেরোতে দেরি হয়ে যাবে হাসপাতালে পৌঁছাতে। ওদিকে অনন্যাও তো অপেক্ষা করবে। বেশি দেরি না করে নিজের ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবিটা চাপাল ও। চুলটা আঁচড়াতে গিয়ে আয়নার সামনে চিরুনিটা নেওয়ার সময়ই থমকাল এক মুহূর্ত। এক টুকরো আকাশ এর মতন একটা আকাশি নীল রঙা রুমাল ফেলে গেছিল কাল অনন্যা, আজ ফেরত দিয়ে দিতে হবে। রুমালটা হাতের মুঠোয় নিয়ে একটু কাছ থেকে দেখল অভিমন্যু।একটা মিষ্টি গন্ধ এল নাকে, বেশ মন কেমন করা যেন গন্ধটা। খুব আপন কারো যেন। নাকের কাছে রুমালটা নিয়ে গভীর একটা শ্বাস নিল ও। মাথাটা কেমন যেন ঝিম হয়ে গেল। চারপাশটা যেন থমকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য, এই ভাবে থমকেই থাকতে ইচ্ছে করছে যেন, আয়নার সামনে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড অভিমন্যু। মা আসতেই নিজেকে সামলে নিয়ে রুমালটা পকেট এ ঢুকিয়ে নিলো ও।
*****
“তুমি এত অশান্তি করতে যেও না আমি বার বার বারণ করছি, এতে কারোরই ভালো হবে না কিন্তু, আর তোমার শরীর টাও কি খুব ভালো আছে?” আলোকনাথ এর হাতটা ধরে পায়ের কাছে বসে পড়লেন পরমাদেবী। এতটা অসহায় এর আগে একবারই লেগেছিল, যখন ঘরের লক্ষী ঘর ছেড়ে চলে গেছিল, আর উনি চেয়েও কিছু করতে পারেননি, মা হিসেবে দায় নেবেন নাকি মানুষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, চরম ধর্ম সংকটে সেদিনও কিছু করতে পারেননি, আজ এতবছর পর আবারও সেই একই অন্যায় চোখের সামনে দেখেও কাকে ছাড়বেন কাকে রাখবেন উনি?
“এত বার বারণ করা সত্ত্বেও কেন বারবার করে ওই বাড়ি যেতে হয় এখন টিকলি কে? কই আগে তো এরকমটা ছিল না, তুমি সায় না দিলে কিভাবে যেতে পারলো ও কাউকে কিছু না জানিয়ে? তুমি সব জেনেও কি করে এলাও করছ ওকে বিয়ের আগে? তুমি চেনো তো অমৃতা কে। আর তোমার সেজ ছেলেটা তো তারপর থেকেই আর…যাক গে, তোমায় বলা বেকার। আদিত্য বাড়ি ফিরলে আমায় জানাবে একবার। আমায় আগে ওর সাথে কথা বলতে হবে।”
আর কথা না বাড়িয়ে নিজের খাতাপত্রগুলো নিয়ে বসলেন আলোকনাথ, আর কিছু বলার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিল না পরমাদেবীর, যেদিন বলা প্রয়োজন ছিল সেদিন যখন বলতে পারেননি তখন আর আজ বলে কি হবে। কিন্তু নাতনিটা যে বড় আদরের, ও তো এত কিছুই জানে না জটিলতা, ও যদি এবার কোনোদিন প্রশ্ন করে সামনে এসে, কি উত্তর দেবেন উনি? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের গোপালের সিংহাসনের দিকে তাকালেন একবার। কপালে হাত ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
*****
শিউলিকে দেখে হাসপাতাল থেকে যখন ওরা বেরোল তখন প্রায় ভরদুপুর, সেই সকালের ঝোলভাত পেটের কোন কোণে কোথায় হারিয়েছে আর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার উপর সামনের বাঁকটা ঘুরেই একটা ছিমছাম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন, মোমোর গন্ধে চারপাশটা তো ম ম করছেই, সঙ্গে ওদের খিদে যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে সুঘ্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অভিমন্যু ওখানেই, আর যে এখান থেকে নড়তে মন আর পেট কোনোটাই সায় দিচ্ছে না! একবার টিকলির দিকে তাকাল শুধু, নাহ চোখে মুখে সেরকম আপত্তি তো দেখা যাচ্ছে না ম্যাডামের।
“কি হলো আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে গন্ধে পেট ভরাবেন? চলুন চলুন। আর বেকার দেরি করে লাভ নেই, গিয়ে ঝটপট অর্ডার টা দি। ” বলেই অভিমন্যুর দিকে আর না তাকিয়ে সোজা কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল টিকলি। অভিমন্যু খুশির সাথে সাথে বেশ অবাক ও হলো। আজ যেন অনন্যা ঠিক পাশের বাড়ির মেয়েটা, আলাদা কোনো ঠাট বাট নেই তার, নিতান্তই সাধারণ, ওর মতোই, মাত্র দিন কয়েকে এতটা পরিবর্তন? নাকি এটাই আসল অনন্যা? ওর বুঝতে ভুল হয়েছিল? নাকি এখনো চেনা হয়েই ওঠেনি? সেটাই হবে, মানুষ চেনা কি এতই সোজা?
“আরে আসুন!” টিকলির ডাকে সম্বিৎ ফিরল অভিমন্যুর, হেসে এগোল টেবিলের দিকে।
*****
সচরাচর এই সব ঝাড়পোছের ধারে কাছেও যায় না অমৃতা। আজ বিন্তিদির মাথায় ঢুকেছে এই বিশালাকার আলমারি পরিষ্কার করেই ছাড়বে,অগত্যা। একটা চেয়ার নিয়ে বসে কোনটা রাখা হবে আর কোনটা ফেলা হবে বলে কয়ে দিচ্ছিল ও, বিন্তিদি সেই মতো রাখছিল জিনিসগুলো গুছিয়ে। পরিষ্কার করতে করতেই কলেজ জীবনের বহু পুরোনো কাগজপত্র বেরোল একটা তাক থেকে। কবে থেকে পড়েছিল কে জানে। ফেলে দেওয়ার জিনিসই বটে, কিন্তু তাও হাত দুটো বাড়িয়ে একবার খুলে দেখল কাগজ গুলো। ওর ইউনিভার্সিটির কাগজপত্র, আইডেন্টিটি কার্ড, ওর পাসপোর্ট সাইজের সাদা কালো ছবিটা, পুরোনো খাতাপত্র বা কটা প্রশ্নপত্রের মাঝে ওদের পিকনিকের ছবিগুলো, ইস! এগুলো এখানে ছিল? উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো ছবিগুলো। সেই দিনগুলোই ভালো ছিল সবচেয়ে, এত জটিলতা ছিল না, শুধু প্রাণখোলা হাসি, আনন্দ, রাগারাগি, ঝগড়ার পর আবার সব মিটমাট, একসাথে কত ঘোরাঘুরি, পড়াশোনা, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, উফফ! চোখ দুটো বুজে নিজের ফেলে আসা সাদা কালো জীবনটায় যেন এক লহমায় পৌঁছে গেল অমৃতা। এই চিকনের সালোয়ারটাই মিতামাসি এনে দিয়েছিল লখনৌ থেকে, আর এই তসরের সালোয়ারটা সমস্ত বিয়েবাড়িতে পরে ফেলতো ও, সেজদিদু নিয়ে এসেছিল রাঁচি থেকে। ভীষণ প্রিয় ছিল এটা। এই পোশাকটা পরেই প্রথম আদিত্যর সাথেও ওর আলাপ। আর্ট গ্যালারি তে ওর ছবির প্রদর্শনীতে প্রথম যেদিন বাবার সাথে আদিত্য এসেছিল সেদিন ও তো এই পোশাকটাই পরনে ছিল ওর। সেই শুরু মনে হয় ওর জীবনে গ্রহণের, তারপর থেকেই…চোখ দুটো খুলে ফেলল অমৃতা। না ও আর ভাবতে চায় না এগুলো, বড্ড বিষাক্ত এর পরের স্মৃতি গুলো। তার থেকে বরং বন্ধই পড়ে থাক কোনো অন্ধকার কোণে।
“কি গো আবার শরীর খারাপ করছে নাকি? প্রেসারটা আবার বাড়ল? চোখ দুটো লাল কেন এরকম? কি হলো?”
“কিছু না বিন্তিদি, তুমি দেখে শুনে নাও একটু, আমি ওঘরে গেলাম, দরকার হলে ডাকবে। ” চোখটা মুছে চেয়ার ছেড়ে উঠে তড়িঘড়ি নিজের ঘরে চলে গেল অমৃতা। একবার খোলা দরজাটার দিকে হতভম্বের মতন তাকিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা কাগজগুলোর মাঝে সেই পুরোনো লাল সোনালী বিয়ের কার্ডটা দেখল বিন্তি। জিভটা কেটে তাড়াতাড়ি আলমারির ভিতরে কার্ডটা সরিয়ে দিলো ও।
।। ২।।
আর যে চলতে পারছি না, উফফ যা সাংঘাতিক খাওয়ালেন, ফ্রিতে আর খিদের চোটে রাক্ষসের মতন খেয়ে এখন তো যাচ্ছেতাই অবস্থা আমার! হাঁটতে পারলে হয় এখন, এই একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবেন? প্লিজ, ওই তো সামনের দোকানে আছে। খাবেন?”
“আমি খাবো না বললে কি আপনি খাবেন না?”
“না তা নয়, ওই আর কি মানে… “
“থাক, আর অত মানে মানে করতে হবে না, আমার জন্য একটা কোক আনবেন। আপনার মতো আমার অবস্থা ও হাঁসফাঁস। “
অভিমন্যু আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল সামনের দোকানটায়, ফুটপাথটার ধারে সরে এসে দাঁড়ালো টিকলি। ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবল, রতন দা কে আসতে বারণ করে দিলে কেমন হয়? বেশ লাগছে আসলে, এরকম অনুভুতি এর আগে কখনো হয়নি, সবসময়ই যেন খাঁচায় বন্দি পাখি, আজ যেন খোলা হাওয়ায় ভাসতে চাইছে মন টা। কেউ ডাকার নেই, কেউ কিছু বলার নেই, বকার নেই, আজ নিজের মর্জির মালিক ও, আগে একটু হাঁটতেই গায়ে জ্বর আসত, এখন মনে হচ্ছে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যাবে যদি সঙ্গে থাকে…”
“এই যে ম্যাডাম, আপনার কোক, নিন নিন ধরুন। “
অভিমন্যুর ধাক্কায় টনক নড়ল ওর, হেসে বোতলটা নিয়ে নিল অভিমন্যুর হাত থেকে, আঙুলে আঙুলে ছোঁয়া লাগল মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, না কোন অস্থিরতা হলো না টিকলির মধ্যে, কোন টেনশন ধড়ফড়ানি কিছু না, বরং ভীষণ শান্ত হয়ে গেল যেন ওর চারপাশটা আবার, গুমোট ভাবটা কেটে একটা মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া যেন ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর সমস্ত মনটা।
“আচ্ছা আপনি কি সবসময়েই এরকম অন্যমনস্ক থাকেন?”
“কেন বলুনতো?”
“না যখনই আপনাকে দেখি তখনই কিছু না কিছু একটা ভেবেই চলেছেন, কি এত ভাবেন সবসময়?”
টিকলি যে একটু নিজের ভাবনাতেই থাকে বেশিরভাগ সময় এটা একদমই মিথ্যে নয়, বরং এটাই সত্যি। ছোট্ট থেকেই নিজের জগতে নিজের মতন করে হারিয়ে থাকতেই ভালোবাসত ও, না থেকেই বা উপায় কি ছিল? এখনো সেই অভ্যাস অব্যাহত, তবে এভাবে কেউ কখনো বলেনি বা জিজ্ঞাসা করেনি। না ই করতে পারে, এ আর এমন কি ব্যাপার?কিন্তু আজ মনে হচ্ছে নিজের মনের কোণে সযত্নে লুকিয়ে রাখা ঝাঁপিটা একবার খুলতে, যে কথা বলা হয়নি কাউকে, যে রাগের কারণগুলো কিংবা আনন্দের উৎস, ভাগ করা হয়নি যে মুহূর্ত গুলো কারো সাথে, সেই স্মৃতিগুলো আজ যদি মন খুলে বলা যায়? ক্ষতি কি? অভিমন্যু কি শুনবে?
“ওই দেখুন আবার চুপ করে গেলেন কেমন? আপনারাও যদি এত ভাবেন তাহলে আমাদের মতন চুনোপুঁটির কি হবে বলুন তো? আমি আপনার জায়গায় থাকলে তো আনন্দেই মরে যেতাম! রোজ এই এত চিন্তা টেনশন থাকতো না। আলাদাই লাইফ হত!”
“আপনার খুব ইচ্ছে তাই না আমার জীবনটা বাঁচার? “
“ভীষণ। সাত সকালে উঠে টিউশন পড়াতে যেতে হবে না, ভিড় বাস এ ইঁদুরঝোলা হয়ে ইউনিভার্সিটি যেতে হবে না, পাস করার পর চাকরির টেনশন নিতে হবে না, খরচ করার আগে ২বার হিসেব করতে হবে না। শুধু আমি কেন, মুখে যে যাই বলুক, যে কেউ এই জীবনটারই স্বপ্ন দেখে ম্যাডাম। আচ্ছা আপনাদের বোর লাগে না? এত আরাম স্বাচ্ছন্দ্যর মধ্যে এক ঘেয়েমি আসে না? আমাদের যেমন ধরুন ৬ মাসে একবার মটন খেয়ে, বা অতি কষ্টে টাকা জমিয়ে বছরে একটা ট্রিপ করেই আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু আপনাদের তো এটা রোজকার ব্যাপার। বোর হন না? “
“আচ্ছা আপনাকে কে বললো যে আমাদের লাইফে কোনো সমস্যা নেই, কোনো টেনশন নেই, কোনো না পাওয়া নেই, কে বলে গেল এগুলো আপনার কানে কানে?”
“মানে? আছে? না মানে টেনশন তো সবার লাইফেই থাকে, কিন্তু তাও…”
“অফকোর্স আছে। কেন থাকবে না? হ্যাঁ আপনি যেগুলো বললেন সেগুলো হয়ত নেই কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমার জীবনে কোনো না পাওয়া নেই, কোনো চিন্তা নেই, কোনো খারাপ লাগা নেই। আমি কথা বলতে, গল্প করতে, বন্ধুত্ব করতে খুব ভালোবাসি জানেন তো। কিন্তু ছোট্টবেলার থেকেই একটা গন্ডি কেটে দেওয়া হয়েছিল আমি কাদের সাথে মিশতে পারি আর কাদের সাথে পারি না সেই নিয়ে। আমি ছোট্ট থেকেই বন্ধুদের
সাথে একলা ঘুরতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, মানে বেশ দূরপাল্লার ট্রেনে করে, সারারাত ধরে গল্প, আড্ডা, কোনো অভিভাবক থাকবে না যেখানে, একটা সব পেয়েছির দেশে বেশ যাবো আমরা বন্ধরা কজন। বাকিরা যায়, কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি কোনোদিন। আমি না এত ভেবে চিনতে বুঝে শুনে গল্প করতে পারি না, যা মনে আসে বলে দিতে চাই, কিন্তু পারি না সেটা, আমি আমারই বাড়িতে নিজের ইচ্ছে মতো চিৎকার করতে পারি না গলা ফাটিয়ে, নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে পারি না, নিজের ইচ্ছেমতো রুটিনে বদল এনে নিজেরই জীবনটাকে নিজের মতন করে একটু অগোছালো করতে পারি না একদিনের জন্য। আমি আমার মতন করে বাঁচতে পারি না। ছোট থেকেই কত কথা কত গল্প জমিয়ে রাখতাম, বাপি এলে বলব, মায়ের কাছে নিয়ে গেলে গল্প করব, কোনোদিন হতোই না সেটা। আমি যখন অপেক্ষা করতাম বাবা কাজের জন্য দেশের বাইরে, মায়ের কাছে কেউ খুব একটা নিয়ে যেত না, যখন নিয়ে যেত আর গল্প বলা হতো না, আর বাবার ফিরতে ফিরতে গল্পগুলো আমার ছোট্ট স্মৃতি থেকে ততদিনে হারিয়ে যেত। ধীরে ধীরে মাকে তাও একটু পেয়েছি, বাবার সাথে শেষ কবে সময় নিয়ে দুটো কথা বলতে পেরেছিলাম মনে পড়ে না। “
এতগুলো কথা না ভেবেচিন্তে একটানা কবে যে বলেছিল মনে পড়ে না টিকলির, আজ এভাবে একটা অজানা অচেনা ছেলেকে এইসব বলবে তেমন কোনো কথাও তো ছিল না, তাও বলে দিল। বলে বোধহয় ভালোই করল, বেশ ভালো লাগছে আজ মনটা। যে কথাগুলো বলতে চেয়েও শুধু শ্রোতার অভাবে বলা হয়ে ওঠেনি আজ সেগুলোই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মনটাকে হালকা করে দিল অনেকটা।
“সরি, কত কি বলে দিলাম, আমি আপনাকে এতকিছু বলতে চাইনি, এক্সট্রিমলি সরি, আসলে… “
“কাল আরেকবার সময় বের করে দেখা করতে পারবেন প্লিজ? “
“হ্যাঁ? মানে… “
না বলার ইচ্ছে টিকলির ছিল না, আর হ্যাঁ বলার সাহসটা পাচ্ছিল না ও। খেয়াল পড়তে দেখল ওর গাড়ির কাছেই এসে পড়েছে ওরা, আগেই রতনদাকে ফোন করে চলে যেতে বললে ভালো হত, ওর যে একটুও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়ির দিকে এগোল ও, যেতে গিয়ে খানিক থমকে দাঁড়িয়ে বললো আবার, ” আমার নম্বরটা আছে তো আপনার কাছে? একবার তাহলে ফোন করে কাল কখন বেরোব কথা বলে নেওয়া যাবে। আজ আসি তাহলে? “
নিজের গাড়ির দিকে এগোল টিকলি, অভিমন্যু হাত নেড়ে বিদায় জানাল, কিন্তু টিকলির মনটা এত খারাপ করছে কেন? এমনটা তো আগে হয়নি, কালই তো দেখা হবে। আর অভিমন্যু কে এমন যে ওর সাথে দেখা হওয়া না হওয়ার উপর টিকলির মন এর আবহাওয়া এভাবে নির্ভর করছে? ওর হলোটা কি? গাড়িতে বসে চোখ দুটো বুজে ফেলল টিকলি, গাড়ি ছেড়ে দিল। অভিমন্যু আজ ও গাড়িটা চোখের আড়াল না হওয়া অব্দি দাঁড়িয়েই রইলো ওখানে, ভাগ্যিস টিকলি চোখ খোলা রাখেনি, রাখলে অঘটনটা হয়ত আজই ঘটত!
*****
(পরদিন )
আজ সকল থেকে দিনটাই যেন খিচুড়ির। তাই অমৃতা আর বিন্তিদি মিলে আজ রান্নাঘরে লেগেও পড়েছে কাজে। মুগের ডালের খিচুড়ি, মিষ্টি মিষ্টি আলুরদম, আর হরেক রকমের ভাজা। টিকলিরও খুব প্রিয়। আর আজ অমৃতার শরীরটাও একটু বেটার, তাই কোমর বেঁধে নেমেই পড়ল। রান্নাঘরের জানলাটা দিয়ে ও বৃষ্টির ছাঁট আসছে অল্প অল্প, বন্ধ করে দিল অমৃতা, সামনের জুঁই ফুলের গাছটা ডাল পালা সমেত আছড়ে পড়ছে রান্নাঘরের জানলার কাঁচে, বাইরে যা আঁধার ঘনিয়েছে সকল নাকি বিকাল বোঝা মুশকিল।
“কি দুর্যোগ শুরু হলো দিদি বলতো? বৃষ্টি তো আর থামছেই না। জল দাঁড়িয়ে যাবে এবার রাস্তায়।” সবজিগুলো কুটতে কুটতে বললো বিন্তিদি।
“হ্যাঁ তাই তো দেখছি, তুমি সব প্লাগ গুলো খুলে দিয়ে এসছো তো?”
“এই যাহ!” বলেই জিভ কাটলো বিন্তিদি।
“তুমি যে কি করো না, কতবার বলেছি এরকম ঝড় বৃষ্টিতে প্লাগ গুলো খুলে দেবে, এই করে আগের টিভিটা নষ্ট হয়েছে।” বলতে বলতেই উপরে ছুটল অমৃতা।
সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠেই টিকলির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ও।
“তুই এই বৃষ্টির মধ্যে বেরোবি নাকি? রেডি হচ্ছিস কেন? কোথায় যাবিই বা এখন এই অবস্থায়?”
“ওহ তোমায় তো কাল বলাই হয়নি মা, ঠিক আছে আজ বলব সব ফিরে এসে। এখন রেডি হতে দাও নয়তো দেরি হয়ে যাবে। “
চোয়াল শক্ত হল এবার অমৃতার, কদিন ধরেই টিকলির মধ্যে এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছে ও, নিজের অসুস্থতার জন্য সেভাবে তলিয়ে ভাবার অবকাশটুকু পায়নি এই কদিন, কিন্তু এই ঝড় জলে কি এমন কাজ যে বেরোতেই হবে?
“কার সাথে বেরোচ্ছিস তুই? রাজ… “
“আরে অভিমন্যুর সাথেই বেরোচ্ছি, তোমায় এসে সব বলবো কেমন? এই দেখো বৃষ্টিটা কিন্তু কমে এসেছে, এই বেলা বেরিয়ে পড়ি, তুমি সাবধানে থেকো, চিন্তা করো না কেমন। রতনদা তো আছেই। চলো টাটা।”
অমৃতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একপ্রকার ঝড়ের মতোই বেরিয়ে গেলো টিকলি দুর্যোগের মধ্যে। মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল এবার অমৃতার। কি করছে এটা টিকলি? আর কয়েকমাস পর রাজদীপের সাথে বিয়ে, আর ও এখন অভিমন্যু বলে একটা ছেলের সাথে রোজ রোজ… যাকে কেউ চেনেও না ওরা। টিকলি তো এরকম ছিল না। হঠাৎ করেই ও এরকম বদলে যাচ্ছে কেন? কি চলছে ও মাথার মধ্যে? টিকলির থেকে পুরোটা না জানা অবধি তো কিছু বুঝতেও পারছে না অমৃতা, একবার কি আদিত্যর সাথে… না না, টিকলির সাথে কথাটা আগে বলা দরকার, নয়তো বেকার জটিলতা বাড়বে, হয়তো অমৃতাই একটু বেশি ভাবছে। বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালো অমৃতা, টিকলির গাড়িটা বেরিয়ে গেল ততক্ষণে।
*****
রতনদাকে বলে কয়ে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মিনিট দশেক দেরিই হলো টিকলির, এখন বৃষ্টিটা ধরেছে অনেকটাই। মেঘলা আকাশ আর ঝোড়ো হাওয়া, পায়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছে উল্টোদিকের রাস্তায় চোখ পড়লো টিকলির। অভিমন্যু এখনো দেখতে পায়নি ওকে, বার বার নিজের হাত ঘড়িটা দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে টিকলির অপেক্ষায়। একটা গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে আজ অভিমন্যু। আজ যেন অগোছালো ভাব সরিয়ে রেখে অনেক বেশি পরিপাটি মানুষটা, চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে সামনে তাকাতেই অবশেষে তাকাল টিকলির দিকে। কোনো এক অজানা কারণেই টিকলির বুকের ভিতরটা আজ মুচড়ে উঠল হঠাৎ করেই, এমনটা কেন হলো? বুকের মধ্যে যেন একটা যন্ত্রণা, কিন্তু বড় মিষ্টি সে যন্ত্রণা, কিন্তু এমনটা কেন হলো ওর? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। আজ অভিমন্যুর চোখে চোখ রাখতেই বুকের ভিতরটা এরকম বাইরের ঝড়ের মতো উথালপাথাল হচ্ছে কেন? এর আগে তো হয়নি, বড় মধুর এক কষ্ট হচ্ছে যেন, কারণ জানে না। কিন্তু হচ্ছে, অভিমন্যু হাতটা নেড়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে এলো এদিকে। টিকলি তাকিয়েই ছিল মুখে হাসিটা নিয়ে। অভিমন্যু ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই বললো, “আরে এসে ডাকবেন তো ! কি মুশকিল ! চলুন এদিকে যেতে হবে আগে। “
“আপনার কথা মতো রতনদাকেও বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম, প্ল্যানটা কি বলুন তো আপনার?”
দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল ওরা, টিকলির কথায় খানিক হেসে আবার টিকলির চোখের দিকে তাকাল অভিমন্যু, ” আপনাকে কিডন্যাপ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ক্ষমতায় কুলোবে না আমার ম্যাডাম, তবে করতে পারলে মন্দ হতো না, মোটা টাকা মুক্তিপণ দাবি করতাম।”
এটুকু বলে আবার তাকাল টিকলির দিকে। উল্টো দিক থেকে আসা ঝোড়ো হাওয়াটায় এক সেকেন্ডের মধ্যে অভিমন্যুর পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল টা এলোমেলো করে দিল এসে, একটু যেন শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো মনে মনে টিকলি। এই তো এবার বেশ লাগছে এমন একটা ভাব।
টিকলির দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অভিমন্যুই আবার বললো, “আপনিই তো কাল বললেন খাঁচার মধ্যে বন্দি, তো ওই চার চাকা গাড়িটাও তো একটা খাঁচাই, গাড়িতে করে কলকাতা ঘুরবেন ভাবলে নমস্কার। আমার দ্বারা হবে না তাহলে। “
“মানে?”
“মানে আবার কি, কলকাতার অলিগলি সব চষে ফেলবো আজ, কোথায় যেতে চান বলবেন খালি। এই কলকাতার ম্যাপ পুরো আমার নখদর্পণে। শুধু হাঁটতে হবে। বলুন রাজি? পেতে চান মুক্তির আনন্দ?পায়ের জোরটা চাই তাহলে শুধু। “
হেসে ফেলল টিকলি। এগোলো ওরা সামনের ট্রাম ডিপোর দিকে।
*****
“আচ্ছা আপনার বাড়ির ব্যাপারে তো কিছুই জানা হলো না, কে কে আছেন আপনার বাড়িতে?”
“আমাদের বাড়িতে আছে অনেকেই, তবে সেভাবে দেখতে গেলে সাকুল্যে আমরা তিনজন। আমি, মা, বাবা, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে বছর তিনেক। এছাড়া শরিকি বাড়ি, কত মানুষ যে আছে, অত সবার পরিচয় ও জানা নেই। চাকরির চেষ্টা করছি, টিউশন পড়াচ্ছি, যে ভাবেই হোক বাবাকে বাড়ি কেনার সময় যাতে কিছুটা হলেও হেল্প করতে পারি। মায়ের এই বাড়িতে খুব কষ্ট হয় আসলে, মাত্র দুটো ঘর, রান্নাঘর উপরে, বার বার উপর নীচে, এই বয়সে আর পারছে না মানুষটা, তাই মায়ের জন্যই আগে বাড়িটা করতে হবে তারপর বাকি সব কিছু। “
“বাকি সব কিছু মানে?”
“বাকি সব কিছু বলতে নিজের কিছু স্বপ্ন আছে, সে সবারই থাকে, নিজের স্বপ্ন গুলো নিজের চেষ্টাতেই পূরণ করতে চাই, কিন্তু সেগুলো পরে, আগে মায়ের জন্য একটা বাড়ি, তারপর বাকি সব কিছু। “
“বাহ্ !”
“আচ্ছা, আপনি বলেন সবসময়ে আপনার মায়ের কথা, ওনার নাম কি? মানে আপনাদের বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই লাইম লাইটে থাকেন, আপনার বা আপনার মায়ের ব্যাপারে ঠিক… “
“আমার মা খুব সাধারণ একজন মানুষ, আমার বাড়ির বাকি সদস্যের মতন অত হাইফাই সেলিব্রিটি নন মোটেই, উনি ইকোনমিক্সের প্রফেসর, আর ভীষণ ভালো ছবি আঁকেন, ওনার আঁকার প্রদর্শনীও হয়তো দেখে থাকবেন, অমৃতা মুখার্জী, উনিই আমার মা।”
“আপনি অমৃতা মুখার্জীর মেয়ে? ওনার নাম শুনেছি বৈকি, আমার দিদির দৌলতে, দিদি আঁকাআঁকি করে, দিদি ওনার খুব বড় ফ্যান ইনফ্যাক্ট। আমি এসব নিয়ে খুব কমই জানি, ঝোঁক ও কম, বাট দিদি জানলে তো আনন্দে পাগল হয়ে যাবে জাস্ট! হ্যাঁ হ্যাঁ, দিদি বলতো অমৃতা মুখার্জী আর আদিত্যনাথ রায়বর্ধনের সেপারেশনটা নিয়ে পেপারে তখন, ওহ… সরি সরি সরি!!! আই এম এক্সট্রিমলি সরি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না আসলে হুট করে বলে ফেলেছি, রিয়েলি সরি… “
অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে টিকলি বললো, ” আরে না না, ঠিক আছে, আই নো ইটস কমপ্লিকেটেড, আপনার রিএক্ট করাটা অস্বাভাবিক কিছু না, আমি অভ্যস্ত, ইটস ওকে। “
অভিমন্যুর চোখের অভিব্যক্তি চোখ এড়ালো না টিকলির, আবার সবটা গুলিয়ে ফেলবে যেন ও, কি যে হচ্ছে আজ ওর বার বার, অভিমন্যু যেন চোখের ভাষা দিয়েই বারংবার ক্ষমা চাইছে, নিজের ভুলে দিয়ে ফেলা আঘাতটার জন্য। চোখ দুটো নামিয়ে নিলো টিকলি। প্রসঙ্গ স্বাভাবিক করতে একটু গলা ঝেড়ে অভিমন্যু বললো, “আচ্ছা আপনি কি সবসময়েই এরকম শাড়িই পড়েন? না মানে…”
“হ্যাঁ, এছাড়া উপায় নেই, নিজেদের আগে বাকি লোকের কথা ভাবতে হয় যে, ট্রেন্ড সেটার যে, যা চলে এসেছে, তাই চলছে আজ ও। কিছুই করার নেই।অগত্যা !”একটা শ্বাস ছেড়ে হেসে ফেলল টিকলি। অভিমন্যু মুচকি হেসে বলল, “তবে শাড়ি তে আপনাকে মানায় কিন্তু বেশ, এই কাঁচা হলুদ রং টা স্পেশালি।”
“বলছেন?”
“একদম। “
“আচ্ছা আমার কি শুধু হেঁটেই যাবো, আর ঘুরেই যাবো? খাবো না কিছু?”
“একদম। হুকুম করুন শুধু।”
“উমম…আমার দিদা না খুব ভালো রাঁধতো, আমাদের ‘মঞ্জরী’ তে সেভাবে কেউই খায় না তাই কখনোই হয়নি, মানে একদমই চল নেই, আর মা ও এখন খায় না, বিন্তিদি ও রাঁধতে জানে না, আজ হঠাৎই আড় মাছ খেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ, কত বছর যে খাইনি। পেলে এখনই একথালা ভাত খেয়ে নেব! দিদু চলে যাওয়ার পর থেকে আর একদিনও জোটেনি কপালে। কোন বাঙালি রেস্টুরেন্টে গেলে হয় না?”
অভিমন্যু টিকলির চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মুখে হালকা হাসি টেনে একটু ভাবার ভঙ্গিতে বললো, “এক ঘন্টা সময় দিন ম্যাডাম। আপনার এই ইচ্ছেটাও পূরণ হয়ে যাবে আজ। “
“সত্যি?”
“একদম সত্যি। ব্যাস, আর কোনো প্রশ্ন নয়, একটু ধৈর্য ধরুন শুধু। আচ্ছা এক মিনিট, আমি একটা ফোন সেরে আসছি।”
ফোনটা নিয়ে একটু ধারে সরে কথা বলতে লাগল অভিমন্যু, টিকলি সেইদিকেই তাকিয়ে ছিল, কদিন আগে এই মানুষটাকে ও চিনতোই না, আর আজ? এই মানুষটার মধ্যেই ভীষণ ভালো একজন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে ও, যে ওর সমস্ত ভালো মন্দ কথা গুলো বিনা প্রতিবাদে শোনে, যাকে বলতে গেলে দুবার ভাবতে হয় না। যে সামনে এসে দাঁড়ালেই যেন অনেকটা ভরসা জাগে মনে, যার সাথে দেখা হলেই মনটা আপনা আপনিই ভরে যায় খুশিতে। কবে এত কাছের হয়ে উঠল অভিমন্যু? এই কটা দিনে টিকলি যতটা জীবনীশক্তি নিয়ে বেঁচেছে প্রাণ ভরে, এত গুলো বছরেও এত প্রাণ খুলে বাঁচেনি ও। গন্ডির মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে আজ প্রথম বার বাঁধনছাড়া খোলা হাওয়ার পরশ পেয়েছে ও। আচ্ছা অভিমন্যু, তুমি আগে কেন এলে না বলতো? বড্ড সময় নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু এরপর প্রতিটা মুহূর্ত এইভাবে ই বাঁচবে টিকলি। আচ্ছা অভিমন্যু ফোনে কথা বলতে বলতেও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে না? বুকের ভিতরে সেই মিষ্টি যন্ত্রণাটা আবার জাঁকিয়ে বসছে, অভিমন্যুর চোখের চশমা পেরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করছে টিকলির, থ্যাংক ইউ। এভাবে আমার জীবনে এসে পড়ার জন্য। ভাগ্যিস এলে! না হলে তো…বুকের ভিতরের চিনচিনে অনুভূতিও যে এত মধুর হতে পারে জানা ছিল না টিকলির। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে জানে না ও, জানতে চায় ও না, শুধু এটুকু জানে জানে যা হচ্ছে বড্ড ভালো হচ্ছে। অভিমন্যু কথা শেষ করে সামনে এগিয়ে এসে ওর চোখের সামনে একটা তুড়ি মারলো সজোরে, ” আবার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে দেখো মেয়েটা! দিন রাত কি যে ভাবে এত কে জানে? যাক গে, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এলো, খেতে তো যাচ্ছি আমরা, এখান থেকেই লঞ্চ ধরলে সবথেকে সুবিধা। আর আজ যা ওয়েদার, যাবেন? “
“আমি কখনো লঞ্চ এ চাপিনি আসলে। “
“তাতে কি? সে তো আজ ট্রামেও প্রথম চাপলেন, সেদিন গঙ্গার ঘাটেও তো প্রথম বসলেন, এটারও শুভারম্ভ হোক না, ক্ষতি কি? চলুন চলুন, উঠেই পড়ুন। “
সামনের ঘাটের দিকে এগোতে লাগলো ওরা।
*****
“গিন্নীমা, নতুন জামাই এসেছে গো নীচে…”
“মানে? কে এসেছে এখন আবার?”
“আরে আমাদের রাজদীপ দাদা গো, আমি বৈঠক খানায় বসিয়ে এসেছি, দিয়ে তোমায় আগে ডাকতে এলাম।”
ভ্রুটা কুঁচকে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন পরমাদেবী, রাজদীপ হঠাৎ আজ এরকম আচমকা! সব ঠিক আছে তো?
“কি সুন্দর রাজপুত্তরের মতন দেখতে বল রাজদীপ দাদাকে, সেই কোন ছোট্ট থেকে দেখছি, বিদেশ থেকে ঘুরে এসে যেন জেল্লা দশগুণ বেড়ে গেছে, কি সুন্দর গো। আমাদের টিকলি দিদিই বা কম কিসে? দুজনকে মানিয়েছেও বেশ, দেখলে চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়।”
হাতের বাসনগুলো মুছে তাকে তুলতে তুলতে বকে যেতে লাগল বিমলা, তবে পরমাদেবীর কানে কিছুই ঢুকল না তেমন।
টিকলিটা তো বাড়িতেও নেই, অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপছিল পরমাদেবীর, মিথ্যে বলবেন কি করে, টিকলি যে অমৃতার কাছে গেছে, আর অমৃতার কথা শুনলে আবার রাজদীপ কিছু… না না, ও
ও তো তখন ছোট ছিল, কিন্তু প্রবাল কঙ্কণা এরা শুনলে আবার কিছু… আর ভাবতে পারছেন না উনি। বিমলাকে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে বলে নীচে ছুটলেন পরমাদেবী।
রাজদীপ একাই বসে আছে বৈঠক খানায়, ছিঃ ছিঃ কেউ একটু দেখেওনি, মান সম্মান আর রাখবে না এরা এই বাড়ির। দুশ্চিন্তা সরিয়ে মুখে এক গাল হাসি টেনে ঘোমটাটা ঠিক করে ঘরে ঢুকলেন পরমাদেবী। রাজদীপ ছোট থেকে প্রায়ই আসতো এই বাড়িতে, এই বাড়ির সবটুকুই ও ভালো ভাবেই চেনে, কিন্তু তবুও এখন ব্যাপারটা আলাদা। ছোট থেকেই টিকলির মতো ও ও ঠাম্মি বলেই ডাকত, পরমাদেবীও দাদুভাই বলতেন, কিন্তু এখন তো সে হবু নাতজামাই, কি বলবেন খুঁজে পেলেন না পরমাদেবী। খানিক ইতস্তত করে নাম ধরে সম্বোধন করেই সামনের সোফাটায় গিয়ে বসলেন।
রাজদীপ মুখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে তাকালো চিরপরিচিত ঠাম্মির দিকে, নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সেই আগের মতন করেই বলল, “কেমন আছো ঠাম্মি? সেদিন তো তোমার সাথে বেশি গল্পই হলো না।”
আশ্বস্ত হলেন পরমাদেবী, নাহ একই রকম আছে ছেলেটা, একে জামাইআদর না করলেও চলবে,
বদলায়নি বরং ঘরের ছেলেই আছে। হেসে বললেন, ” দাদুভাইয়ের কি এখন ঠাম্মির সাথে কথা বলার সময় আছে?এখন হবু জামাই বলে কথা ! ব্যাপারই আলাদা!”
“তোমার সাথে কারো তুলনা হয় নাকি?ধুস, কি যে বল। “
“থাক থাক, অনেক হয়েছে, গরম গরম লুচি আসছে, খেয়ে নাও আগে।”
“উফফ ! লাভলি! “
ঠিক আগের মতোই ছেলেমানুষি এখনো আছে ছেলেটার মধ্যে, ছেলে বলা যায় না এখন যদিও, রীতিমতো সুপুরুষ এখন, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, টিকলির জন্য এর থেকে ভালো ছেলে আর কোথায় ই বা পাওয়া যেত?
খোশগল্পে আগের মতোই মজলেন ঠাকুমা আর নাতজামাই মিলে, কথা চলতে চলতেই গরম লুচি আলুরদম মিষ্টি এসে হাজির, রাজদীপের এই বিমলাদির হাতের পাতলা সাদা ফুলকো লুচি ভীষণ প্রিয় ছোট্ট থেকেই, তাই আর বেশি দেরি না করে তাড়াতাড়ি মুখে পুরল লুচিটা, আবহাওয়া তাহলে স্বাভাবিক, একটু নিশ্চিন্ত হলেন পরমাদেবী। খেতে খেতেই বলল রাজদীপ, “বাড়ি ফিরছিলাম আজ একটু ঝটপট, তাই ভাবলাম একটু ঢুঁ মেরেই যাই, তা তোমার নাতনি কোথায় গো? তার তো পাত্তাই নেই, ফোন করলাম ধরেননি, মেসেজের ও রিপ্লাই নেই, এখনো দেখতে পাচ্ছি না, গেলেন কোথায় উনি?”
যে ভয়টা পাচ্ছিলেন সেটাই হলো, প্রমাদ গুণলেন পরমাদেবী।
*****
“না এবার না আমায় উঠতেই হবে কাকিমা, নয়তো এতটা পথ যাবো তো রাত হয়ে যাবে, মা ও চিন্তা করবে, তাই… “
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল টিকলি, অভিমন্যুর মাকে। সেই দুপুর থেকে এসেছে, এত গল্প যে কারো সাথে প্রথম আলাপে জমতে পারে না বললে বিশ্বাস হবে না। আর অভিমন্যু যে এইরকম একটা কান্ড বাধাতে পারে স্বপ্নেও ভাবেনি টিকলি। ও যে তখন সরে গিয়ে বাড়িতে মাকে ফোন করে সোজা বলে দেবে জমিয়ে আড় মাছ রাঁধার জন্য, তা কে জানতো? তবে বলে সত্যি বলতে কি ভালোই করেছিল এখন মনে হচ্ছে টিকলির, কাকিমা এত আন্তরিক যে যাই বলা হোক না কেন কম হবে, আর রান্না ! এমন তৃপ্তি করে এত ভাত কবে যে ও খেয়েছিলো মনে পড়ে না। দিদুর চলে যাওয়ার পর থেকে এই প্রথম, আর সব কিছুর উপর এই সহজ সরল মানুষটার আন্তরিকতা, এত যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে এরকম অজানা অচেনা একজনের জন্য… কজন করে? টিকলির যেন আর যেতেই ইচ্ছে করছে না। তাই তখন থেকে উঠব উঠব করেও সেই বসেই আছে, কিন্তু এবার না উঠলে আর হবে না।
মানুষটা নিতান্তই সাধারণ, ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ, টিকলি বেরোবার সময় প্রণাম করে বেরোতে গেলে ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বুকে টেনে নিলেন, বয়স হয়েছে মানুষটার, কিন্তু ক্লান্ত চোখ দুটো নিস্তেজ হয়নি, এই অতি সাধারণের মাঝেও ভারী সুখী এই মানুষগুলো। অনেকগুলো অমূল্য মুহূর্ত কে সঙ্গী করে বেরিয়ে এলো টিকলি, যেতে হবে নর্থ থেকে সাউথ এ, অভিমন্যুই পৌঁছে দেবে বলল। গেট ঠেলে বেরোতেই দেখলো অভিমন্যু একটা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে।
“এটা আপনার বাইক?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম, চারচাকার সামর্থ্য তো আর নেই, তাই এই দুচাকার বাহনেই যদি একটু এডজাস্ট করেন…”
“আমার তো চার চাকার থেকে দুচাকাটাই এখন বেশি থ্রিলিং মনে হচ্ছে মশাই। “
“আচ্ছা! তাই বুঝি?” গলির ভিতরটা একটু আলো আঁধারি, টিমটিমে হলুদ আলোগুলো জ্বলছে বটে, তবে আঁধারটাও আছে জাঁকিয়ে সমানভাবে। সেই আলো আঁধারে অভিমন্যুর মুখটা একদম অন্যরকম লাগছিল, যেন মনে হচ্ছিল থমকে যাক না সময়টা। ওর ফর্সা মুখে নিভু নিভু হলুদ আলোটা গাছের ডাল পাতা পেরিয়ে পড়ছে, ভীষণ মায়াবী লাগছে ওর চশমায় ঢাকা চোখ দুটো, অগোছালো চুলটা, ওর গালের কাটা দাগটা, ওই মারাত্মক হাসিটা এই সব কিছুর সাথে যেন একটু একটু করে মিশে যাচ্ছিল টিকলি।
টিকলির চোখে চোখ রেখে টিকলির মনের ভিতরটা কি পড়ে ফেলতে চাইল অভিমন্যু, টিকলির দিকে একটু ঝুঁকে একদৃষ্টে ওর চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে বলল অভিমন্যু,” বুঝলাম। বসুন এবার ঝটপট। “আর কথা না বাড়িয়ে বাইক ছোটাল অভিমন্যু মহানগরীর রাস্তা ধরে। অভিমন্যুর কাঁধে হাত রেখে একটা ঘোরের মধ্যে বসেছিল টিকলি। সারা রাস্তা আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হল না, এই মুহূর্তের রেশটা যতটা সম্ভব যত্ন করে নিজের মধ্যে রেখে দিলো ও, অভিমন্যুও আর বেশি কিছু কথা বলল না। শুধু বাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েও টিকলি যখন নামল না বাইক থেকে তখন শুধু ওর দিকে ঘাড়টা অল্প ঘুরিয়ে বললো,”নামো। এসে গেছি।” নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল টিকলি, কিছু যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে আবার। শুধু স্মিত হেসে অভিমন্যুকে বিদায় জানালো টিকলি, না আর কোনো শব্দ বিনিময় হলো না। আজ টিকলি দাঁড়িয়ে রইল, অভিমন্যুর রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া অবধি, আচ্ছা অভিমন্যু ওকে এখুনি তুমি সম্বোধন করলো না? ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দরজার দিকে ঘুরতেই চোখ পড়লো, মা থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সদর দরজায়।