সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।।

“এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন যখন ঘটনাটা এত বড় আকার নিয়ে নিল তখন তোমার টনক নড়ল, আর।।।”

“প্লিজ তুমি চুপ করো একটু, বাবার সামনে কথাটা কিভাবে বলব সেটাই বুঝতে পারছি না।”

“তুমি তো কোন দোষ করোনি, তাহলে তুমি এত ভাবছ কেন? যে দোষ করেছে বা করছে, তার মধ্যে তো ন্যূনতম লজ্জাও চোখে পড়ল না এখনও পর্যন্ত, তুমি তাহলে কেন এত ভাবছ?”

“উফফ! তোমার কি মনে হয় এই কথাটা বাবার কানে ওঠার পর তোমার কথাটাও উঠবে না? তুমিই যে প্রথম এই ঘটনাটার আঁচ পেয়েছিলে সেটা কি বাবা জানতে পারবে না ভেবেছ?”

“আশ্চর্য, সে জানুক না, ক্ষতি কি, আমি ভয় পাই না কাউকে। আমি তো অন্যায় করিনি কোনো, আর সব জেনেও অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে বা এইভাবে ভয় পেয়ে ভুলটা কিন্তু তুমি করছ, আমি না। অন্যায় করেছে তোমার ভাই, আর অন্যায় যে সইছে মানে তুমি, এদের মধ্যে তো তাহলে কোন তফাৎই নেই। আমার তো রীতিমত অবাক লাগছে তোমায় দেখে, আমি তো ভাবতেই পারিনি সবটা জেনেও তুমি এইভাবে রিয়াক্ট করবে আদিত্য। হোয়াটস রং উইথ ইউ?”

“যেটা বোঝো না সেটা নিয়ে কথা বোলো না অমৃতা। তুমি বোধ হয় বোঝো না, বা মনে রাখো না তুমি কোন বাড়ির সম্পর্কে এই কথা বলছ। আমাদের বাড়ির সম্মান জড়িয়ে আছে এই সব কিছুর সাথে। তুমি আসলে হঠাৎ করে এই নাম, যশ পেয়ে গেছ তো, খুব সহজেই, তাই কদরটা বোঝো না। হেলায় মাটিতে ফেলতে চাও। কত কষ্ট করে আজ এই জায়গায় ‘রায়বর্ধন’ পৌঁছেছে, সেটা বিন্দুমাত্র অনুভব করলে আজ এই কথাটা বলতে না, আগে বাড়ির সম্মানের কথা ভাবতে।।।”

“এক মিনিট, তুমি কি সবকিছুর জন্য আমায় দায়ী করছ? আরে আশ্চর্য তো! তুমি কি পাগল? এই কথাগুলো তোমার ভাই এর এই জঘন্য অপরাধটা করার আগে ভাবা উচিত ছিল, বুঝেছ? আর কিসের মান সম্মান, যে বাড়ির ভিতর এইরকম নোংরামো চলে, সেই বাড়ির ঠুনকো মান সম্মান নিয়ে আর গলা ফাটিও না।”

“শাট আপ! ‘মঞ্জরী’ নিয়ে আর একটা উল্টোপাল্টা কথা বলবে না তুমি।”

“কেন বলব না? বেশ করব বলব। একটা মেয়ের জীবন নরক বানিয়ে তুলেছে ওই পাষন্ড, তার নামের পিছনে ‘রায়বর্ধন’ পদবীটা আমি তোমার জায়গায় থাকলে নিজে হাতে মুছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। তা না করে তুমি আমায় এসব বলছ? কি ভাবছ, মেয়েটা তো গরীব, কোন প্রভাব প্রতিপত্তি নেই, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেবে তাই না? কি আর ক্ষমতা বেচারীর?”

“হ্যাঁ, তাই করব, দরকার হলে তাই করব, কিন্তু এই বাড়ির উপর আঁচ আসতে দেব না, এরকম বহু ঘটনা লুকোনো থাকে বড় বড় বাড়ির দেওয়ালের আনাচে কানাচে। এটা এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। তিল কে তাল করো না, আমি বাকিটা বুঝে নেব, দয়া করে নিজের মুখটা বন্ধ রাখো।”

“ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ঘেন্না করছে আমার তোমার সাথে কথা বলতে। কোন পার্থক্য নেই জানো তো তোমার সাথে তোমার ভাইয়ের, একজন রেপিস্ট আর একজন মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ একটা।”

“অমৃতা!”

দরজা খোলার আওয়াজে চোখটা খুলল অমৃতা। আঙ্গুল দিয়ে কপালের ক্ষতটায় একবার হাত দিয়ে তাকাল টিকলির দিকে। প্রায় পনের মিনিট ধরে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে টিকলির জন্য, অথচ টিকলি যেন অন্য এক জগতেই আছে। চেয়ারটা টেনে বসলে ওর দিকে সোজাসুজি তাকাল অমৃতা। পরিস্থিতি যে থমথমে সেটা বুঝতে পারছিল টিকলি, কিন্তু তার কারণ বুঝতে পারছিল না। মা নিঃশব্দে ওর থালায় রুটি, তরকারি বাড়তে লাগল। বিন্তি পিসি জলটা গড়িয়ে দিয়ে নিজের খাবারটা গুছিয়ে নিচ্ছিল ঝটপট। সবাই এরকম অদ্ভুত বিহেভ কেন করছে, তার বিন্দুমাত্র ক্লুও পাচ্ছে না টিকলি। খুব কি দেরী করে ফেলেছে ফিরতে? না তো, এরকম তো আগেও ফিরেছে ও। তাহলে? কিছু কি ঘটেছে? বাড়িতে কি কেউ এসেছিল? মার শরীর তো ঠিকই আছে যা বুঝছে। ভেবে কোন কূল কিনারা পেল না টিকলি। চুপচাপ খেতে শুরু করল ও। বিন্তিপিসি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অমৃতা বলল, ” বিন্তিদি দরজাটা একটু বন্ধ করে দিয়ে যাও এখন।”

মাথা নেড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল বিন্তি পিসি।

টিকলি স্যালাডটা মুখে পুরতেই অমৃতা বলল, “তুমি ফিরবে কবে?”

মা খুব রেগে থাকলে তুমি, তুমি করেই সম্বোধন করে। কিন্তু আবার কি করে ফেলল ও? মায়ের চোখদুটো পড়ার চেষ্টা করছিল ও, কিন্তু।।।

“কেন মা? কি হয়েছে?”

“আজ সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি? আর এই ছেলেটাই নিশ্চয় অভিমন্যু, তাই তো?”

“মা তোমায় সেদিন বলেছিলাম না, জ্যামে আটকে গেছিলাম, তখনই অভিমন্যুকে ওখানে।।।”

“আমি জানতে চেয়েছি এই ছেলেটির নামই অভিমন্যু তাই তো? হ্যাঁ কি না?”

একটু চুপ করে গেল টিকলি। কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল, “হ্যাঁ, ও-ই অভিমন্যু।”

“ব্যস, আর কিছু বলার দরকার নেই। চুলে পাক আমার এমনি এমনি ধরেনি। তুমি বোধ হয় ভুলে গেছ, রাজদীপের সাথে তোমার এই বছরই বিয়ে। এই বাড়িতে এসেই কি তোমার দুটো ডানা গজায়? কি ভাব টা কি? যা ঐ বাড়িতে হয় না, তা সব এই বাড়িতে চালাবে? কার পারমিশন নিয়ে তুমি একটা অজানা অচেনা ছেলের সাথে সারাটা দিন।।।”

” মা ও অচেনা নয়, ও তো অভিমন্যু।”

“অভিমন্যু তোমার কাছে কয়েকদিনের পরিচিতিতে অচেনা নাই হতে পারে, কিন্তু বাকী সবার কাছে, আমার কাছে ও অচেনাই। তুমি রাজদীপের সাথে বেরোতে পারো না, এত কি আছে এই ছেলেটির সাথে বেরোনোর? তোমার ‘মঞ্জরী’তে সবাই ব্যাপারটা জানে তো?

“মা, অভিমন্যু আমার খুব ভাল বন্ধু। আর রাজদীপ আমার উডবি। তুমি কি বলে যাচ্ছ তখন থেকে? সারা কলকাতা এখন যে ঘটনাটা নিয়ে তোলপাড়, শিউলি সাউ-এর রেপ কেসটা, ওটাতে অভিমন্যু প্রত্যক্ষ দর্শী, সেদিনকার ঝামেলাটা এই ঘটনাটাকেই কেন্দ্র করে ছিল, আর তুমিই তো বলেছিলে সেদিন, দেখার পরও একবার গিয়ে দাঁড়ালাম না? সেই কারণেই আমি গেছিলাম পুরোটা জানার পর। আর এখন বলতে দ্বিধা নেই, আমি সত্যিই গর্বিত তোমার মেয়ে হয়ে। এতদিন শুধু শুনেছি, বুঝিনি কিছু। কিন্তু অভিমন্যুকে দেখার পর, ওর সাথে মেশার পর আমি বুঝেছি, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে ঠিক কতটা গাটস-এর প্রয়োজন। কেন আমি তোমার মেয়ে হয়েও তোমার মতন শক্ত মেরুদণ্ডের একটা মানুষ হতে পারিনি। আমার যে সাহসই নেই। কিন্তু অভিমন্যু! ও একদম তোমার মত। একটা কাজের মেয়ের জন্য ও যেভাবে সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে আর লড়ছে, মেয়েটাকে সুস্থ জীবনে ফেরানোর জন্য, ন্যায় দেওয়ানোর জন্য যেভাবে লড়ছে, খুব কম মানুষ এটা করে, আর অভিমন্যু তাদের মধ্যে একজন। ইনফ্যাক্ট, ও তো তোমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওর এই কাজে যদি কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারি, ওর পাশে থাকতে পারি, সেটাই আমার কাছে অনেক। আমি কাল দেখতেও গেছলাম শিউলিকে। শিগগিরই ছেড়ে দেবে ওকে, অনেকটা সুস্থ ও এখন। আর কালপ্রিটটাও এখন পুলিশ কাস্টডিতে। তুমি একবার অভিমন্যুর সাথে দেখা করবে মা প্লিজ। ওর দিদি তোমার পেন্টিং-এর বড়সড় ভক্ত। তুমি একবার দেখা করলে ওরও খুব ভাল লাগবে, ও খুব ভাল মা, খুব সৎ।।।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামল টিকলি। অমৃতা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেয়ের মুখের দিকে। টিকলি কি কিছুই বুঝতে পারছে না? ও কোন পথে এগোচ্ছে ও কি জানে না, নাকি পুরোটাই নিজের অজান্তে হচ্ছে? কিন্তু অমৃতা নিশ্চিত, এর পরিণতি মোটেই সুখকর হওয়ার নয়। টিকলির অজান্তেই টিকলির মুখ চোখ অভিমন্যুর কথা বলার সময় কি ভীষণ উজ্জ্বল, কই রাজদীপের ব্যাপারে কথা বলার সময় তো।।। রাজদীপের ব্যাপারে কটা কথাই বা বলে ও? আর ভাবতে পারছে না অমৃতা। খানিক চুপ থেকে অবশেষে বলল, “সবই বুঝলাম। তুমি কালই ‘মঞ্জরী’ ফিরে যাও। এমনিতেই তোমার এখানে এত আসাটা ও বাড়িতে ভাল চোখে দেখছে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর সামনে তোমার বিয়ে, এইসব কি করছ? আমি বুঝলাম অভিমন্যু ছেলেটা ভাল, সেই জন্যই বলছি, তোমার জন্যও, অভিমন্যুর জন্যও, এটা ঠিক করছ না টিকলি। তাই প্লিজ।।।”

“মা, তুমি কি বলে যাচ্ছ? রাজদীপের সাথে বিয়ের সাথে অভিমন্যুর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার সম্পর্ক কোথায়? ওয়েট আ সেকেন্ড, তুমি কি ভাবছ বলতো? আমার আর অভিমন্যুর মধ্যে কিছু।।। ওহ মাই গড! প্লিজ মা, আমি জানি আমি কোন বাড়ির মেয়ে, আর আমার ঠিক কতদূর অবধি যাওয়া উচিত। তুমি ভাবলে কি করে আমি অনন্যা রায়বর্ধন হয়ে একটা এরকম কাজ করে বসব? রাজদীপের সাথে বিয়েটা তো আমার অমতে হচ্ছে না মা, আর আমি সেটা নিয়ে যথেষ্ট হ্যাপিও। বেকার একটা সাধারণ ব্যাপারকে পেঁচিয়ে জটিল করে তুলো না মা।”

এভাবে রিয়াক্ট এর আগে টিকলি জীবনে করেছে কি না সন্দেহ। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল ও। অমৃতা স্থির হয়ে বসে ছিল তখনও। উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করছিল টিকলি। একমুহূর্তের মধ্যে যেন ছবিটা বদলে যেতে লাগল অমৃতার চোখের সামনে। কিছুক্ষণ আগেও টিকলির মধ্যে ১৫ বছর আগের অমৃতাকে দেখতে পাচ্ছিল ও, আচমকা আবার রঙ বদলে রায়বর্ধন পরিবারের রক্ত বইছে ওর শরীরে, এই কথাটা স্পষ্ট করে দিল টিকলি। অমৃতা নিজের মেয়েকে চিনতে পারে না তাই মাঝে মাঝে। এক একবার এক একটা অস্তিত্ব প্রকট হয় যেন টিকলির মধ্যে। এই তো একটু আগেই মেয়েটার চোখে যে ঔজ্জ্বল্য দেখছিল এখনই সেই চোখে অহংকারের ছাপ। টিকলির মাথায় কি চলছে? তাহলে কি অমৃতারই ভাবনাটা একটু বেশিই।।।”

“আর মা, বারবার আমায় এভাবে চলে যেতে বলবে না। আমি আর তাহলে আসবই না। না এলে আর তোমার এত অসুবিধাও হবে না। সরি, তোমায় এভাবে সমস্যায় ফেলার জন্য। আমি জানতাম না, জানলে আসতাম না।”

বন্ধ দরজাটা খুলে চলে গেল টিকলি। খাবার রইল পড়ে। কিছু বলার মতো শব্দ ছিল না আর অমৃতার কাছে। পাশের ঘরে ঢং ঢং করে ১১টার ঘন্টা পড়ল।

।।২।।

(দিন কয়েক পর)

বিকেলের রেওয়াজ সেরে তানপুরাটা গুছিয়ে রাখছিল টিকলি, রেওয়াজে মন লাগছে না আজ, তাই খানিক আগে ভাগেই উঠে পড়ল। মার সাথে সেদিনকার ঝামেলাটার পরদিনই ‘মঞ্জরী’ চলে এসেছিল টিকলি, তারপর দু’প্রান্ত থেকেই আর কোন ফোন হয়নি। কিন্তু এই বাড়িতে আসা অবধি বাড়ির বাকী মানুষগুলোও ভারী অদ্ভুত ব্যবহার করছে ওর সাথে। কি যে ওর অপরাধ কে জানে, ও যাই করে, তাতেই কি মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি হয়? এরকম চলতে থাকলে তো কোথাওই শান্তিতে থাকতে পারবে না ও। দমবন্ধ লাগছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকবার ডায়াল করতে গিয়েও করেনি ও আর। মা কি সব বলে গেল সেদিন? পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে নাকি? নাকি টিকলিকে পাগল ভেবেছে? কারও সাথে বন্ধুত্ব হলে, তার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগলেই কি তার সাথে সেই ধরণের সম্পর্ক থাকতে হয়? আশ্চর্য তো! আর টিকলির কি মাথা খারাপ? বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর, আর সর্বোপরি, ও কোন বাড়ির মেয়ে সেই সব মাথায় থাকার পরও।।। হোয়াট রাবিশ! রাজদীপের জায়গায় মা অভিমন্যুকে চিন্তা করলই বা কি করে? মায়ের মাথাটা এবার সত্যিই গেছে একা থেকে। এই কারণেই অভিমন্যুর সাথে বিগত কয়েকদিন কোন কন্ট্যাক্ট করেনি টিকলি। মা যে কতটা ভুল সেটা মাকে ও এবার প্রুফ করে দেবে। কিন্তু, এই বাড়ির মানুষগুলো এরকম ছাড়া ছাড়া ব্যবহার করছে কেন? সত্যিই কি ওর ঐ বাড়ি যাওয়া নিয়ে।।। দরজায় টোকা পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়ল টিকলির।

*****

ছোটবেলা থেকেই দাদাই এর সাথেই টিকলির মেলে বেশ। বাকিদের সাথে বয়সটারও ফারাক বেশী, এটাও একটা কারণ যদিও, দাদাই টিকলির থেকে মাত্র বছর পাঁচেকের বড়। পুপু, বাবাই-এর সাথে টিকলির প্রায় আট-দশ বছরের তফাত। তাই দাদাই আর বৌদির সাথে আড্ডাটা জমে ভাল। ব্যবসায় ঢোকার পর থেকে, আর সেভাবে আড্ডা হয় না বহুদিন, তারপর হঠাৎ করেই দাদাই-এর বিয়েটা হয়ে গেল চটজলদি, তারপর পুরোদস্তুর ফ্যামিলি ম্যান। আজ বহুদিন পর দাদাই এল টিকলির ঘরে আড্ডা মারতে। আগে ঘন্টার পর ঘন্টা চলত ওদের আড্ডা, এমনও হয়েছে বড়মা ওদের এই ঘরেই খেতে দিয়ে গেছে, ওরা খেয়েদেয়ে এঁটো হাতেই গল্প করে গেছে। বড়মা এসে না তোলা অবধি। আড্ডায় এত মগ্ন যে উঠতে হবে সেই খেয়ালটুকুও পড়তো না ওদের।

“আয় রে দাদা।”

অনি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকেই খাট থেকে তাকিয়াটা নিয়ে আমেজ করে বসল।

“তোমার বৌদিকে পার্সেল করে এলাম, আপাতত কদিন নো চাপ।”

“বৌদি বাপের বাড়ি গেল? সেকি জানতাম না তো।”

“হ্যাঁ, হঠাৎই গেল, ওর পিসির শরীরটা খুব খারাপ হয়েছে হঠাৎ, আর ওর বাবা মা তো ফেরেনি এখনও ট্যুর থেকে, পরশু ফিরছে। তাই ও তড়িঘড়ি চলে গেল। যাক গে, ছাড়, বস, কতদিন আড্ডা হয় না, মাকে বলে এলাম, গরম গরম পকোড়া হচ্ছে।”

“ওহ, দারুণ! বাবাই, পুপু ওরা কোথায় গেল? ডাকি?”

“না, না, ওরা টিউশন পড়তে গেছে, বস তো তুই।”

“ওহ।” আর কথা না বাড়িয়ে সামনের সোফাটায় বসে পড়ল টিকলি।”

“রেওয়াজ হয়ে গেল?”

“হ্যাঁ রে, আসলে গলায় একটু ঠান্ডাও লেগেছে, পারলাম না বেশীক্ষণ টানতে।”

“বৃষ্টিতে ভিজেছিলি নাকি?”

“হ্যাঁ, কদিন আগে একটু ভেজা হয়েছিল বৃষ্টিতে, ঐজন্যই বোধ হয় ঠান্ডাটা লেগে গেল।”

“তুই তো গাড়িতে যাতায়াত করিস, তাও ভিজলি কি করে?”

“না, মানে।।।” থমকে গেল একমুহূর্তের জন্য টিকলি। সেদিন তো গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল ও। অভিমন্যুর বাইকে ফিরেছিল ও। দাদাইকে কি তাহলে।।।

“সাবধানে থাক, নয়তো তোরই রেওয়াজের ক্ষতি হবে। তারপর? রাজদীপের সাথে কথা হল?”

টিকলিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার প্রশ্নটা করল অনির্বাণ।

“না, মানে।।।”

“সেকি? রাজদীপ তো এসেছিল কিছুদিন আগে, তোর সাথে দেখা করতে, তোকে সম্ভবত ফোনে পায়নি তাই, তারপর আর কথা হয়নি তোর সাথে?”

এবারেও টিকলি কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। দাদাই হঠাৎ করে।।। আমতা আমতা করতে গিয়ে আবারও কিছু বলা হল না ওর।

দাদাই-ই আবার বলল, “সামনে বিয়ে, এবার একটু বেচারাকে অ্যাটেনশন দে। এই সময়টা এনজয় করে নে, বিয়ের আগের এই মোমেন্টসগুলো আর কোনদিন ফেরত আসবে না।” হাসিহাসি মুখে কথা কটা বলে আবার টিকলির চোখের দিকে সরাসরি তাকাল অনির্বাণ। টিকলির এবার বেশ নার্ভাস লাগছিল। দাদাই-এর কথাগুলো কেমন যেন লাগছিল আজ কানে। দাদাই-এর চোখ থেকে নজর সরিয়ে নিল টিকলি, মাথাটা নাড়ল শুধু।

“কাকীমণি কেমন আছেন রে? কতদিন দেখা হয় না কাকীমণির সাথে। ভাবছি এরপর তুই যেদিন যাবি যাব তোর সাথে? আচ্ছা তোর বিয়ে নিয়ে নিশ্চয় কাকীমণিও সাংঘাতিক এক্সটাইটেড! কিরে?”

টিকলি কিছু বলার আগে পকোড়া নিয়ে বিমলাদি হাজির।

“ওহ, বিমলাদি, মোক্ষম সময়ে এসেছ, দাও দাও, উফফ! দারুণ, পুরো স্বর্গ!”

গরম গরম পকোড়া মুখে পুরে থালাদুটো হাতে নিয়ে এসে বসল দাদাই।

“সন্ধ্যের আড্ডা তার সাথে মার হাতের চিকেন পকোড়া। উহ! নে নে, খা গরম গরম।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে, খাচ্ছি।” গরম পকোড়া মুখে পুরল টিকলি।

“উমম! দারুণ হয়েছে রে দাদাই, আজকেরটাও, অ্যাজ ইউজুয়াল।”

“একদম।”

থালায় পকোড়া সাফ হতে লাগল দ্রুত হারে। মিনিট খানেক পর পকোড়া চিবোতে চিবোতে অনির্বাণ বলল, “তুই খুশী তো রে টিকলি?”

বাজ পড়ার মতই কানে লাগল কথাটা ওর। দাদাই-এর মুখের দিকে তাকাল টিকলি, দাদাই-এর মুখের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, দেখে দূর দুরান্তেও বোঝার উপায় নেই মনের মধ্যে ঠিক কি চলছে?

টিকলির কাছে এই প্রশ্নের কি উত্তর হয়, এতদিন খুব সহজই ছিল। আজ ‘হ্যাঁ’ বলতে একটু থমকাল, তবে উত্তরটা বদলাল না। “হ্যাঁ, খুশী কেন হবোনা, যাব্বাবা!”

কিছু বলল না অনির্বাণ, টিকলির দিকে তাকিয়ে হাসল শুধু, তারপর বলল, “জানিস তো এখন কিন্তু আমার আর রিমঝিমের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। বিয়ের সময় যে মারাত্মক চাপে ছিলাম, যে আদৌ আমি ওর সাথে এডজাস্ট করতে পারব কি না, এখন কিন্তু সেই ব্যাপারটা নেই। ইনফ্যাক্ট, এখন আর তৃষাকে মিস করি না আমি। এই কিছুদিন আগেই ক্রসিং-এ ওর দোকানটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, দেখলাম, একইরকম আছে, একটু রোগা হয়ে গেছে, বাকি একদম এক। শুনলাম ওর-ও সামনেই বিয়ে। রিমঝিমকে নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই রে। ও খুব ভাল মেয়ে, কিন্তু এখনও মনে হয় সেদিন গলায় প্রতিবাদের জোরটা থাকলে আজ আমার আর তৃষার সংসারটাও সুন্দর হতে পারত।”

এইটুকু বলে চুপ করল অনির্বাণ। দাদাই-এর বিয়েটা একটু হুট করেই হয়েছিল, আর এই কথাগুলো বড়মা আর টিকলি ছাড়া সেভাবে কেউ জানেও না। দাদাই কোনদিন কাউকে কিছু বলতেই পারেনি। বলার চেষ্টাও করেনি, অশান্তির ভয়ে, লোকসমাজের ভয়ে। বললে আজ ছবিটা হয়তো অন্যরকম হত। খানিক থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলল অনির্বাণ, “তৃষা যে নিজেকে গুছিয়ে ভাল থাকার চেষ্টা করছে ও ভাল আছে, আমি এতেই খুশী। আমিও রিমিঝিমকে নিয়ে।।। বলে দেব ভাবছিলাম এবার রিমঝিমকে, দিয়ে বলতে গিয়ে দেখি ও আগে থেকেই জানতো, মেয়েরা বোধ হয় আগে থেকেই বুঝতে পারে, যাক গে। তুই ভালো থাক এটাই চাই।” চুপ করল অনির্বাণ।

এখনও পুরোটা পরিষ্কার নয় টিকলির কাছে। দাদাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে মনটা পড়তে চেষ্টা করছিল। দাদাইটা ওর বরাবরই চাপা স্বভাবের। এখন তাও একটু সবার সাথে কথা বলে। আগে বড়মা আর টিকলি, ব্যস। ক্রেডিট গোস টু বৌমনি। কিন্তু হঠাৎ এই কথাগুলো টিকলিকে।।।

“বাইকে করে ঘুরলে মাথাটা আর ঢাকবে কি করে? আর আমায় কিছু বলার দরকার নেই, শুধু নিজেকে জোর করে কিছু বোঝাস না। ব্যস, ভাল থাক তুই।”মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বেরিয়ে গেল দাদাই। তার মানে দাদাই এতক্ষণ ধরে।।। ওহ মাই গড। সবাই মিলে এরকম কেন ভাবছে? নাকি এটাই সত্যি? টিকলিই জোর করে নিজেকে অন্য কিছু বোঝাচ্ছে। ফোনটা বেজে উঠল টিকলির। ফোনটা হাতে নিতেই ধক করে উঠল ওর বুকটা।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

সাঁঝের শিশির

প্রথম পর্ব ।।১।। “টিকলি তোর হলে চলে আয় এবার, খেতে দিয়ে দিয়েছি।” রেওয়াজ শেষে চোখ দুটো এতক্ষণে খুলল টিকলি, ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। প্রণাম করে

Read More »

Share with