আজগুবি

ajgubi story image

মৌসুমীর সাথে কালকে এতটা খাওয়াটা ঠিক হয়নি, এখন আর শরীরে অত সহ্য হয় নাকী, রাত বাড়তেই বুকে জ্বালা, বদহজম । বাড়িতে বলতেও পারছে না; পাচ্ছে রীতা জিজ্ঞেস করে – কার সাথে কোথায় খেলে? ওর তো সন্দেহ আর প্রশ্নের অন্ত নেই ।

আশীষ সাহা, একটা বেসরকারী ব্যাঙ্কে কর্মরত । মৌসুমী আশীষের কলিগ কম অন্য কিছু বেশি, আর রীতা আশীষের সহধর্মিনী । প্রথমেই স্পষ্ট রীতা সন্দেহবাতিক, তবে সন্দেহের যথেষ্ট কারণও বর্তমান তাও স্পষ্ট ।

রীতা পেশায়, স্কুল শিক্ষিকা, ওদের একমাত্র ছেলে স্কুলে পড়ে । উল্টোডাঙার কাছে এই ফ্ল্যাটে ওদের ছোট্ট সংসার ।

মৌসুমীর মায়াবী নেশাতুর চোখের চাহনিতে যেদিন মজেছিল আশীষ, সেদিন ঘুনাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি সম্পর্কটা এতদূর অবধি গড়াতে পারে ।

ট্যুরের নাম করে দীঘা, মন্দারমনির ট্রিপগুলোয় ভালই কাটছিল আশীষের । নিজের বাড়ি, অফিসে একরকম আর হোটেলের রুমের মধ্যে জান্তব শীৎকারে মৌসুমীর সাথে খোলস ছেড়ে আর একরকম । মৈথুন শেষে মৌসুমীর নরম শরীরে যখন জড়িয়ে থাকে আশীষের হাত, তখন কলকাতায় রীতা, আশীষের স্ত্রী স্বামীর প্রতীক্ষায়, চোখে একরাশ অপেক্ষা আর আস্থা নিয়ে । কিন্তু যা রটে, তার কিছু তো বটে, রীতার কানেও নানাভাবে অনেকদিন ধরেই বহু কথা পৌঁছেছিল, তাই আশীষ আর রীতার অসুখী দাম্পত্যের কথা বাড়ির দেয়াল থেকে আত্মীয় স্বজন সবাই-ই জানে ।

প্রথম প্রথম সুন্দরী মৌসুমীর রূপে ভুলে আরও একটা হিসাব ভুল করে ফেলেছিল আশীষ, মৌসুমী যে আদৌ নিরীহ, গোবেচারা নয়, যা তার মুখের হাসি বলে, সেটা বুঝতে সময় লেগে গেছিল বেশ খানিকটা । তারপর মৌসুমীর মায়ার জাল কেটে যতই বেরোতে চেয়েছে, ততোই যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে ও আশীষকে । যদিও আশীষেরও যথেষ্ট মর্জি ছিল, তাও কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরবে তা ছিল আশাতীত ।

*************

নীল নরম আলোয় মৌসুমীর মায়াবী চোখে আর সমুদ্রের গম্ভীর গর্জনে বিভোর আশীষ, তাজপুরের হোটেলটায়, তখনই কেমন যেন ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় আঁচ করতে পারছিল আসন্ন অশনী সংকেত । মৌসুমীর শরীরের মাতাল করা সুবাসে বারংবার খেই হারালেও খালি তাল কাটছিল আশীষের মৌসুমীর বলা কিছু শব্দে, ও যে বড় কিছু ভাবছে, এটা বুঝতে পারছিল আশীষ ।

***************

বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরছিল আশীষ । এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ও, মৌসুমী তো কিছুতেই সন্তানটাকে নষ্ট করবে না বলছে, এদিকে রীতাকে কী জবাব দেবে? ওর মাথাই কাজ করছে না । অন্যমনস্কভাবে তাকিয়েছিল বাসের জানলা দিয়ে । বাস টা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থামতেই ভাবনাটায় দাঁড়ি পড়ল তখনকার মতো । সামনে কিসের এত জটলা ! কিছুক্ষন ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে একে একে অনেকেই দেখতে ছুটল যে ঠিক কী হয়েছে, সেই দলে আশীষও ছিল । একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে সামনে, একজন মহিলা, খুব একটা বয়স বলে মনে হলো না, গর্ভবতী, স্পট ডেড ।

দেখেই গা-টা গুলিয়ে উঠল আশীষের, অসুস্থ বোধ করছিল বড্ড, এভাবে সামনে থেকে তো সচরাচর দেখে না ।

***************

ঘটনাটার এক দুদিনের মাথাতেই কেসটা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য একে একে উঠে আসছিল খবরের পাতায় । ওটা নাকি এক্সিডেন্ট নয়, সুসাইডও নয়, খুন করে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এক্সিডেন্ট কেস দেখতে চেষ্টা করা হয়েছে, এরকমই আরও অনেক কিছু । ঘটনাটা চোখের সামনে দেখা বলে আশীষের মনে একটু বেশিই যেন তার ছাপ ফেলেছিল ।

।।২।।

ঘটনাটার রেশ তখনও পুরোপুরি কাটেনি, আবার আর একটা ঘটনা খবরের পাতায়, আবারও একরকম । আর কী মিল ঘটনাদুটোর মধ্যে, দুজন মহিলাই গর্ভবতী, দ্বিতীয়জনও খুনই হয়েছেন, এক্সিডেন্ট কেস দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, পুরোটাই এক । পুলিশ পুরোপুরি ক্লুলেস, তবে দ্বিতীয়জন আশীষের বিশেষ পরিচিত, মৌসুমী ।

*************

মৌসুমীর এরকম অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বাভাবিক ভাবেই অফিসের সবাই-ই যথেষ্ট বিচলিত, অনেকেই যে অনেক রকম কথা বলছে, অনেকেই অনেক সন্দেহ প্রকাশ করছে, সেটা আশীষের চোখ-কান এড়ায়নি । ও নিজেও বিধ্বস্ত । হ্যাঁ, ওদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল, যথেষ্ট গভীর সম্পর্ক ছিল, কিন্তু, ব্যস, ঐ অবধিই । এর বেশী আর কিছু তো ও চায়নি, তার মধ্যে এই প্রেগনেন্সি । ওদের অফিসের নাম করে ট্যুরগুলো কারোরই চোখ এড়াত না, তাতে ওদের খুব একটা যায়ও আসত না । দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ কোথায় যাবে, কী করবে একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ।

কিন্তু, এই ঘটনাটার পর ও চাইলেও আর শান্ত থাকতে পারছে না । একেক জনের একেক রকম মন্তব্যে প্রাণ রীতিমত ওষ্ঠাগত ।

*************

বিগত কিছুদিন ধরেই রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না আশীষের, মাঝে মাঝেই চোখের সামনে যেন মৌসুমীর মুখটা ভেসে আসছে, আজ থানাতেও ডেকেছিল, আবারও ডাকবে বলেছে । ও একটু একটু করে যেন কেস টার জালে জড়াতে শুরু করেছে, আর কেস এর চার্জে যে পুলিশটা আছে, তাকে হাত করা খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না । রীতাও এখন আবার সন্দেহ করতে শুরু করে দিয়েছে, কোনটা ছেড়ে কোনটা সামলাবে ও?

*************

আজ অনেকটা টাকা গচ্ছা গেল, পুলিশটাকে একটু বেশি টাকার লোভ দেখাতেই ঠিক হাতে চলে এল, প্রমান সব এখন আশীষের হাতে, কেসের ফাইল বন্ধ । অনেকদিন পর অন্তত একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারবে ও । বাথরুমের শাওয়ারটা খুলে দাঁড়াল আশীষ, সারা শরীরে জলের ধারায় যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শ্রান্তি, কালিমা, প্রমান, রক্ত ! হ্যাঁ, রক্ত, নিজে হাতে মৌসুমীকে খুন করেছে আশীষ । এছাড়া আর কী করতো? অনেকবার বুঝিয়েছিল ও, বোঝেনি মৌসুমী । ব্ল্যাকমেল করছিল । নিজেকে বাঁচাতে, সংসার, চাকরি বাঁচাতে বাধ্য হয়েছে ও । যাক গে, প্রমান যা কিছু ছিল, সব তো এখন ওর হাতেই, আর কেস এগোবে না, এটাই বড় কথা ।

ajgubi story second image

স্নানটা সেরে বেরোতেই হোঁচট খেল আশীষ । থানা থেকে ফিরে প্যাকেট খাতে রেখেই স্নানে গেছিল ও, ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিল বটে, কিন্তু লক নয়, আর তার ফলেই এখন প্যাকেটটা রীতার হাতে । ময়নাতদন্তের ফলে উঠে আসা যাবতীয় রিপোর্ট যা আশীষের দিকে আঙ্গুল তোলে, সবকিছু ছিল ওর মধ্যে । 

রীতা আশীষের চোখে চোখ রেখে একটা প্রশ্ন ছোঁড়ে,”এই সব রিপোর্ট তোমার কাছে থাকার তো কথা নয়, তুমি এসব নিয়ে কি করছ? এসবের মানেই বা কী? এই রিপোর্টগুলোর মানে কি?” এরকমই অজস্র প্রশ্নবাণ আসতে থাকে আশীষের দিকে । রিপোর্টগুলোয় লেখা ভারী ভারী ডাক্তারী শব্দগুলো আর তার সাথে আশীষের সম্পর্ক নিয়ে সিওর হতে পারছে না তখনও রীতা, এটা আশীষ বুঝে ফেলেছে । রীতা বেশি কিছু বোঝা বা বলার আগেই।।।।।

।।৩।।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল আশীষ । উফফ, মাথাটা আশায় যন্ত্রনা করছে, রোজ এই টেনশন, আর নিতে পারছে না ও । একটু কী শান্তিতে বাঁচতে পারবে না কখনও?

রাত তখন প্রায় তিনটে । ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে অবিরাম।।।। চারদিক নিস্তব্ধ ।

রাতজাগা পাখিটা ডেকে চলেছে পাশের বাড়ির কার্ণিশটায়, জানলার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াল আশীষ । শরীরটা একটু হালকা লাগছে এখন, রোজ কেন এরকম হচ্ছে ওর সাথে ও নিজেও জানে না । ঘটনাগুলো ঘটে গেছে আজ কত্তগুলো বছর হয়ে গেল, তবু যেন ওকে তাড়া করে বেড়ায়, ওর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় যেন মৌসুমী আর রীতা । নিজের হাতটা মাঝেমাঝেই যেন মনে হয় রক্তাক্ত, আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেও পাশে এসে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই । রীতার ঘটনাটার পর ছেলেটাকেও শ্বশুরবাড়ির লোক নিয়ে চলে গেছে, তারপর আর নিজের ছেলের সাথে দেখাটুকুও নেই আশীষের ।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এভাবেই আশীষ । একটু জল খেতে পারলে ভাল হয়, এভাবে ওর শরীরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে ।

প্রেশার, হার্টের প্রব্লেম, সুগার, সবকিছু এখন নিত্যসঙ্গী । তার ওপর একাকীত্ব, আর এখন এই ভয়, আতঙ্ককে সঙ্গী করে নিত্যদিনের এই জীবন । এভাবে বাঁচা যায়?

জলটা খেতে যেতেই আঁতকে ওঠে আশীষ, সামনের আয়নাটায় চোখ পরে ওর, এ কী দেখছে ও? এ ও সম্ভব? ভয়ে, টেনশনে মাথাটা ঝিমঝিম করছে, মাথা কিছু কাজই করছে না ।

এ কীভাবে সম্ভব? খাটে আরও কেউ একজন শুয়ে আছে, হ্যাঁ, ও ঠিকই দেখছে । কিন্তু ও তো ফ্ল্যাটে একাই থাকে । ভয়টা আবার জাঁকিয়ে বসছিল আশীষের ওপর । ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ, শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত । ঘরটার পরিবেশটা একটু আগেও হালকা ছিল, এখন কেমন একটা গুমোট, যেন ঝড়ের আগের পূর্বাভাস ।

পাগুলো খুব ভারী লাগছে ওর, তাও অনেক কষ্টে এগোল খাট এর দিকে । কী হচ্ছে ওর সাথে? কাছে যেতেই আঁতকে কয়েকপা পিছনে ছিটকে গেল আশীষ । কী করবে এবার ও? কাকে ডাকবে এবার? ওর কথা কেউ শুনতে পাবে আর? গলা দিয়ে আর কোন আওয়াজও বেরোচ্ছে না যে ।

******************

ওর নিজের ডেডবডি ওরই চোখের সামনে, রোজকার এই আতঙ্ক, ভয়, টেনশন, একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়ে নিয়েছিল ও ড্রিংক্স-এর সাথে, শেষ রাতে ।

*****************

ভোরের আলো পুবাকাশে একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করেছে, একটু পরেই কাগজওয়ালা, দুধওয়ালা এসে বেল বাজাবে । সবাই সব জানতে পারবে, আবার গসিপ হবে, কাগজে বেরোবে, আবার লোকে ভুলেও যাবে, কেউ কাউকে মনে রাখবে না । ভোর হতে চলল, পাখিটা ডাকছে, এবার যেতেই হবে আশীষকে, আর সময় নেই, ওর জন্য অপেক্ষা করছে নতুন কিছু । মৃত্যুর পরের জীবনটাও কী এরকমই হবে ওর? কে জানে।।।

ajgubi story third image

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with